হাসান আজিজুল হক
বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার
পরিচিতি
হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ – ১৫ নভেম্বর ২০২১) ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। তিনি ষাটের দশকের বাংলা ছোটগল্প আন্দোলনের একজন শক্তিশালী লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গি, শক্তিশালী ভাষাশৈলী এবং গ্রামীণ-শহুরে জীবনের অন্তর্গত টানাপোড়েনকে অনন্য ভঙ্গিতে উপস্থাপন করার জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাত। তাঁর সাহিত্যকর্মে রাঢ়বঙ্গের পটভূমি বারবার ফিরে এসেছে।
২০০৬ সালে প্রকাশিত “আগুনপাখি” তাঁর প্রথম উপন্যাস, যা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মোহাম্মদ দোয়া বখশ এবং মাতা জোহরা খাতুন। যদিও স্কুল সনদে জন্ম তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি, তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন তাঁর প্রকৃত জন্মদিন সম্ভবত ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯।
- ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফাইনাল উত্তীর্ণ হন।
- ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
- ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
- ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
- পিএইচডি করার জন্য অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন, তবে শেষ করেননি।
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তিনি ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং পাকিস্তান সেনাদের হাতে নির্যাতিতও হন।
কর্মজীবন
- ১৯৬০–১৯৭৩: রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ ও ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা।
- ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং দীর্ঘ ৩১ বছর (২০০৪ পর্যন্ত) কর্মরত ছিলেন।
- ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “বঙ্গবন্ধু চেয়ার” পদে দায়িত্ব পালন করেন।
- ২০১৪ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।
তাঁর নিজস্ব বাড়ি “উজান” রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটে অবস্থিত, যা সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল।
সাহিত্যজীবন
সূচনা
লেখালেখির হাতেখড়ি কৈশোরে। স্কুলজীবনে সম্বর্ধনাপত্র লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু।
- প্রথম গল্প “মাটি ও পাহাড়” (মুকুল পত্রিকা, ১৯৫৬)।
- ১৯৬০ সালে “শকুন” গল্প প্রকাশিত হলে সাহিত্য মহলে ব্যাপক আলোচনায় আসেন।
- ১৯৬০–এর দশক থেকে নিয়মিত ছোটগল্প প্রকাশ শুরু করেন।
ছোটগল্প
ষাটের দশকে তিনি ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষ, সমাজ-অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রান্তিক মানুষের যন্ত্রণা তাঁর গল্পের মূল উপজীব্য।
- উল্লেখযোগ্য গল্প: একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, নামহীন গোত্রহীন, আত্মপ্রকাশ, শকুন ইত্যাদি।
উপন্যাস
- আগুনপাখি (২০০৬) – তাঁর প্রথম উপন্যাস, যেখানে এক নারীর কণ্ঠে গ্রামীণ জীবনের টানাপোড়েন, দেশভাগের ইতিহাস ও ব্যক্তিগত বেদনা ফুটে উঠেছে।
- রক্তস্নাত সকাল ও অন্যান্য উপন্যাসও পাঠকমহলে আলোচিত।
প্রবন্ধ ও আত্মজীবনী
- ফিরে যাই ফিরে আসি – তাঁর আত্মস্মৃতিকথা, যেখানে শৈশব থেকে সাহিত্যজীবনের নানা অভিজ্ঞতা বর্ণিত।
- সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০)
- একুশে পদক (১৯৯৯)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯)
- “সাহিত্যরত্ন” উপাধি (২০১৮)
ব্যক্তিজীবন
তাঁর স্ত্রী ছিলেন শামসুন নাহার বেগম। দীর্ঘদিন রাজশাহীতে বসবাস করে তিনি সেখানে সাহিত্যিক সমাজ ও ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন।
মৃত্যু
২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
উত্তরাধিকার
হাসান আজিজুল হক আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের এক শক্তিশালী কণ্ঠ। তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে সাধারণ মানুষের জীবন, রাঢ়বঙ্গের মাটি-মানুষ এবং বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা অনন্য ভঙ্গিতে ধরা পড়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন।