স্বাধীনতা সংগ্রাম: বাঙালির আত্মত্যাগ ও মুক্তির ইতিহাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল একটি বীরত্বপূর্ণ, রক্তস্নাত ও সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফলাফল, যা কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়, বরং একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্য ও আত্মমর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এই সংগ্রাম দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছে—ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের দাবি, রাজনৈতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই ছিল এর মূল প্রেক্ষাপট।
🔶 পটভূমি: উপনিবেশ থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যার দুটি অংশ ছিল—পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, বাণিজ্য এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও তারা রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বঞ্চিত থাকে।
বাংলাভাষী জনগণ নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গর্বিত ছিল, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেই পরিচয়কে মুছে দিতে চেয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ থেকে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন, যা ১৯৫২ সালে রক্তক্ষয়ী পরিণতিতে পৌঁছে যায়। এই আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ।
🔶 ছয় দফা ও বাঙালির জাতীয় জাগরণ
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা, যা অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, মুদ্রা, বাণিজ্য, এবং প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। এই ছয় দফা ‘বাঙালির মুক্তির সনদ’ হিসেবে গণ্য হয়।
পাকিস্তানি সরকার ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং আন্দোলনকারীদের দমন করে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হন মতিউর রহমান, আসাদ, রুস্তম, জহির রায়হানসহ অনেকে। আইয়ুব পতনের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া খানের শাসন শুরু হলেও বৈষম্যের অবসান ঘটেনি।
🔶 ১৯৭০-এর নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতারণা
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো কুচক্রীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। ফলে পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শেখ মুজিব ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যেখানে তিনি বলেন—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই বক্তব্য জাতিকে প্রস্তুত করে দেয় একটি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য।
🔶 গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা
২৫ মার্চ ১৯৭১, কালরাত্রি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নৃশংস গণহত্যা চালায়, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিকে দমন করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, ইপিআর ব্যারাক, পিলখানা, এবং সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে নির্বিচারে হত্যা চলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ। সাধারণ মানুষ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিশু—সবাই অংশ নেয় এ যুদ্ধে।
🔶 মুক্তিযুদ্ধের পর্ব ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের তিনটি প্রধান ধাপ ছিল—
- প্রতিরোধ যুদ্ধ (মার্চ–এপ্রিল): সাধারণ মানুষ অস্ত্র তুলে নেয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে।
- গেরিলা যুদ্ধ (মে–আগস্ট): প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ভারত প্রশিক্ষণ শিবির খোলে ও ‘মুক্তিবাহিনী’ গড়ে তোলে।
- চূড়ান্ত মুক্তি অভিযান (সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর): মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে।
এ সময় আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় বাংলাদেশ সরকার। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানি সেনাপতি লে. জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
🔶 বিজয়ের অর্থ ও স্বাধীনতার চেতনা
বিজয় অর্জন ছিল কেবল ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়; এটি ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয়ের বিজয়। ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের অকার্যকারিতা প্রমাণ করে দেয় এই স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়—কিভাবে সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ—এই চার মূল স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠন।
🔶 উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদার ঘোষণা। এই সংগ্রাম আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, শোষণের শিকল ভেঙে দিতে। একাত্তরের এই আত্মত্যাগ ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্ব এই ইতিহাসকে জানার, সম্মান করার এবং সেই চেতনা ধরে রাখার।
স্বাধীনতা মানে শুধু পতাকা নয়—স্বাধীনতা মানে নিজের ভাষায় কথা বলা, নিজের মতে জীবন যাপন করা, এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলা।
https://www.munshiacademy.com/স্বাধীনতা-সংগ্রাম-বাঙাল/