সেঁজুতি সাহা: আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

Spread the love

সেঁজুতি সাহা: আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

ভূমিকা

বিশ্বের আধুনিক চিকিৎসা ও জিনোমিক প্রযুক্তির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম—ড. সেঁজুতি সাহা। তিনি এমন একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী যিনি বাংলাদেশে মলিকুলার জেনেটিকস ও ইনফেকশাস ডিজিজ গবেষণার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। বিশেষ করে শিশুস্বাস্থ্য, রোগ শনাক্তকরণ ও সংক্রামক ব্যাধির নিয়ন্ত্রণে তাঁর অবদান যুগান্তকারী। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় তাঁর নেতৃত্বে Child Health Research Foundation (CHRF)-এর গবেষণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলে।

জন্ম, পারিবারিক পরিচয় ও শৈশব

সেঁজুতি সাহার জন্ম ঢাকায় হলেও তাঁর পারিবারিক শিকড় বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও গবেষণার পরিমণ্ডলে গাঁথা। তাঁর বাবা, অধ্যাপক ড. সামীর সাহা, একজন স্বনামধন্য মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং CHRF-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাবার গবেষণাগারে যাতায়াত করতেন, যেখানে পরীক্ষাগার, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ও স্লাইড ছিল তাঁর খেলার সাথী।
এই পরিবেশে বড় হওয়ার সুবাদে তাঁর মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা গড়ে ওঠে।

শিক্ষাজীবন

সেঁজুতি সাহা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি (Wesleyan University) থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি Johns Hopkins Bloomberg School of Public Health থেকে পিএইচডি করেন মলিকুলার মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজিতে। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল শিশুদের নিউমোনিয়া ও মেনিনজাইটিসের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াল প্যাথোজেনের জিনগত বৈচিত্র্য।

গবেষণা ও পেশাগত জীবন

ড. সেঁজুতি সাহা বর্তমানে Child Health Research Foundation (CHRF)-এর Director of Genomics হিসেবে কর্মরত। CHRF একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশে শিশুদের সংক্রামক রোগ, নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগ নিয়ে গবেষণা করে।

মূল গবেষণার ক্ষেত্রসমূহঃ

  1. Genomic Sequencing – ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে তাদের চরিত্র, রূপান্তর ও ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করা
  2. Vaccine Impact Studies – টিকার কার্যকারিতা মূল্যায়নে জিনোমিক ডেটা বিশ্লেষণ
  3. Antimicrobial Resistance (AMR) – অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু শনাক্তকরণ
  4. Pathogen Surveillance – রোগপ্রবণ এলাকার জীবাণুর গতিপ্রকৃতি ট্র্যাক করা
  5. Metagenomics & Bioinformatics – আধুনিক জীবতাত্ত্বিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অজানা প্যাথোজেন চিহ্নিতকরণ

কোভিড-১৯ মহামারীতে অবদান

২০২০ সালে কোভিড-১৯ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার শুরুতেই CHRF-এর গবেষণা দল সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে SARS-CoV-2 ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং শুরু করে।

✅ ২০২০ সালের মে মাসে তাঁরা বাংলাদেশের প্রথম কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করেন।
✅ এই সিকোয়েন্স GISAID এবং Nextstrain-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে জমা দিয়ে বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটির বৈশ্বিক রূপ পরিবর্তনের মডেলিংয়ে সহায়তা করে।
✅ তাঁরা কোভিড-১৯-এর স্থানীয় ভ্যারিয়েন্টগুলো শনাক্ত করেন এবং সেই অনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ দেন কিভাবে ভাইরাস ছড়ানো ঠেকানো যায়।

এই গবেষণার ফলে বাংলাদেশ প্রথম সারির দেশগুলোর কাতারে উঠে আসে যারা নিজেরা ভাইরাসের রূপান্তর শনাক্ত করে।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও অংশগ্রহণ

ড. সাহা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানমহলে একটি পরিচিত নাম। তিনি WHO, CDC, Bill & Melinda Gates Foundation-এর বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।

তিনি বাংলাদেশে Typhoid Conjugate Vaccine (TCV) কার্যক্রম চালুর গবেষণায় অংশ নিয়েছেন এবং এই রোগের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা প্রমাণে জেনোমিক বিশ্লেষণ করেন।

প্রকাশিত গবেষণাপত্র ও সেমিনার

তিনি Nature, Lancet Infectious Diseases, PLoS Genetics, এবং Clinical Infectious Diseases-এর মতো শীর্ষস্থানীয় জার্নালে বহু গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তাঁর গবেষণাপত্রে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের উন্নত পরিকল্পনার পরামর্শ রয়েছে।

তিনি TEDx, WHO Technical Workshop, One Health Asia Symposium-এর মতো আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছেন।

সম্মাননা ও অর্জন

ড. সেঁজুতি সাহার অর্জনের তালিকা সত্যিই বিস্ময়কর:

  • 🏅 Forbes Asia’s 30 Under 30 (2021) – স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে
  • 🏅 Clinton Global Initiative Fellow
  • 🏅 GAVI Vaccine Alliance-এ বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা
  • 🏅 MIT Solve-এর Solver (2022)
  • 🏅 Nature Research Awards for Inspiring Women in Science – Finalist

নারী বিজ্ঞানী হিসেবে অনুপ্রেরণা

বাংলাদেশের নারীদের জন্য তিনি এক অনন্য অনুপ্রেরণা। প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি এবং গবেষণার মতো ক্ষেত্র যেখানে এখনো নারী অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে সেঁজুতি সাহা নিজের দক্ষতা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তিনি বিভিন্ন স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও সামাজিক উদ্যোগে বিজ্ঞানবিষয়ক সচেতনতামূলক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তিনি বিজ্ঞানী হতে ইচ্ছুক তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দেন।

দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সেঁজুতি সাহা বিশ্বাস করেন—

Data saves lives. Science is not a luxury, it’s a necessity.

তাঁর লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা, যাতে গ্রামাঞ্চলেও বিজ্ঞানভিত্তিক রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধ সম্ভব হয়।

উপসংহার

ড. সেঁজুতি সাহা হলেন সেই মানুষ, যিনি গবেষণাকে কেবল গবেষণালয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে মাঠে, মানুষের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, উন্নয়নশীল দেশের গবেষকও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পারে। তাঁর চিন্তা, কর্ম, এবং গবেষণা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদের পথ দেখিয়ে চলেছে।

সেঁজুতি সাহা: আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *