📖 শাহেদ আলী : জীবন ও কর্ম
ভূমিকা
শাহেদ আলী (২৬ মে ১৯২৫ – ৬ নভেম্বর ২০০১) একজন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক। তিনি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একজন সাহসী ভাষাসৈনিক। তাঁর সাহিত্যকর্ম, গবেষণা, অনুবাদ এবং সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি ইসলামিক চিন্তা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্যে সমানভাবে অবদান রেখেছেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
শাহেদ আলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৫ সালের ২৬ মে, বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবং ১৯৪৭ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন
শাহেদ আলী ১৯৫১ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
শাহেদ আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইসলামিক একাডেমী) প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সঙ্কলন বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাংবাদিকতা পেশায়ও সক্রিয় ছিলেন; ১৯৪৪-৪৬ সালে মাসিক প্রভাতি, ১৯৪৮-৫০ সালে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক বুনিয়াদ, ১৯৫৬ সালে দৈনিক মিল্লাত সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া শিশু মাসিক সবুজ পাতা সম্পাদনায় দীর্ঘকাল নিযুক্ত ছিলেন।
শাহেদ আলী বাংলা একাডেমীর পত্রিকা ও ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন এবং তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সাহিত্যকর্ম
গল্পগ্রন্থ:
- জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩)
- একই সমতলে (১৯৬৩)
- শা’নযর (১৯৮৫)
- অতীত রাতের কাহিনী (১৯৮৬)
- অমর কাহিনী (১৯৮৭)
- নতুন জমিদার (১৯৯২)
- শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প
- শাহেদ আলীর নির্বাচিত গল্প
উপন্যাস:
- হৃদয় নদী
- কাদা মাটির সাতকাহন
- আত্মসমর্পণ
প্রবন্ধ ও গবেষণা:
- একমাত্র পথ (১৯৪৬)
- তরুণ মুসলিমের ভূমিকা (১৯৪৬)
- ফিলিস্তীনে রুশ ভূমিকা (১৯৪৮)
- সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া (১৯৫০)
- তরুণের সমস্যা (১৯৬০)
- বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান (১৯৬৫)
- তাওহীদ (১৯৬৫)
- ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা (১৯৭০)
- Economics Order Of Islam (১৯৭৮)
- জীবন নিরবচ্ছিন্ন (১৯৮০)
- Islam in Bangladesh (১৯৮১)
- জীবনদৃষ্টি, বিপর্যয়ের হেতু, অন্যরকম আমেরিকা
শিশুতোষ:
- রুহীর প্রথম পাঠ (১৯৮০)
- ছোটদের ইমাম আবু হানিফা (১৯৮০)
- সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ (১৯৯২)
নাটিকা:
- বিচার
আত্মজীবনী:
- জীবনকথা
অনুবাদ:
- মক্কার পথ (১৯৯৩, মূল: মুহাম্মাদ আসাদ)
- ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি (১৯৬৬, মূল: আল্লামা আসাদ)
- আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ (মূল: কে বি এইচ কোনান্ট)
- ইতিবৃত্ত (১৯৯৪, মূল: হিরোডাটাস)
- ককেশাসের মহানায়ক (মূল: ইমাম শামেলি)
স্বীকৃতি ও পুরস্কার
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪)
- ভাষা আন্দোলন পদক (১৯৮১)
- নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫)
- লায়ন ক্লাব পদক (১৯৯২)
- ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৬)
- একুশে পদক (১৯৮৯)
- দুবাই সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২)
- ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭)
- রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮)
- কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার
- জাসাস স্বর্ণপদক (২০০০)
- তমদ্দুন মজলিস মাতৃভাষা পদক (২০০০)
- কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর, ২০০৩)
- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কার
মৃত্যু
বহুমুখী প্রতিভার অধিকার অধ্যাপক শাহেদ আলী ৬ নভেম্বর ২০০১ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্য, ইসলামী চিন্তাভাবনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে চিরস্মরণীয়।
উপসংহার
শাহেদ আলী ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। তার সাহিত্যকর্ম, অনুবাদ, প্রবন্ধ এবং শিশুতোষ লেখনী বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইসলামী চিন্তায় চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
