সারমর্ম

শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,

জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।

চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,

কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?

সময় ছাড়িয়া দিয়া করে পণ্ডশ্রম,

ফল চাহে, সেও অতি নির্বোধ, অধম।

খেয়া-তরী চ’লে গেলে বসে এসে তীরে,

কিসে পার হবে, তরী না আসিলে ফিরে?

সারমর্ম: নৈতিকতা শেখার যথার্থ সময় শিশুকাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে না পারলে জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমনকি অসময়ে অতিশ্রমেও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হয় না।

কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?

মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।

রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়,

আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।

প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,

স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।

সারমর্ম: স্বর্গ ও নরক প্রাপ্তি ঘটে পরকালে এমনটিই প্রচলিত ধারণা। কিন্তু পৃথিবীতেই স্বর্গ কিংবা নরক রচনা করা সম্ভব। প্রীতি ও প্রেমেই স্বর্গীয় সুখ আসে; হিংসা ও কুপ্রবৃত্তি দেয় নরক-যন্ত্রণা।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি –

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

সারমর্ম: নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পুরাতনকে চলে যেতে হয়। বর্তমান পৃথিবী নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে সুখকর ও বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব পুরাতন প্রজন্মের।

8

আসিতেছে শুভদিন,

দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!

হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,

পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,

তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,

তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;

তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,

তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।

সারমর্ম: শ্রমজীবী মানুষের কঠোর শ্রম ও ত্যাগে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। ধনিকশ্রেণির দ্বারা নিপীড়িত হলেও তারা সত্যিকারের মহৎ মানুষ। একদিন তাদের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে এ বিশ্বে নতুন দিনের সূচনা ঘটবে।

বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা,

কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।

দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস –

কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?

বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি?

শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী,

আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,

তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।

সারমর্ম: শস্যসম্পদ অর্জন করা কষ্টসাধ্য। তাই মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও শ্রমের এত মূল্য। অন্যের করুণার উপরে নির্ভরশীল হলে মানুষের মর্যাদা বাড়ে না। কষ্ট করে পাওয়া ফলের মধ্যে মানুষের গৌরব নিহিত।

ধন্য আশা কুহকিনী! তোমার মায়ায়

অসার সংসারচক্র ঘোরে নিরবধি!

দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়!

মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি!

ভবিষ্যৎ-অন্ধ মূঢ় মানব-সকল

ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল আকার;

তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ; পেয়ে তব বল

যুঝিছে জীবন-যুদ্ধ হায়! অনিবার।

নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে,

নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।

সারমর্ম: আশা জীবন-সংসারের অদৃশ্য চালিকাশক্তি। আশা না থাকলে মানবজীবন স্থবির ও জড়তায় পর্যবসিত হতো। আশা আছে বলেই এর মন্ত্র-মায়ায় মানুষ সামনে এগিয়ে চলে, সমৃদ্ধির লক্ষ্যে জীবন-যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

নিখিলের এত শোভা, এত রূপ, এত হাসি-গান,

ছাড়িয়া মরিতে মোর কভু নাহি চাহে মন-প্রাণ

এ বিশ্বের সব আমি প্রাণ দিয়ে বাসিয়াছি ভালো –

আকাশ বাতাস জল, রবি-শশী, তারকার আলো।

সকলেরই সাথে মোর হয়ে গেছে বহু জানা-শোনা,

কত কি-যে মাখামাখি, কত কি-যে মায়া-মন্ত্র বোনা।

বাতাস আমারে ঘিরে খেলা করে মোর চারিপাশ,

অনন্তের কত কথা কহে নিতি নীলিমা আকাশ।

চাঁদের মধুর হাসি, বিশ্বমুখে পুলক চুম্বন,

মিটিমিটি চেয়ে থাকা তারকার করুণ নয়ন,

বসন্ত নিদাঘ-শোভা, বিকশিত কুসুমের হাসি,

দিকে দিকে শুধু গান, শুধু প্রেম-ভালবাসাবাসি।

সারমর্ম: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীকে অপরূপ করেছে। প্রকৃতি মানুষের মনকে পুলকিত করে; আবার প্রকৃতির প্রেমে মানুষের মন বাঁধা পড়ে। এই মায়া ত্যাগ করে কেউই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে চায় না।

ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,

ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,

আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে

আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,

সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে

পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।

আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

সারমর্ম: নবীনের কর্মচঞ্চলতায় পৃথিবী নতুন রূপে সাজে। যারা পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখে, তারা নতুন পরিবর্তনকে ভয় পায়। তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে সবাইকে উজ্জীবিত হতে হবে।

দৈন্য যদি আসে, আসুক, লজ্জা কিবা তাহে?

মাথা উঁচু রাখিস।

সুখের সাথী মুখের পানে যদি নাহি চাহে,

ধৈর্য ধরে থাকিস।

রুদ্ররূপে তীব্র দুঃখ যদি আসে নেমে,

বুক ফুলিয়ে দাঁড়াস,

আকাশ যদি বজ্র নিয়ে মাথায় পড়ে ভেঙে,

ঊর্ধ্বে দু’হাত বাড়াস।

সারমর্ম: বিপদ ও দুঃখে কাতর হলে চলবে না। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়। সংগ্রাম ছাড়া জীবনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়।

১০

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,

সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।

তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,

শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো

দানবের মতো চিৎকার করতে করতে,

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।

তুমি আসবে ব’লে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।

তুমি আসবে ব’লে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার

ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।

তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা

অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

সারমর্ম: অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। শত্রুবাহিনীর চরম আক্রোশ ও নির্মমতার শিকার হয়েছে নারী, শিশুসহ আপামর জনসাধারণ। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতাকে কোনো মূল্য দিয়ে মাপা যায় না।