হায়াৎ সাইফ: জীবন, সাহিত্য ও অবদান
সাইফুল ইসলাম খান (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪২ – ১৩ মে ২০১৯), যিনি হায়াৎ সাইফ নামে পরিচিত, বাংলাদেশের একজন প্রতিভাধর আধুনিক কবি, সাহিত্য সমালোচক এবং সমাজবুদ্ধিজীবী ছিলেন। তিনি সমসাময়িক জীবন ও সংস্কৃতির গভীর পর্যবেক্ষক এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
হায়াৎ সাইফ ১৯৪২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোসলেম উদ্দিন খান এবং মাতার নাম বেগম সুফিয়া খান। পিতার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকার কারণে তার শৈশব কাটে রাজশাহীতে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি কবিতা ও সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।
কর্মজীবন
১৯৬৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) এ যোগ দেন। তিন দশকের বেশি সময় তিনি রাজস্ব প্রশাসন ও কর নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকায় রেডিও পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ বেতার) কেন্দ্রে এবং পরে পাকিস্তান টেলিভিশনের লাহোর কেন্দ্রে নৈমিত্তিক ঘোষক ও সংবাদপাঠক হিসেবে কাজ করেছেন। অবসরের পরও তিনি মাঝে মাঝে সাহিত্যকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভায় উপস্থাপনা করতেন।
১৯৯৩ সালে তিনি ফিসকাল ফ্রন্টিয়ার্স (Fiscal Frontiers) নামের ইংরেজি জার্নাল প্রকাশ শুরু করেন এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত এর সম্পাদনা করেন। পরে ২০০৫ সালে তিনি আইস টুডে সাময়িকীতে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
সাহিত্য জীবন
১৯৬০-এর দশক থেকে হায়াৎ সাইফ কবিতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে তার প্রথম কবিতা সমকালে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সন্ত্রাসে সহবাস প্রকাশিত হয়।
মোট প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫, যার মধ্যে বাংলা কাব্যসংকলন ৮টি, প্রবন্ধসংকলন ২টি। এছাড়া, তার কবিতা ও প্রবন্ধ ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
প্রধান গ্রন্থসমূহ:
- উক্তি ও উপলব্ধি (১৯৯২)
- প্রধানত স্মৃতি এবং মানুষের পথচলা (২০০৯)
- ভয়েস অব হায়াৎ সাইফ (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯৯৮)
- সাইফ: সিলেক্টেড পয়েম্স (২০০১)
তার সাহিত্যকর্মে মূলত ভালবাসা, নির্জনতা এবং মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
স্কাউট আন্দোলনে অবদান
১৯৯০-এর দশক থেকে হায়াৎ সাইফ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্কাউট আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের জাতীয় কমিশনার (জনসংযোগ ও প্রকাশনা) ও এশিয়া-প্যাসিফিক স্কাউট অঞ্চলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৫ সালে তিনি ব্রোঞ্জ উলফ পুরস্কার লাভ করেন, যা বিশ্ব স্কাউট কমিটির সর্বোচ্চ সম্মান। ৩০৫তম পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই সম্মান অর্জন করেন।
ব্যক্তিগত জীবন
হায়াৎ সাইফ বিবাহিত ছিলেন তাহামিনা ইসলাম লাকি এর সঙ্গে। দম্পতির তিন ছেলে রয়েছে। তিনি ব্যক্তিজীবনে শান্তিপ্রিয় ও নম্র ছিলেন, যা তার সাহিত্যকর্মেও প্রকাশ পেয়েছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
- ব্রোঞ্জ উলফ পুরস্কার (২০০৫)
- কবি ফজল শাহাবুদ্দীন কবিতা পুরস্কার (২০১৫)
- একুশে পদক (২০১৮)
মৃত্যু
হায়াৎ সাইফ ১৩ মে ২০১৯ সালে ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার অবদান বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, স্কাউট আন্দোলন এবং সমাজসেবায় স্মরণীয় হয়ে আছে।