স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস

🏛️ স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস
✨ ১ম ধাপ: স্লাভ জাতির পরিচিতি ও উৎস
ইউরোপের ইতিহাসে বহু জাতিগোষ্ঠীর আগমন, বিকাশ ও বিস্তারের কাহিনি নানা রকম গতিতে প্রবাহিত হয়েছে। এই বিশাল নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো স্লাভ জাতির উত্থান ও বিবর্তন, যা পরবর্তীতে রাশিয়ার ইতিহাস ও জাতিসত্তার ভিত্তি তৈরি করেছে। এই জাতি শুধু একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষা এবং জীবনব্যবস্থার বহুমাত্রিক পরিচয় বহন করে। রাশিয়ার গোড়াপত্তন বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে এই স্লাভ জাতির উৎস, বিকাশ ও শাখাগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
স্লাভ শব্দের অর্থ ও উৎস
“স্লাভ” শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে নানা মত রয়েছে। এটি সম্ভবত এসেছে প্রাচীন স্লাভিক শব্দ “Slovo” থেকে, যার অর্থ “শব্দ” বা “বাক্য”। এর মাধ্যমে বোঝানো হতো এমন এক জনগোষ্ঠী যারা নিজেদের ভাষায় কথা বলত এবং বাইরের অজানা জাতিগোষ্ঠীদের ‘নীরব’ বা ‘অস্পষ্টভাষী’ বলে মনে করত। এই ‘অস্পষ্ট’ বা ‘অবিচার্য’ মানুষদের তারা বলত “Niemi”, অর্থাৎ নির্বাক বা বোবা। যেমন, জার্মানদের স্লাভরা ‘নিয়েমচি’ বলে সম্বোধন করত। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্লাভদের ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্বাস।
স্লাভ জাতির উৎস ও প্রাথমিক অবস্থান
স্লাভ জাতির আদি নিবাস ছিল ইউরোপের পূর্ব-মধ্যভাগে, যা আজকের পোল্যান্ড, ইউক্রেন ও বেলারুশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। তারা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী এবং খ্রিস্টপূর্ব হাজার বছরেরও আগে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে তারা ছিল ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং নদী, বন ও কৃষিজমির আশপাশে বসতি গড়ে তুলত। নদীসমূহ যেমন দনুব, ভিস্তুলা, ডন ও নিপার তাদের জীবনযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
প্রাচীন ঐতিহাসিক টলেমি, প্লিনি ও জর্ডানেসের লেখায় স্লাভ জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতকে গ্রীক ঐতিহাসিক জর্ডানেস তাদের “Veneti” নামে অভিহিত করেন এবং বলেন, এই জনগোষ্ঠী বিস্ময়করভাবে দ্রুত পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
জীবনধারা, ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা
প্রাচীন স্লাভদের জীবন ছিল প্রাকৃতিক ও কৃষিনির্ভর। তারা প্রধানত কৃষি, পশুপালন, শিকার ও জেলে জীবিকার ওপর নির্ভর করত। তাঁদের গৃহ ছিল কাঠের তৈরি, এক কক্ষবিশিষ্ট, সরল জীবনযাপনের প্রতিফলন। সমাজব্যবস্থা ছিল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক; নেতৃত্ব দিতেন বয়োজ্যেষ্ঠরা বা যোদ্ধা নেতা। নারীরাও সমাজে বিশেষ ভূমিকা রাখত, বিশেষ করে চাষাবাদ ও পরিবারব্যবস্থায়।
ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্লাভরা ছিল পৌত্তলিক। তারা বহু দেবতা ও প্রকৃতিপূজায় বিশ্বাসী ছিল। বজ্রের দেবতা Pērūn, পশুসম্পত্তির দেবতা Veles, প্রজননের দেবী Mokosh প্রভৃতিকে পূজা করা হতো। আগুন, পানি, বৃক্ষ এবং সূর্যের পূজার রীতিও ছিল প্রচলিত। প্রতিবছর বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত।
স্লাভদের তিনটি প্রধান শাখা
সময় গড়াতে গড়াতে স্লাভরা ভূখণ্ড ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে—
পশ্চিম স্লাভ (West Slavs)
এই শাখাটি বসতি গড়ে তোলে পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়ায়। তারা পোলস, চেকস ও স্লোভাকস নামে পরিচিত হয়। এদের ভাষা ছিল পোলিশ, চেক ও স্লোভাক, এবং তারা প্রধানত রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে।
পূর্ব স্লাভ (East Slavs)
পূর্ব স্লাভরাই পরে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ অঞ্চলের ভিত্তি স্থাপন করে। এদের ভাষা রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান ও বেলারুশিয়ান। এই শাখাটি ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূলে পরিণত হয়।
দক্ষিণ স্লাভ (South Slavs)
বাল্কান উপদ্বীপে বসতি গড়ে দক্ষিণ স্লাভরা—বর্তমান সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া ও মেসিডোনিয়ায়। তারা পরবর্তীতে ধর্মীয়ভাবে বিচিত্র হয়ে পড়ে—কিছু অংশ অর্থোডক্স, কিছু ক্যাথলিক এবং কিছু অংশ ইসলাম গ্রহণ করে, বিশেষ করে অটোমান শাসনের প্রভাবে।
এই বিভাজন শুধু ভৌগোলিক নয়, বরং ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
অভিবাসন ও বিস্তার
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত সময়কাল স্লাভ অভিবাসনের যুগ হিসেবে পরিচিত। তারা ধীরে ধীরে পশ্চিম ইউরোপ, বাল্কান অঞ্চল ও ইউরেশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিস্তারের ফলে তারা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়, তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে এবং নতুন রাজনৈতিক সত্তার ভিত্তি স্থাপন করে।
এই অভিবাসনের মাধ্যমে:
- স্লাভরা নতুন নতুন নগর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে।
- যোদ্ধা নেতৃত্ব ও সামন্তপ্রথা চালু হয়।
- বাইরের জাতিগোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা ও সংঘাত দুটোই ঘটে।
- পরবর্তীতে কিয়েভান রুশ ও মস্কো রাজ্য গঠনের ভিত্তি তৈরি হয়।
স্লাভ জাতির ইতিহাস কেবল একটি জাতিগোষ্ঠীর অভ্যুদয় নয়, বরং এটি ইউরোপ ও ইউরেশিয়ার সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও রাজনৈতিক গঠনের মূলে থাকা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই জাতির তিনটি শাখা—পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ—তাদের নিজস্ব পথ অনুসরণ করে আলাদা আলাদা পরিচিতি লাভ করে। এর মধ্যে পূর্ব স্লাভরা পরবর্তীতে রাশিয়ার জনপদের ভিত্তি স্থাপন করে এবং রুশ ইতিহাসের প্রাচীনতম অধ্যায়কে শক্ত ভিত্তি দেয়।
এই ভিত্তির উপরই পরবর্তীতে গড়ে ওঠে কিয়েভান রুশের উত্থান, যা রাশিয়ার ইতিহাসের প্রথম রাজ্যীয় কাঠামো হিসেবে বিবেচিত। পরবর্তী ধাপে আমরা সেই কিয়েভান রুশের বিবর্তন, বাইজেন্টাইন ও নর্স প্রভাব এবং স্লাভীয় ঐতিহ্যের রাজনৈতিক রূপান্তর বিশ্লেষণ করব।
ধন্যবাদ! এখন উপস্থাপন করছি “স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস” প্রবন্ধের ২য় ধাপ: প্রাচীন স্লাভ ও কিয়েভান রুশের উত্থান।
এই ধাপে আমরা দেখব কিভাবে পূর্ব স্লাভদের মাঝে গড়ে উঠল রুশ জাতির প্রথম কেন্দ্র — কিয়েভান রুশ, যার ইতিহাস রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশ—তিনটি জাতির উত্স হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
🏛️ স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস
✨ ২য় ধাপ: প্রাচীন স্লাভ ও কিয়েভান রুশের উত্থান
স্লাভ জাতির পূর্বশাখা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে প্রবেশ করে নবম শতকের দিকে, যখন তারা পূর্ব ইউরোপের বিশাল ভূখণ্ডে বিস্তার লাভ করে এবং ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলে। এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল কিয়েভান রুশ। এই রাষ্ট্র ছিল পরবর্তীকালে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশ — এই তিনটি আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শেকড়।
কিয়েভান রুশের আবির্ভাব
কিয়েভান রুশ নামে পরিচিত এই রাজ্যটির কেন্দ্র ছিল কিয়েভ শহর, যা আজকের ইউক্রেনের রাজধানী। নবম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে নর্স বা ভাইকিং জাতি—বিশেষ করে ভ্যার্যাংগিয়ানরা বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আগমন করে। তারা স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে এসে স্লাভ গোষ্ঠীর সাথে মিশে যায় এবং ধীরে ধীরে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
৮৬২ খ্রিস্টাব্দে রুরিক নামক এক স্ক্যান্ডিনেভীয় নেতা নোভগোরোদ অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উত্তরসূরি ওলেগ ৮৮২ সালে কিয়েভ দখল করে কিয়েভান রুশ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই এই অঞ্চল একটি ঐক্যবদ্ধ পূর্ব-স্লাভিক রাষ্ট্রে রূপ নেয়।
বাইজেন্টাইন প্রভাব ও খ্রিস্টীয় ধর্ম
কিয়েভান রুশের রাজনৈতিক বিকাশের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রভাব এসেছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে। ৯৮৮ সালে রাজা ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টধর্ম (ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান) গ্রহণ করেন এবং কিয়েভান রুশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এটি ছিল রুশ ইতিহাসের এক মোড় ঘোরানো সিদ্ধান্ত, কারণ খ্রিস্টান ধর্ম কেবল ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক স্তরেও গভীর পরিবর্তন আনে।
ভ্লাদিমির খ্রিস্টীয় ধর্ম গ্রহণের ফলে:
- বাইজেন্টাইন শিল্প, স্থাপত্য ও শিক্ষা কিয়েভে প্রবেশ করে
- ধর্মীয় পুস্তক অনুবাদ শুরু হয়
- গির্জা নির্মাণ শুরু হয় — যেমন সেন্ট সোফিয়া ক্যাথেড্রাল
- গোঁড়ামি ও পৌত্তলিকতা থেকে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে সরে আসে
শাসনব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামো
কিয়েভান রুশ ছিল রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে রাজা বা ‘গ্র্যান্ড প্রিন্স’ ছিলেন কেন্দ্রীয় শাসক। তিনি বংশানুক্রমিক পদ্ধতিতে শাসন করতেন এবং নিজ গোষ্ঠীভিত্তিক প্রিন্সদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিতেন। সমাজ শ্রেণিভিত্তিক ছিল — উচ্চবিত্ত অভিজাত শ্রেণি, বণিক, কৃষক ও দাস শ্রেণি বিদ্যমান ছিল।
বাণিজ্যও ছিল কিয়েভান রুশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। ভলগা ও দনুব নদীপথ ধরে তারা বাইজেন্টাইন, পারস্য, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করত। বিশেষ করে মোম, পশম, মধু, দাস ও অস্ত্র ছিল প্রধান পণ্য।
স্লাভ-নর্স সম্পর্ক ও জাতিগত মিশ্রণ
কিয়েভান রুশ রাষ্ট্র গঠনে নর্স (ভ্যার্যাংগিয়ান) ও পূর্ব স্লাভ জাতির মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটে। প্রথমদিকে নর্সরা শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সময়ের সাথে তারা স্লাভদের মধ্যে আত্মীকৃত হয়ে যায়। ভাষা, ধর্ম, পোশাক ও অভ্যাসে স্লাভিক রূপ গ্রহণ করে এবং রুশ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এই মিশ্রণই রুশ পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি তৈরি করে। ইতিহাসবিদরা একে বলেন “Normanist vs Anti-Normanist” বিতর্ক, যেখানে কিছু পণ্ডিত মনে করেন রাশিয়ার সূচনা ছিল বিদেশি জাতির হাতে, আবার অনেকে বলেন স্লাভরা নিজেরাই আত্মনির্ভর রাষ্ট্র গঠন করেছিল—ভ্যার্যাংগিয়ানরা শুধু সহায়কের ভূমিকা পালন করে।
সাংস্কৃতিক বিকাশ
কিয়েভান রুশে সাহিত্য, ধর্মীয় চর্চা ও স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটে। তারা সাইরিলিক লিপি গ্রহণ করে, যা আজও রাশিয়ান, বুলগারিয়ান ও ইউক্রেনিয়ান ভাষার মূল লিপি। পণ্ডিত নেস্টর তাঁর “Primary Chronicle” নামক গ্রন্থে রুশ ইতিহাস লিখে যান, যা আজও ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কিয়েভ শহর নিজেই হয়ে ওঠে একটি বাণিজ্যিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এটি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল যে একে অনেক সময় বলা হতো “মাদার অফ রাশিয়ান সিটিজ”।
পতনের শুরু
১১শ শতকের পর থেকে কিয়েভান রুশের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দুর্বল হতে থাকে। বিভিন্ন প্রিন্সদের মধ্যে বিভাজন, বাইরের আগ্রাসন এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রটিকে দুর্বল করে তোলে। এর সুযোগে ১৩শ শতকে মঙ্গোলরা (তাতার-সাম্রাজ্য) আক্রমণ করে কিয়েভকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে কিয়েভান রুশ ভেঙে পড়ে, এবং নতুন কেন্দ্র হিসেবে উদয় ঘটে মস্কো শহরের।
কিয়েভান রুশ ছিল পূর্ব স্লাভদের রাজনৈতিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের সূচনা। এটি শুধু রাশিয়ারই নয়, বরং ইউক্রেন ও বেলারুশের ইতিহাসেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাইজেন্টাইন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, নর্সদের সহায়তায় শাসন কাঠামো এবং স্থানীয় স্লাভ ঐতিহ্যের সংমিশ্রণেই রুশ জাতির মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এই ভিত্তির উপরেই পরবর্তীতে গড়ে ওঠে মস্কোর রাজ্য, যা ধীরে ধীরে রাশিয়ার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
🏛️ স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস
✨ ৩য় ধাপ: মঙ্গোলিয়া আক্রমণ ও মস্কোর শক্তি বৃদ্ধি
একটি সভ্যতার ওপর বহিরাগত আক্রমণ প্রায়শই তাৎক্ষণিক ধ্বংস ডেকে আনে, কিন্তু অনেক সময় এই ধ্বংসই নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়। কিয়েভান রুশের পতন ও মস্কোর উত্থান — এমনই এক উত্তাল সময়ের গল্প, যেখানে ব্যথা ও নির্মাণ পাশাপাশি ঘটে।
মঙ্গোলদের আগমন: ইউরোপে এক দুর্বার ঝড়
১৩শ শতকের শুরুর দিকে, পূর্ব ইউরেশিয়ার মরুভূমি অঞ্চল থেকে এক ভয়াবহ শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায় — মঙ্গোল সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খান-এর নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই সাম্রাজ্য ১২৩৭-১২৪০ সালের মধ্যে রুশ ভূমিতে প্রবেশ করে তার বংশধর বাটু খান-এর অধীনে। তারা ‘তাতার-ইয়োক’ (Tatar Yoke) নামে পরিচিত এক দীর্ঘ শাসন শুরু করে।
১২৪০ সালে কিয়েভ শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয় মঙ্গোল বাহিনী। ঐতিহাসিকদের মতে, এই ধ্বংস ছিল এতটাই ভয়াবহ যে শহরটি শতাব্দী ধরে পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। অন্যান্য শহর যেমন রিয়াজান, সুজদাল, ভ্লাদিমির—সব একে একে মঙ্গোলদের হাতে পড়ে।
মঙ্গোল শাসনের ধরন
মঙ্গোলরা সরাসরি রাশিয়ান ভূমিতে বসবাস করত না, বরং তারা শাসন করত স্বাধীন রাজ্যগুলোর ওপর কর আরোপের মাধ্যমে। এই শাসনকে বলা হয় Golden Horde Rule। তারা স্থানীয় রুশ রাজপুত্রদের ‘ইয়ারলিক’ (শাসনের অনুমোদনপত্র) দিত, যারা মঙ্গোলদের প্রতি অনুগত থেকে নিজেদের শাসন চালাত।
এই শাসনব্যবস্থা:
- রুশদের আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা স্বাধীনতা দেয়
- রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয়ীকরণ ঠেকায়
- তবে বাণিজ্য ও প্রশাসনিক দক্ষতা কিছুটা বৃদ্ধি করে
মস্কোর সূচনা: একটি ছোট শহরের বড় যাত্রা
মঙ্গোল আক্রমণের সময় কিয়েভের মতো বড় শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু কিছু তুলনামূলক ছোট ও নতুন শহর বেঁচে যায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মস্কো। ১১৪৭ সালে প্রথমবার মস্কোর উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন এটি ছিল একটি ছোট দুর্গবিশিষ্ট জনপদ।
কিন্তু ১৩০০ সালের পর থেকে মস্কো দ্রুত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব অর্জন করতে থাকে:
- এটি ভ্লাদিমির-সুজদাল অঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হয়
- রুশ অর্থোডক্স চার্চের কেন্দ্র মস্কোতে স্থানান্তরিত হয়, যা ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধি করে
- মস্কোর রাজপুত্ররা মঙ্গোলদের অনুগত থেকে ‘গ্র্যান্ড প্রিন্স’ খেতাব অর্জন করে
ইভান কোলিতা থেকে ইভান দ্য গ্রেট
মস্কোর উত্থানের এক বড় কারিগর ছিলেন ইভান I (Ivan Kalita), যিনি বুদ্ধিমত্তা ও অর্থনৈতিক চাতুর্যের মাধ্যমে মঙ্গোলদের কাছে আস্থা অর্জন করেন। তিনি রুশ রাজ্যগুলোর কাছ থেকে কর আদায় করে মঙ্গোলদের হাতে তুলে দিতেন এবং নিজের শহর মস্কোকে সমৃদ্ধ করতেন।
পরবর্তী সময়ে ইভান III (Ivan the Great) ১৪৮০ সালে মঙ্গোল শাসনের অবসান ঘটান। তিনি Golden Horde-এর বিরুদ্ধে সফল বিদ্রোহ করেন এবং মস্কোকে রুশ ভূখণ্ডের কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত করেন।
তাঁর শাসনকালে:
- মস্কোকে “তৃতীয় রোম” বলা হতে শুরু করে
- বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর রুশরা নিজেদের অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের উত্তরসূরি দাবি করে
- তিনি বিশাল ভূখণ্ড একত্র করে একটি একক রাশিয়ান রাষ্ট্র গঠন করেন
মস্কোর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
ইভান III-এর সময় মস্কো কেবল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ক্রেমলিন প্রাসাদ, রেড স্কয়ার, এবং অসংখ্য গির্জা এই সময়েই গড়ে ওঠে। পাশাপাশি বাইজেন্টাইন সংস্কৃতি ও স্লাভ ঐতিহ্য একত্র হয়ে রুশ জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
কিয়েভান রুশের পতন যেন এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি, আর মস্কোর উত্থান যেন তারই গর্ভজাত নবজন্ম। মঙ্গোল আক্রমণ রুশ জাতিকে এক দিক দিয়ে দুর্বল করেছিল বটে, তবে অন্য দিক দিয়ে এটি তাদের ঐক্যের প্রেরণা জুগিয়েছিল। মস্কো-ই পরবর্তীতে রুশ সাম্রাজ্যের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে, যেখানে ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি মিলেমিশে এক নতুন রাশিয়া গড়ে ওঠে।
🏛️ স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস
✨ ৪র্থ ধাপ: রাশিয়ার সাম্রাজ্য ও আধুনিকায়ন
কিয়েভান রুশের পতন, মঙ্গোলদের প্রস্থান এবং মস্কোর অভ্যুদয়ের পর রাশিয়া প্রবেশ করে এক নতুন অধ্যায়ে। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের যুগ, যার চূড়ান্ত রূপ পায় রাশিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই যুগে রাশিয়া একদিকে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ভূখণ্ডে পরিণত হয়, অন্যদিকে তারা সামরিক, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির দিক থেকে আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড় করায়।
মস্কোভি রাজ্য থেকে রাশিয়ান সাম্রাজ্য
১৫৪৭ সালে ইভান IV (ইভান দ্য টেরিবল) নিজেকে প্রথমবারের মতো “Tsar of All Russia” ঘোষণা করেন। তিনি মঙ্গোল শাসনের ছায়া সরিয়ে একক রুশ জাতীয় পরিচয়ের ভিত গড়ে তোলেন। যদিও তাঁর শাসন ছিল নির্মম, কিন্তু তিনিই মস্কোভি রাষ্ট্রকে প্রথমবারের মতো একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে রূপান্তর করেন।
তারপর রাশিয়া ধীরে ধীরে পূর্বদিকে সাইবেরিয়া, দক্ষিণে কাজান ও আস্ট্রাখান, এবং পশ্চিমে পোল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তবে এই সাম্রাজ্য ছিল তখনো প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির দিক থেকে পশ্চাদপদ।
এই পশ্চাদপদতা ঘোচাতে, ১৭শ শতকের শেষভাগে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটে—পিটার দ্য গ্রেট-এর মাধ্যমে।
পিটার দ্য গ্রেট: আধুনিক রাশিয়ার রূপকার
পিটার I, যিনি ইতিহাসে “পিটার দ্য গ্রেট” নামে পরিচিত, ১৬৮২ থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত রাশিয়া শাসন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে সংস্কারক, সামরিক নেতা ও আধুনিকায়নের অগ্রদূত। তাঁর লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে পশ্চিম ইউরোপের মতো আধুনিক ও শক্তিশালী করা।
তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসমূহ:
- সেনাবাহিনির আধুনিকায়ন: ইউরোপীয় কায়দায় প্রশিক্ষিত স্থায়ী সেনা গঠন
- নৌবাহিনির সূচনা: রাশিয়ার প্রথম আধুনিক নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা
- প্রশাসনিক সংস্কার: পুরাতন বয়ার (অভিজাত) শ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস করে নতুন মেরিটভিত্তিক আমলাতন্ত্র গঠন
- পশ্চিমা পোশাক ও রীতিনীতি: পশ্চিমা পোষাক বাধ্যতামূলক করেন, দাঁড়ি কাটার নিয়ম চালু করেন
- শিক্ষা ও বিজ্ঞান: প্রযুক্তি, জ্যামিতি, নেভিগেশন প্রভৃতি শিক্ষার প্রসার ঘটান
সেন্ট পিটার্সবার্গ: নতুন রাজধানী, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
১৭০৩ সালে পিটার বাল্টিক সাগরের তীরে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন — সেন্ট পিটার্সবার্গ। এটি শুধু একটি শহর নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যমূলক আধুনিকতা ও পশ্চিমা ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার মিলনের প্রতীক। এখানে ইউরোপীয় স্থাপত্য, পরিকল্পনা ও সংস্কৃতির নিদর্শন দেখা যায়। অনেক সময় একে বলা হয় “উইন্ডো টু দ্য ওয়েস্ট”।
ক্যাথরিন দ্য গ্রেট: সাম্রাজ্য বিস্তার ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল যুগ
পিটারের মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর রাশিয়া আবার এক নবজাগরণের মুখোমুখি হয় ক্যাথরিন II (Catherine the Great)-এর সময়। তিনি ১৭৬২ থেকে ১৭৯৬ পর্যন্ত শাসন করেন এবং রাশিয়াকে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।
তাঁর সময়কার গুরুত্বপূর্ণ অবদান:
- সাম্রাজ্য বিস্তার: ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, বেলারুশ ও পোল্যান্ডের কিছু অঞ্চল রাশিয়ার অধীনে আসে
- দার্শনিক পৃষ্ঠপোষকতা: ফরাসি প্রজ্ঞাবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে চিঠিপত্র আদানপ্রদান (ভলতেয়ার, রুশো)
- আইন সংস্কার: ইউরোপীয় আইনের আলোকে রুশ বিচারব্যবস্থা সংস্কার
- নারীশাসকের দৃষ্টান্ত: একজন নারী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে অসাধারণ দক্ষতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করেন
তাঁর শাসনামলকে বলা হয় রাশিয়ার স্বর্ণযুগ। তিনি পিটারের আধুনিকীকরণকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্তরে বিস্তৃত করেন।
সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
পিটার ও ক্যাথরিনের শাসনে রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তন আসে:
- অভিজাতদের ইউরোপীয় কায়দা অনুসরণ বাধ্যতামূলক হয়
- নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়
- ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব বৃদ্ধি পায়
- শিল্প ও চিত্রকলায় ইউরোপীয় ধারা গৃহীত হয়
তবে এর সঙ্গে এক বৈপরীত্যও ছিল—গ্রামীণ কৃষক সমাজ রয়ে যায় পশ্চাদপদ ও নিপীড়িত। সার্ফডম বা ভূমিদাস প্রথা তখনো প্রচলিত ছিল, যা পরবর্তীকালে রুশ বিপ্লবের পটভূমি রচনা করে।
রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস পিটার দ্য গ্রেট ও ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের হাত ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নেয়। এটি ছিল ইউরোপীয় আধুনিকতা, সামরিক শক্তি ও সাংস্কৃতিক জাগরণের যুগ। মস্কো-নির্ভর রুশ রাষ্ট্র এখন একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব ইউরোপ, বাল্টিক অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ায়।
তবে এই আধুনিকতার নিচে চাপা পড়ে থাকে সামন্তবাদ, সামাজিক বৈষম্য ও কৃষকশ্রেণির নিপীড়ন, যা পরবর্তী ধাপে রাশিয়ার সমাজ ও রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই জমিনেই গড়ে ওঠে বিপ্লব, সমাজতন্ত্র এবং সোভিয়েত ইতিহাস—যা আমরা পরবর্তী ধাপে আলোচনা করব।
🏛️ স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস
✨ ৫ম ধাপ: সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আধুনিক রাশিয়া
একটি সাম্রাজ্য যখন নিজস্ব ওজনের ভারে ভেঙে পড়ে, তখন জন্ম নেয় নতুন কাঠামো, নতুন আদর্শ। রাশিয়ার ইতিহাসে ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব ছিল তেমনই একটি বিপ্লব, যা কেবল একটি রাজনৈতিক রূপান্তর নয়, বরং একটি পুরাতন সভ্যতার অবসান এবং নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার সূচনা।
বলশেভিক বিপ্লব: রাজতন্ত্রের অবসান
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ার অভ্যন্তরে চরম দুর্দশা, দুর্ভিক্ষ ও সামরিক ব্যর্থতার ফলে সার্বভৌম রাজতন্ত্র (Tsarist Autocracy) ভেঙে পড়ে। নিকোলাস II পদত্যাগ করেন এবং রাশিয়ায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
তবে এই সরকার বেশিদিন টিকতে পারেনি। অক্টোবর ১৯১৭-তে বলশেভিকরা, ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তারা রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র — সোভিয়েত রাশিয়া।
সোভিয়েত ইউনিয়নের গঠন
১৯২২ সালে রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ ও ককেশাস অঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় “ইউনিয়ন অব সোশ্যালিস্ট সোভিয়েত রিপাবলিকস” (USSR)। এটি ছিল একটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী রাষ্ট্র, যেখানে শ্রমিক ও কৃষক ছিল কথিতভাবে ক্ষমতার কেন্দ্র।
সোভিয়েত শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল:
- একদলীয় শাসন (কমিউনিস্ট পার্টির অধীন)
- ব্যক্তিমালিকানার বিলুপ্তি
- রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন ও কৃষিনীতির বাস্তবায়ন
- ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় নিপীড়ন
- শিক্ষার বিস্তার ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রয়াস
স্তালিনের যুগ: দমন, উন্নয়ন ও আতঙ্ক
ভ্লাদিমির লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্তালিন ক্ষমতা গ্রহণ করেন (১৯২৪–১৯৫৩)। তাঁর শাসনকাল ছিল একদিকে অভাবনীয় শিল্পায়নের যুগ, আবার অন্যদিকে ব্যাপক দমন-পীড়নের কাল।
উন্নয়ন:
- পাঁচ বছরের পরিকল্পনা (Five-Year Plans) — রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিল্প ও কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি, যেমন: মহাকাশ বিজ্ঞান, অস্ত্রশিল্প
- নিরক্ষরতা হ্রাস, সাধারণ শিক্ষার প্রসার
দমন:
- গুলাগ ক্যাম্প, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ বন্দি ছিলেন
- গ্রেট পার্জ, যার মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, সামরিক কর্মকর্তা নির্বিচারে হত্যা করা হয়
- গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশে কড়া নিয়ন্ত্রণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সোভিয়েত বিজয়
১৯৪১ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নে হামলা চালায়। সোভিয়েত বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং অবশেষে ১৯৪৫ সালে নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করে। স্ট্যালিনগ্রাড যুদ্ধ ছিল এই প্রতিরোধের মোড় ঘোরানো যুদ্ধ।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়:
- রাশিয়া বিশ্বে দুটি শক্তির একটিতে পরিণত হয় (সোভিয়েত বনাম আমেরিকা)
- পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ সোভিয়েত প্রভাবাধীন হয়
- শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold War)
ঠান্ডা যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতার যুগ
১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের বিরুদ্ধে সামরিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও আদর্শিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। এই সময়:
- মহাকাশ প্রতিযোগিতা — প্রথম স্যাটেলাইট (Sputnik) ও মহাকাশচারী (Yuri Gagarin) পাঠানো
- পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা
- উপনিবেশিক দেশগুলোতে আদর্শগত প্রভাব বিস্তার
তবে সোভিয়েত অর্থনীতি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে এবং গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির দাবি প্রবল হয়।
সোভিয়েত পতন: একটি সাম্রাজ্যের অবসান
১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসেন মিখাইল গর্বাচেভ। তিনি শুরু করেন দুটি সংস্কারমুখী নীতি:
- গ্লাসনোস্ত (উন্মুক্ততা): মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
- পেরেস্ত্রইকা (পুনর্গঠন): অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার
তবে এই সংস্কারই সোভিয়েত কাঠামোকে নড়বড়ে করে তোলে। ১৯৯১ সালে বহু প্রজাতন্ত্র একের পর এক স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১-এ আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান ঘটে।
আধুনিক রাশিয়া: রাষ্ট্রনায়কত্ব ও জাতীয়তাবাদ
সোভিয়েত পতনের পর রাশিয়া প্রবেশ করে এক অনিশ্চয়তার যুগে। অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে। তবে ২০০০ সালের পর ভ্লাদিমির পুতিন-এর নেতৃত্বে রাশিয়া এক ধরণের স্থিতিশীলতা ফিরে পায়।
আধুনিক রাশিয়ার বৈশিষ্ট্য:
- রাষ্ট্রনায়কত্ব ও কর্তৃত্ববাদী শাসন
- শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার
- আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা
- পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস
- স্লাভীয় জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ
রাশিয়ার বর্তমান সরকার পূর্ব স্লাভ ঐতিহ্যকে আবারো রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে। রুশ অর্থোডক্স চার্চ আবারো সক্রিয় হয়েছে, ঐতিহাসিক বিজয় ও সংস্কৃতিকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে।
স্লাভ ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন
বর্তমান রাশিয়া নিজেকে পূর্ব স্লাভ ঐতিহ্যের কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরছে। মস্কোকে বলা হচ্ছে “তৃতীয় রোম”, ঐতিহ্যবাহী রুশ সাহিত্যে ও স্থাপত্যে ফিরে আসছে পুরাতন স্লাভিক ছাপ।
উদাহরণস্বরূপ:
- রুশ ভাষা ও লিপির গর্ব বৃদ্ধি
- সাইরিলিক লিপির সংরক্ষণ
- ঐতিহাসিক চিত্র, চার্চ ও যুদ্ধজয়ের মহিমাকীর্তন
তবে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বিরোধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ও অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব রাশিয়ার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ।
✅ উপসংহার
স্লাভ জাতি ও রাশিয়ার ইতিহাস একটি জটিল, গভীর ও বিবর্তনশীল ইতিহাস — যা ভাষা, সংস্কৃতি, যুদ্ধ, ধর্ম ও রাজনীতির ছোঁয়ায় গঠিত হয়েছে। আদিতে স্লাভরা ছিল কৃষিনির্ভর, পৌত্তলিক জনগোষ্ঠী। পরে তারা কিয়েভান রুশে সংগঠিত হয়ে ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করে। মঙ্গোল আক্রমণ তাদের ধ্বংস করলেও, মস্কোর উত্থান রাশিয়াকে পুনরায় রাজনৈতিক কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
এরপর সাম্রাজ্য গঠনের মধ্য দিয়ে আধুনিকায়ন ঘটে। তবে তা এক সময় সমাজতন্ত্রের দিকে মোড় নেয়, সোভিয়েত যুগে রাশিয়া এক বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়। শেষত, পতনের পর রাশিয়া এখন এক আধুনিক, অথচ ঐতিহ্যনিষ্ঠ শক্তি — যার শিকড় পূর্ব স্লাভ ঐতিহ্যে, কিন্তু দৃষ্টি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর নিবদ্ধ।
এই ইতিহাস কেবল রাশিয়ার নয় — এটি একটি গোটা জাতিসত্তার, একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের, এবং এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলা সভ্যতাগঠনের প্রামাণ্য দলিল।
https://www.munshiacademy.com/স্লাভ-জাতি-ও-রাশিয়ার-ইতি/