স্বাধীনতার পর সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর দেশ একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনার পথে পা রাখে। তবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক শাসনের ছায়ায় ভুগে। স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দের মধ্যে দেশ নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক মতবিরোধ, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং সামাজিক অসন্তোষ দেশের শাসন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
১. স্বাধীনতার পর প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ
(ক) রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
- মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে
- রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান প্রণয়ন প্রয়োজন
- ভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব
(খ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
- যুদ্ধের ফলে দেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত
- অবকাঠামো, শিল্প ও কৃষি খাত ধ্বংস
- শরণার্থী পুনর্বাসন ও মানবিক ত্রাণ বিতরণ
(গ) প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ
- পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কাঠামো ভেঙে নতুন প্রশাসন গঠন
- বিচার ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন
২. সামরিক শাসনের উদ্ভব
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৭৫ সালে।
(ক) ১৫ আগস্ট ১৯৭৫
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড
- রাষ্ট্রপতি ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা হত্যার ঘটনা
- রাজনৈতিক চক্রে সামরিক অভ্যুত্থান
(খ) সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য
- প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা বাতিল বা সীমিত
- সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা শাসন
- রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ
৩. রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ
(ক) অভ্যুত্থান ও হত্যা
- বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনৈতিক শূন্যতা
- বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক ফ্র্যাকশন ক্ষমতা দখল
(খ) রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙন
- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মধ্যে মতবিরোধ
- বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম
(গ) অর্থনৈতিক দুর্বলতা
- মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্গঠন
- স্থানীয় অর্থনীতি পুনর্নির্মাণে বাধা
৪. সামরিক শাসনের প্রভাব
(ক) প্রশাসনিক প্রভাব
- নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেনাবাহিনীর ভূমিকা
- রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দুর্বলীকরণ
(খ) সামাজিক ও মানবিক প্রভাব
- গণতান্ত্রিক অধিকার সীমিত
- সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে নিষেধাজ্ঞা
- জনগণের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ
(গ) আন্তর্জাতিক প্রভাব
- মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্ন
- আন্তর্জাতিক সাহায্য ও কূটনৈতিক চাপ
৫. উল্লেখযোগ্য সামরিক শাসনকর্তা
(ক) জিয়াউর রহমান
- ১৯৭৫-১৯৮১ সালের সময়ে রাষ্ট্রপতি
- রাজনীতির পুনর্গঠন ও সামরিক শাসন
- নতুন রাজনৈতিক দল ও নীতি প্রবর্তন
(খ) হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
- ১৯৮২-১৯৯০ সালের সামরিক শাসন
- রাষ্ট্র প্রশাসন ও নতুন সংবিধান
- রাজনৈতিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান
৬. রাজনৈতিক আন্দোলন ও পুনরায় গণতন্ত্র
(ক) ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান
- হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনবিরোধী আন্দোলন
- ছাত্র, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল ও জনগণের সমন্বয়
- গণতান্ত্রিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
(খ) শিক্ষণীয় পাঠ
- সামরিক শাসনের সময় দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত
- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জনসাধারণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সংবিধান ও রাজনৈতিক চুক্তি অপরিহার্য
স্বাধীনতার পর সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি জটিল অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনৈতিক শূন্যতা, অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসনের প্রভাব দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে প্রভাবিত করে। তবে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করে।
এই অধ্যায় আমাদের শিক্ষা দেয় যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ দেশের জন্য অপরিহার্য। সামরিক শাসন সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকার সীমিত হলেও জনগণের ঐক্য ও সচেতনতা দেশের পুনরায় স্থিতিশীলতা ও বিকাশে মূল ভূমিকা পালন করে।