শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন: প্রাচীন বাংলার পাঠশালা থেকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়


শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন: প্রাচীন বাংলার পাঠশালা থেকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শতাব্দীর দীর্ঘ ইতিহাসে নানা পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। প্রাচীন বাংলার গ্রাম্য পাঠশালা, মাদ্রাসা, কলেজ, এবং আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার বিবর্তন একটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। শিক্ষা কেবল জ্ঞান আহরণের মাধ্যম নয়, বরং সমাজ গঠনের, মূল্যবোধের ও সংস্কৃতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

১. প্রাচীন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা

প্রাচীন বাংলায় শিক্ষার মূল কেন্দ্র ছিল গ্রাম্য পাঠশালা। এখানে সাধারণত মৌলিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, সাহিত্য এবং গণিতের প্রাথমিক শিক্ষা পাঠশালায় দেওয়া হতো।

(ক) বৌদ্ধ ও হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

পাল ও সেন যুগে বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন নালন্দা ও বিক্রমশিলা প্রভাবশালী ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দর্শন, বৌদ্ধ ধর্ম, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সাহিত্য ও গণিত শিক্ষা দেওয়া হতো। হিন্দু মহাবিদ্যালয় ও মঠগুলিও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। শিক্ষার্থীরা স্থানীয় ও দূরদূরান্তের স্থান থেকে আগমন করত।

(খ) শিক্ষার সামাজিক প্রভাব

প্রাচীন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে শ্রেণি ও ধর্মের ভিত্তিতে সংগঠিত হলেও, শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক ও ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধি পেত। গ্রামীণ সমাজে পণ্ডিতরা শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে নেতৃত্ব দিত।

২. মধ্যযুগীয় বাংলায় শিক্ষা

মুসলিম শাসনামলে শিক্ষার ধরণ পরিবর্তিত হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন বৃদ্ধি পায়। কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা মাদ্রাসার মূল বিষয়।

(ক) মাদ্রাসার ভূমিকা

মুসলিম সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব তৈরি হতো। শাসক ও জমিদাররা শিক্ষাকে সমর্থন করতেন।

(খ) সাহিত্য ও ভাষা

ফারসি ও আরবি শিক্ষার সঙ্গে সাহিত্য ও প্রাচীন বাংলার সাহিত্যও বিকশিত হয়। কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধের মাধ্যমে সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটে।

৩. ব্রিটিশ শাসনের সময়

ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার আধুনিকীকরণ শুরু হয়। ১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে ম্যাককালে নির্দেশিকা (1835) শিক্ষার পুনর্গঠন ও ইংরেজি মাধ্যমিক শিক্ষার সূচনা করে।

(ক) আধুনিক স্কুল ও কলেজ

কলেজ ও স্কুলের মাধ্যমে গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস ও ভৌগোলিক শিক্ষা প্রচলিত হয়। ঢাকা, কলকাতা ও চট্টগ্রামে কলেজ স্থাপিত হয়।

(খ) সামাজিক প্রভাব

শিক্ষার আধুনিকীকরণ নতুন সমাজচেতনা ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। উদারমানবিক চিন্তাধারা, নারীর শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারে নতুন আন্দোলন শুরু হয়।

৪. পাকিস্তান যুগ (১৯৪৭–১৯৭১)

বাংলাদেশের পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার সংমিশ্রণ ঘটে।

(ক) বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশে শিক্ষার আধুনিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিজ্ঞান, সাহিত্য, আইন, চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষার প্রসার ঘটে।

(খ) চ্যালেঞ্জ

শিক্ষার অভ্যন্তরীণ বিভাজন, রাজনৈতিক সংকট এবং ভাষা আন্দোলনের প্রভাব শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে। শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হয়।

৫. মুক্তিযুদ্ধোত্তর শিক্ষা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠিত হয়। শিক্ষা নীতি ১৯৭৪, ১৯৭৮ এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং প্রসারের জন্য নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে।

(ক) প্রাথমিক শিক্ষা

গ্রাম্য পাঠশালা ও সরকারি বিদ্যালয়গুলোর সম্প্রসারণ ঘটে। শিক্ষার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে।

(খ) মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা

উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের প্রবর্তন ঘটে।

(গ) নারীর শিক্ষা

নারী শিক্ষার প্রসার, বালিকা বিদ্যালয়, বৃত্তি ও নারীর জন্য বিশেষ শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়।

৬. আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি শিক্ষা

বর্তমান বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের আধুনিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করছে।

(ক) প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান

কম্পিউটার বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, তথ্যপ্রযুক্তি, উদ্ভাবনী গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।

(খ) গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গবেষণা প্রকল্প এবং শিক্ষার্থীর মান উন্নয়নে কাজ করছে।

৭. সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ

শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের সত্ত্বেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

  • গুণগত মানের বৈষম্য
  • গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষার মধ্যে ফারাক
  • শিক্ষকের অভাব ও প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা
  • উচ্চশিক্ষায় গবেষণার সীমাবদ্ধতা

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকারের নীতি, এনজিও উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা প্রাচীন পাঠশালা থেকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মধ্যযুগীয় মাদ্রাসা, ব্রিটিশকালের আধুনিক স্কুল ও কলেজ এবং আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শিক্ষার অগ্রগতি প্রদর্শন করে।

শিক্ষা শুধু জ্ঞান আহরণের মাধ্যম নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যতে আরও সমন্বিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সমানাধিকার ভিত্তিক হয়ে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।





Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *