📖 শাহাদুজ্জামান : জীবন ও সাহিত্য
ভূমিকা
বাংলাদেশের সমকালীন কথাসাহিত্যে একটি উজ্জ্বল নাম শাহাদুজ্জামান (জন্ম: ১৯৬০)। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, ভ্রমণলেখক ও অনুবাদক। যদিও মূলত ছোটগল্প ও উপন্যাস তাঁর প্রধান সাহিত্যক্ষেত্র, তবুও প্রবন্ধ, অনুবাদ, চলচ্চিত্রবিষয়ক রচনা এবং গবেষণায়ও তিনি সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে রয়েছে নান্দনিক বর্ণনা, গভীর মানবিক বোধ এবং সমকালীন সমাজ-রাজনীতির তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ। ২০১৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
শাহাদুজ্জামানের জন্ম ১৯৬০ সালে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং কিছু সময় ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।
পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। চিকিৎসা, নৃবিজ্ঞান ও সাহিত্য তাঁর কর্মজীবনে একটি অনন্য সমন্বয় তৈরি করেছে।
কর্মজীবন
দীর্ঘ সময় ধরে শাহাদুজ্জামান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন। তাঁর কর্মজীবন চিকিৎসা, গবেষণা এবং সাহিত্য—তিন ক্ষেত্রেই সমানভাবে সমৃদ্ধ।
সাহিত্যজীবন
শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ছোটগল্পের মাধ্যমে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ কয়েকটি বিহ্বল গল্প (১৯৯৬) মাওলা ব্রাদার্স আয়োজিত কথাসাহিত্যের পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ ও অনুবাদ সাহিত্যে অবদান রাখতে থাকেন।
উল্লেখযোগ্য রচনা
উপন্যাস
- ক্রাচের কর্নেল (২০০৯)
- খাকি চত্বরের খোয়ারি (২০১৩)
- বিসর্গতে দুঃখ (২০১৩)
- আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে (২০১৪)
- একজন কমলালেবু (২০১৭)
ছোটগল্প সংকলন
- কয়েকটি বিহ্বল গল্প (১৯৯৬)
- পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ (১৯৯৯)
- ইব্রাহিম বুখ’স সার্কাস অ্যান্ড আদার্স স্টোরিস (২০০৮)
- কেশের আড়ে পাহাড় (২০১২)
- অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প (২০১৪)
- মামলার সাক্ষী ময়না পাখি (২০১৯)
প্রবন্ধ
- চিরকুট (২০১১)
- লেখালেখি (২০১১)
- শাহবাগ ২০১৩ (২০১৪)
- বায়োস্কোপ চলচ্চিত্র প্রভৃতি (২০১৫)
- ইলিয়াসের সুন্দরবন এবং অন্যান্য (২০১৭)
- গুগল গুরু (২০১৯)
- আমার দীপেশ আবিষ্কার (২০২০)
- মহামারি মহাকাল (২০২২)
গবেষণা
- একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়
- টুকরো ভাবনা (২০১৩)
- ব্রোকেন লিম্বাস ব্রোকেন লাইভস: এথনোগ্রাফি অব আ হসপিটাল ওয়ার্ড ইন বাংলাদেশ (২০১৭)
ভ্রমণ
- আমস্টারডাম ডায়েরি এবং অন্যান্য (২০১১)
অনুবাদ
- ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন এবং অন্যান্য অনুবাদ গল্প
- ভাষান্তরসমগ্র (২০১৬)
সম্পাদনা ও গ্রন্থনা
- মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস (২০২২, খায়রুল ইসলামের সঙ্গে)
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরি (২০১৩)
- দেখা না-দেখার চোখ (২০১৫)
চলচ্চিত্রে অভিযোজন
শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যকর্ম চলচ্চিত্রেও প্রভাব ফেলেছে। তাঁর রচিত “মৌলিক” ও “সাইপ্রাস” গল্পের ভিত্তিতে নির্মিত হয় কমলা রকেট (২০১৮) চলচ্চিত্র, যা সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসা পায়।
সংকলন
- শাহাদুজ্জামানের গল্প, অগল্প, না-গল্প সংগ্রহ (২০০৯)
- কাগজের নৌকায় আগুনের নদী (২০১৫)
- নির্বাচিত গল্প (২০১৬)
- নির্বাচিত কলাম (২০১৯)
- শাহাদুজ্জামান রচনাসংগ্রহ (২০২০–২০২৩) – একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
- মাওলা ব্রাদার্স কথাসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬) – কয়েকটি বিহ্বল গল্প এর জন্য
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬) – ক্রাচের কর্নেল এর জন্য
- সিটি ব্যাংক আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) – মামলার সাক্ষী ময়না পাখি এর জন্য
- প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪২৫ (২০২০) – মামলার সাক্ষী ময়না পাখি এর জন্য
সাহিত্য বিশ্লেষণ
শাহাদুজ্জামানের গল্প ও উপন্যাসে বাস্তবতা, রাজনীতি ও ইতিহাসের সুনিপুণ মিশ্রণ দেখা যায়। তাঁর ভাষা সহজ অথচ গভীর, চরিত্রগুলো জীবন্ত এবং ঘটনাপ্রবাহে রয়েছে সমাজ-মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম চিত্রণ। গবেষণাভিত্তিক লেখাগুলো তথ্যনিষ্ঠ হলেও সাহিত্যিক ভঙ্গি বজায় রাখে।
উপসংহার
শাহাদুজ্জামান কেবল একজন সাহিত্যিক নন, তিনি গবেষক, প্রাবন্ধিক এবং চিকিৎসা-নৃবিজ্ঞানীও। তাঁর সাহিত্যকর্ম সমকালীন বাংলাদেশি সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ধারণ করেছে। ছোটগল্প, উপন্যাস, গবেষণা, প্রবন্ধ ও ভ্রমণলেখা—সব ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি হয়ে থাকবেন সমকালীন সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ দিকপাল।