শেষ কথাটি যাও বলে : সঙ্গ-প্রসঙ্গ
মুনশি আলিম
শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে শেকসপিয়ারের রোমান্টিক কবিতা দিয়ে। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নির্ঝর বেশ উজ্জ্বল। সুহানা ও অধরার মনস্তাত্তি¡ক দ্বৈরথ, নিখুঁত বিশ্লেষণ উপন্যাসটিকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী মাত্রা। এনজিও জীবনের জীবনালেখ্য আর রোমান্টিক ক্যানভাস সব মিলিয়ে পুরো উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে বেশ উপভোগ্য। উপন্যাসটি পঠনপাঠনে পাঠকের চোখের সামনে একে একে উন্মোচিত হবে ভূগোল, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নানা প্রচ্ছদপট। কথার গাঁথুনি, বর্ণনার সরলীকরণ, ভাবের শৈল্পিক সমীকরণ, দার্শনিক পদবাচ্যসুলভ বুলেট বাক্য সবকিছু মিলিয়ে ঔপন্যাসিকের আবেগধর্মী উপস্থাপন পাঠকহৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে বলেই আমার বিশ^াস।
উপন্যাসটিতে মোট অনুচ্ছেদ বা পর্ব রয়েছে ১৮টি। এতে কোনো উপপর্ব নেই। প্রতিটি পর্বের শুরু হয়েছে কবিতা দিয়ে। এতে বাংলা কবিতা সংযোজন করা হয়েছে মোট ১৫টি, ইংরেজি কবিতা সংযোজন করা হয়েছে ১১টি। প্রতিটি পর্ব এবং গল্পের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই কবিতাগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে। প্রতিটি কবিতাই কাহিনির আচ্ছাদনে বেশ প্রাণসঞ্চার করেছে। এই উপন্যাসে একজন পাঠক রোমান্টিক বলয়ের ভেতর দিয়ে মুহূতেই ঘুরে আসবে ইতিহাস ও ভূগোলের গভীর থেকে গভীরে। উপন্যাসে ইতিহাস সংযোজন মোটেও সহজ বিষয় নয়। গল্পের প্লট, চরিত্র, সংলাপ ঠিক রেখে ইতিহাসের সংযোজন ও ভৌগোলিক চিত্র কাহিনির সঙ্গে নিখুঁতভাবে লেপটে দেওয়া কালজয়ী উপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে মোজাম্মেল হক নিয়োগী নিঃসন্দেহে একজন মৌলিক কথাসাহিত্যিক।
বারোটি চরিত্রের সমন্বয়ে এই উপন্যাসের মূল কাহিনি সুসম্পন্ন হয়েছে। প্রধান চরিত্র তিনটি। নির্ঝর, অধরা ও সুহানা। এই চরিত্রত্রয়কে ফুটিয়ে তুলতে ঔপন্যাসিক আশ্রয় নিয়েছেন অন্যান্য চরিত্রগুলোর। বিশেষ করে মাহবুবুল আলম ওরফে মাহবুব, মোশারফ, নাজনিন, রামপদ, সুখেন হাওলাদার, ইমিও, ড. রঘুনাথ বসাক, ড. সুনীল প্রমুখ চরিত্র। হাস্যরসের জন্য বিশেষ কোনো চরিত্র নেই। অবশ্য এটি হাস্যরসপ্রধান উপন্যাসও নয়। নিটোল রোমান্টিক উপন্যাস। জগদ্বিখ্যাত বক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতায় যেমন সম্মোহনী শক্তির জারকরস উপচে পড়ে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদ এর লেখনীর মধ্যে যেমন পাঠক বুঁদ হয়ে থাকে তেমনই মোজাম্মেল হক নিয়োগীর এ উপন্যাসে পাঠক বুঁদ হয়ে থাকবে বলেই আমার বিশ^াস। লেখনীর ভেতর সম্মোহনী শক্তি থাকলেই কেবল পাঠককে ধরে রাখা যায়।
উপন্যাসটির পুরো ঘটনটিই প্রায় ভারতে। শুরু হয়েছে যশোরের বেনাপোল দিয়ে। ছয় সদস্যের একটি টিম কোম্পানির তরফ থেকে প্রণোদনা হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ ভ্রমণ অর্থাৎ ভারতে যাচ্ছে। তারা হলেন নির্ঝর, সুহানা, মাহবুব, মোশারফ, নাজনিন, রামপদ। তাদের আনন্দভ্রমণের মধ্য দিয়ে দুই দেশের কাস্টমস কর্মকতাদের ঘুসের চিত্রসহ বাস্তব দিকটিই ফুটে উঠেছে। সুহানা টিম মেমবারদের মধ্যে খুবই বুদ্ধিমতী আর সুন্দরী। অবিবাহিত নির্ঝর আর মোশারফ উভয়েই সুহানার প্রতি দুর্বল। সুহানা নির্ঝরের পাশের সিটে বসে দীর্ঘ ভ্রমণকালে বেশ আনন্দঘন রোমান্টিক সময় কাটায়। আর এসব চিত্র নাজনিনসহ অন্যান্য টিম মেমবারদের নজরও এড়ায় না। সত্য যেমন গোপন থাকে না ঠিক তেমনই আরকি!
নির্ঝর সুহানার অনুমতিক্রমে তাকে সুহা বলেই ডাকে। সুহানার বাবা একটি সরকারি ব্যাংকের এজিএম। ঢাকায় ওদের বাড়ি। আর এসব তথ্য জেনেই ভেতর থেকে সুহানার দিকে এগাতে সাহস পায় না নির্ঝর। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব মাহবুবের কুটিল চোখ কেবলই সুহানাকে খুুঁজে বেড়ায়।
ওয়াইডবিøউসিএ এর গেস্টরুমে অবস্থান থেকে শুরু করে গাইড সুখেন হাওলাদারের মাধ্যমে ভারতের বিভিন জায়গা সম্পর্কে বিস্তর ব্যাখ্যা ও নিটোল বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঘটনা ক্রমশ এগোতে থাকে। সুখেনের আগমনের পর শুরু হয় নতুন টানপোড়েন। অন্তর্দহনে পুড়তে থাকে নির্ঝর আর মোশারফ। সুহানার সঙ্গে সুখেনের নতুন বন্ধুত্বে রীতিমতো দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ^াস ফেলে মাহবুব।
কফিহাউজ, ধর্মতলা, হাওড়া, কলকাতার সংস্কৃতি আর সে সংস্কৃতির সঙ্গে মাহবুব, নির্ঝর, মোশারফ আর রামপদের অভিযোজন উপন্যাসে নতুন ব্যঞ্জনের সৃষ্টি করেছে। ইন্ডিয়ার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার নগ্নচিত্র পাঠকের চোখের সামনে চিত্রের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নাজনিন হয়ে উঠেছে এন্টি চরিত্র। কথাসাহিত্য বা নাটকে এমন চরিত্র না থাকলে প্রধান চরিত্রের গুণগুলোকে ফুটানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাছাড়া এসব এন্টি চরিত্রগুলোই পাঠকহৃদয়কে নানাভাবে দহনে পুড়াতে থাকে। টিপু সুলতানের দুর্ঘ, সামার প্যালেসের তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনা, পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে চেন্নাইয়ের বিবরণ পাঠকের ভালোলাগা আর কৌতূহলের মাত্রাকে নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে তুলবে।
মূলত নির্ঝর আর অধরার রোমান্টিক প্রেমকাহিনিই এখানে প্রধান আলোচ্যবিষয়। দুজনের ধর্ম ভিন্ন হলেও হৃদয় ও শরীর রসায়নে মানবমনই প্রধান হয়ে উঠেছে। যেথা ধর্ম কোনোরকমেরই অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি। এই দুই প্রধান চরিত্রের সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিশিরের মতোই নিটোল, শরতের বিকেলের মতোই সুন্দর অধরার হৃদয়। দৈহিক গড়নের দিক থেকে যেমন স্মার্ট তেমনই কথাবার্তায়। বহু গুণেই সে গুণান্বিতা। হিন্দিসহ ইংরেজি আর তামিল ভাষায় তার বেশ দখল রয়েছে।
পার্কে বেড়াতে গিয়েই মূলত শুরু হয় তাদের মনের রসায়ন। দুজনে পাশাপাশি হাঁটা, বৃষ্টিরোধক হিসেবে উভয়ে একই টাওয়ালের ব্যবহার, বাহু জড়িয়ে সম্মুখপানে হাঁটা সবমিলিয়ে এ যেনো নতুন সম্পর্কেরই শুভসূচনার আভাস। নির্ঝর একই রুমে অধরার সঙ্গে রাত কাটালেও বিশ^াসঘাতকতা করেনি। ফলে অধরার বিশ^াস ও ভালোবাসা ক্রমশই নির্ঝরের প্রতি গভীর হতে থাকে। অধরার সঙ্গে নির্ঝরের ভ্রমণ একই সঙ্গে যেমন উপন্যাসের পট পরিবর্তনে নতুন ভূমিকা রেখেছে তেমনই পাঠকহৃদয়ও অজ্ঞাতসারে এ অভিসার বা ভ্রমণকে মেনে নিয়ে নিজেই উজ্জীবিত হতে থাকে।
ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে মানুষের স্বাভাবিক ঈর্ষাকে খুব সরলভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। নির্ঝর ও অধরার নতুন সম্পর্ককে তার টিম মেমবাররা কিছুটা ঈর্ষার চোখেই দেখতে থাকে। বিশেষ করে সুহানা তো অধরাকে নির্ঝরের সঙ্গে দেখলে তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠত। সে জ¦লা বা দহনে কেবল সে নিজেই পুড়ে ছাড়খার হতে থাকে। তবে প্রথম দিকে তাদের পর্যটন গাইড সুখেন হাওলাদারের সঙে সুহানার অন্তরঙ্গতা, আড্ডার ধরন দেখেও নির্ঝরের হৃদয়ে ক্ষরণ হতো। সময়ে অনেককিছুই বদলে যায়। বদলে যায় মানুষের মন, বদলে যায় সম্পর্ক। মাহবুব তাদের টিম লিডার হলেও নির্ঝরের অভিসারে সে কিছুটা হলেও ঈর্ষান্বিত। আর এটা বোঝা যায় তার সংলাপেওÑ“বাহ্! বড়ো জমিয়েছ। আমি তো খরচের খাতায়। সবাই আব্বা ডাকে। আঙ্কেল ডাকে।” মাহবুবের দীর্ঘ দশ বছর ধরে তার স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক টানাপোড়েনের গল্পে মাহবুবের প্রতি কিছুটা হলেও পাঠকহৃদয়ের সহানুভূতির জন্ম হয়।
উপন্যাসের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে পাঠকহৃদয়েও ক্ষরণ হতে থাকেÑযখন মাহবুব কর্তৃক অধরাকে বিশ^াসভঙের মন্ত্র দেওয়া হয়। আর সে ফাঁদে পড়ে অধরা নির্ঝরকে ভুল বুঝতে থাকে। শুরু হয় নতুন ক্লাইমেক্স। শব্দশিল্প আর কাহিনির ব্যঞ্জনায় পাঠহৃদয়ও তখন দলিতমথিত হতে থাকে। ট্রেনিং শেষে তারা বিদায় নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও অধরা অধরাই থেকে যায়। না কথা বলে, না সামনে আসে।
উপন্যাসের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পাঠকহৃদয় আনন্দে বিহŸল হয়ে ওঠেÑযখন দেখে নির্ঝর ও অধরা কথা বলছে। অধরা তার ভুল বুঝতে পেরে এপোলজি স্বীকার করে। শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। ঔপন্যাসিকের ভাষায়Ñ“অধরা আরও কাছাকাছি হলো। এতটা কাছাকাছি এর আগে কখনো হয়নি।”
সংলাপও উপন্যাসের বিশেষ শিল্প হিসেবে বিবেচিত। পাত্রপাত্রীর মুখ দিয়ে সংলাপ বের হলেও পাঠককূল সে সংলাপের মাত্রা ধরে হাঁটে। আবার কোনো কোনো সংলাপ তো জাতীয় সংলাপ হিসেবেও বিবেচিত হয়; আবার কোনোটিও বা হয়ে ওঠে চিরন্তন বাণী।
উপন্যাসের চুম্বক অংশই হলো নির্ঝর আর অধরার হোটেলে রাত্রি যাপন। যে রাত্রির বুনো শরীরে লেগে রয়েছে ভালোবাসা আর বিশ^াসের প্রলেপ। নির্ঝরের নাম পরিবর্তন করে যখন সতীশ আচারিয়া নামে এন্ট্রি করা হলো তখন পুরো বিষয়টাকেই বেশ বাস্তবধর্মী আর উপভোগ্য মনে হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রদ্বয়ের মতো পাঠকের ভেতরও তখন অপার বিস্ময় আর কৌতূহলের ঢেউ অবলীলায় খেলা করে যায়। খেলা করে যায় এক অন্যরকম শিহরন! যেথা পুরুষ পাঠক নিজেই নির্ঝর হয়ে ওঠে আর নারী পাঠক অধরা!
পুরো উপন্যাসটিই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। কাহিনির গাথুঁনি, লেখনীর সম্মোহনী শক্তি এতই জোড়ালো যে পাঠক অবলীলায় কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ছোটোবেলায় আমরা যেমন পড়েছিলামÑ“খুকু যায় যেদিকে চাঁদ যায় সেদিকে”-এটাকেও অনেকটা তেমন মনে হবেÑকাহিনি যায় যেদিকে পাঠক যায় সেদিকে! পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রাখা সব ঔপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব হয় না; তবে কেউ কেউ পারে। ওই যে, জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেনÑসকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবিÑতেমনই সকল ঔপন্যাসিকেরই পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে না, কারো কারো থাকে। আর মোজাম্মেল হক নিয়োগী তেমনই একজন কথাসাহিত্যিক যিনি পাঠককে শুধু ধরেই রাখেন না, কাহিনির চরিত্রগুলোর দুঃখ বা আনন্দে পাঠককূলকেও বিগলিতও করে তোলেন।
সিরাজউদ্দৌলা, আলীবর্দী খান থেকে শুরু করে পুরু মোগল ইতিহাসই প্রায় উঠে এসেছে সংলাপচ্ছলে। উঠে এসেছে তাদের ভেতরের গভীর গোপনীয় দিকটিও। যেমনÑ“আওরঙ্গজেব মারা যাবার পর মোগলদের রক্ষিতা দেড় হাজার নারীকে মুক্তি দেওয়া হয়।” জাপানের কোনো এলাকাভিত্তিক অনুষ্ঠানে সে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককেই প্রধান অতিথি করা হয়ে থাকে। জাপানি তরুণী ইমিওর উপস্থিতি উপন্যাসে তেমন পরিবর্তন না ঘটাতে পারলেও নতুন কমেডি তৈরিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
উপন্যাসের অলিতেগলিতে কবিতাকে কোথাও কোথাও লেখক সচেতনভাবে জুড়ে দিয়েছেন আবার কোথাও কোথাও চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে কবিতাই যুতসই হয়ে লেপটে গিয়েছে। পুরো উপন্যাসে কবিতার আধিক্য বেশি হলেও পাঠক কোথাও বোর হবে না; কেননা ভাব ও ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কবিতাগুলো অক্সিজেনের মতোই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।
শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটি পঠনপাঠনে পাঠকের কাছে কখনো মনে হবে সাহিত্যস¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর প্যাটার্ন; আবার কখনো পাঠকের কাছে মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার নিষিক্ত রস! পুরো উপন্যাসটিই কাব্যিকরসে সিক্ত।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে কাব্যময়তা মোটেই দোষের নয়, বরং গুণ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বাংলা সাহিত্যের তিন সেরা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের লেখনিতে কাব্যময়তা মোটেও অস্বীকার করা যায় না। কাব্যময়তার বিশেষ প্রভাব পড়েছে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসে। কেউ কেউ তো আবার এই উপন্যাসকে মহাকাব্য বলেও স্বীকার করে নেন। বাংলাসাহিত্যের কিছু কালজয়ী উপন্যাসের মধ্যে নিঃসন্দেহে পথের পাঁচালী অন্যতম। কাব্যময়তা নিয়ে যদি এটি কালজয়ী হতে পারে তবে এটা বলা য়ায় কাব্যময়তা উপন্যাসের জন্য মোটেও অবাঞ্ছিত বা অপ্রয়োজনীয় কোনো বিষয় নয়। এটাও একধরনের অলংকরণ।
শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাস পঠনপাঠনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবি-সাহিত্যিক-লেখক এবং তাঁদের বইয়ের নামও উঠে এসেছে। যেমন : আলবেয়ার কাম্যু’র আউসাইডার, তামিল কবি ইউভি সামিনাথ আইয়ার এর পাথনামিত্তা, বালী’র আম্মা, আন্নামালয়ী রেড্ডিয়ার কাবাদিসিন্ধ, বেইরামুথুর ভারতী, আইনস্টাইনের থিউরি অব রিলিটিভিটি প্রভৃতি।
কোনো কোনো উপন্যাসই হয়ে ওঠে চরিত্রপ্রধান, কোনোটিবা ইতিহাসপ্রধান, আবার কোনটি হয় প্লট বা কাহিনি প্রধান, আবার কখনো কখনো সংলাপপ্রধানও হতে পারে। তবে যেকোনো উপন্যাসেই প্রধান চরিত্রগুলোর উপস্থিতিরি গড় সময় অন্যান্যের তুলনায় একটু বেশি থাকই বাঞ্ছনীয়। শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটিতে কুয়াশার চাদরে মোড়া একটুকরো সূর্যের আলোর মতোই একবারমাত্র সুহানার উপস্থিতি লক্ষ করা গেল। উপন্যাসটিতে অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে সুহানার প্রতি পাঠকহৃদয়ের সহানুভূতি জন্ম নেওয়ার আগেই চরিত্রটি হঠাৎ করেই যেনো উধাও হয়ে গেল। এই চরিত্রটির উপস্থিতির পরিমাণ বাড়ালে দ্বৈরথের টানাপোড়েনের নির্যাসে উপন্যাসও যেমন হতে পারত আরও ব্যঞ্জনাধর্মী তেমনই পাঠকহৃদয়ও বিগলিত হতো। আশা-আকাক্সক্ষার চাদর মুড়িয়ে, হৃদয়কে আবেগের ভেলায় ভাসিয়ে পাঠকহৃদয় তখন অবলীলায় পাড়ি দিত কাহিনির শেষপ্রান্তে। এমনকী তখন উপন্যাসটিও পেত ভিন্নধর্মী মাত্রা।
মানিক, তারাশঙ্কর এবং বিভূতিভূষণÑএই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁদের সৃষ্টিশীল লেখনীর নৈপুণ্য দিয়ে। এঁদের লেখনীর বেইজও প্রায় এক। কাহিনিগুলোকে জীবন্ত করে তুলার জন্য অঞ্চলবিশেষের মানুষের সত্যিকার ভাষাটাই চরিত্রের মুখে সেঁটে দিতেন। ফলে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে তখন মনে হয় হাজার বছরের পরিচিত! ভাষাচয়নকেও মনে হয় আমাদের কিংবা আমাদের প্রতিবেশির। কাহিনির বুনন এবং ভাষার যথাযথ প্রয়োগে মোজাম্মেল হক নিয়োগী এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কোনো অংশেই কম নয়। বরং তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছেÑতাঁর উপন্যাসগুলো যেনো আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ, আরও বেশি জীবন্ত।
প্রতিটি পাঠকই যখন পত্রিকা কেনে তখন সে পুরো পত্রিকা কখনোই পড়ে না। পড়ে তার ভালোলাগার অংশটি। সাহিত্যমোদী হলে সাহিত্য অংশ, ক্রীড়ামোদী হলে ক্রীড়া অংশ, সংস্কৃতি ঘেঁষা হলে চিত্রবিনোদন, রাজনীতিবিদ হলে রাজনৈতিক সংবাদের পাতা প্রভৃতি। অর্থাৎ পাঠকের রুচিভেদে পত্রিকার পাতাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। ঠিক তেমনই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও কেউবা কাহিনির ঘনঘটায় মুগ্ধ হয়, আবার কেউবা খুঁজে ফেরে দার্শনিক পদবাচ্য তথা বুলেট বাক্য, আবার কেউবা খুঁজে ফেরে সমন্বিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের রসদ, আবার কেউবা খুঁজে ফেরে যৌনঘেঁষা বিনোদন। কাজেই এ ক্ষেত্রেও বলা যায় পাঠকভেদেও উপন্যাসের নির্যাস আস্বাদনেরও ভিন্নতা রয়েছে। তবে বুলেটবাক্য যেকোনো উপন্যাসেই পাঠককে কিছুটা হলেও ছুঁয়ে যায়। কিছু বুলেট বাক্য শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটিতে সত্যিকার অর্থেই সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা। যেমন :
* পৃথিবীটা ঘুরে দেখাই মানে হচ্ছে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করা।
* শরীরের রসায়নেই প্রেম হয়। প্রেম হয় শরীর থেকে মন থেকে নয়।
* পৃথিবীর সব মানুষই যেন না পড়া বইয়ের পাতা।
* কবিতা আসলে প্রকৃতি দেখে হয় না। কবিতা হয় বুকের ভেতর থেকে। রোদেও বৃষ্টির কবিতা লেখা যায়।
* অবহেলা অপমানজনক।
*মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কঠিন কাজ করানো যায় কিন্ত ধমক দিয়ে অনেক সহজ কাজও করানো যায় না।
*অধরাকে ভালো লেগেছে একটা শরতের সকালের চেয়ে হাজার গুণ বেশি।
* যে মানুষের ভালোবাসার বিস্তৃতি যত বেশি সে তত সুখী।
* এতটুকু স্পর্শেই আমার আঙিনার সাদা ঘাসেরা সবুজ হয়ে গেছে।
বিশ্ববিখ্যাত গল্পকার অ্যাডগার এলান পো তাঁর গল্পগুলোতে নতুননত্ব হিসেবে নিয়ে আসেন অতিভৌতিক বা অতিরহস্যজনক থিম। অবশ্য তাঁর গল্পের প্যাটার্নই তাঁর নিজের মতো করে সাজানো। বাংলা কথাসাহিত্যের নির্লিপ্ত স¤্রাট মোজাম্মেল হক নিয়োগী’র উপন্যাসের গাঁথুনিতেও দেখা যায়Ñসমাজের অতিবাস্তব চিত্রের সন্নিবেশ। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি বা কাহিনির ঘনঘটার দিকে চোখ বুলালে দর্পণের মতো পাঠকের চোখে ভেসে ওঠে সমাজের ঘটমান প্রতিচ্ছবি। যে ছবিগুলোর ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উপহাস। কথাসাহিত্যিক মূলত সমাজের ছবিই নিখুঁতভাবে আঁকতে চেয়েছেন তাঁর উপন্যাসে। নিজের মতো করেই সাজিয়েছেন তাঁর গল্পের বীজতলা। উপন্যাসের প্লট, ভাব-ভাষা, কথার গাঁথুনি, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সময়ের ঐক্য, ঘটনার পরম্পরা থেকে শুরু করে ঘটনার ঘনঘটায় রস সৃষ্টি তথা আবেগ সৃষ্টি ও কাহিনি গভীর থেকে গভীরতর করে তুলতে কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর জুড়ি মেলা ভার।
একজন কথাসাহিত্যিক যত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন ততই নির্ভুল হতে থাকে তাঁর শিল্পকর্র্ম। মোজাম্মেল হক নিয়োগীর শৈল্পিক কাজগুলো দেখলেই উপলব্ধি করা যায় তিনি কী পরিমাণ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। সাহিত্যসাধনায় এমন দরদমাখা কাজ খুব একটা চোখে পড়ে না বললেই চলে। আর এ কারণে এটা বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না যে, তাঁর নিষ্ঠাবান সাহিত্যকর্ম ত্রয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রকরণ যদি উপন্যাস বিচারের মাপকাঠি হয় তবে নিঃসন্দেহে ত্রয়ী উপন্যাসটি প্রশংসার দাবি রাখে। মোজাম্মেল হক নিয়োগী তাঁর উপন্যাসে গদ্য এবং পদ্যের মিশেলে নতুন রসায়নের সৃষ্টি করেছেন। এবং বিষয়বস্তুর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনায় উপন্যাসের প্যাটার্নকে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ করেছেন। শৈল্পিক ছোঁয়ার কথা না-হয় নাই বা বললাম! ভাষার সরলীকরণের কারণেও তিনি পাঠক হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছুবেন বলে আমার বিশ্বাস।
