লুই পাস্তুর : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ
ভূমিকা
“বিজ্ঞান মানবকল্যাণের হাতিয়ার”—এই সত্যকে যাঁরা কাজে রূপ দিয়েছেন, লুই পাস্তুর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ফরাসি জীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) ছিলেন একজন জীবাণুবিদ্যার জনক, পাস্তুরিকরণ প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক, এবং টিকা উদ্ভাবনের পথিকৃৎ।
তাঁর গবেষণা শুধু বৈজ্ঞানিক জগতে নয়, কৃষি, শিল্প এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী হয়েও মানবতাবাদী।
জন্ম ও শৈশব
লুই পাস্তুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ফ্রান্সের ডোল নামক ছোট শহরে। তাঁর বাবা জাঁ জোসেফ পাস্তুর ছিলেন একজন ট্যানার (চামড়া প্রক্রিয়াজনকারী)। ছোটবেলা থেকেই লুই ছিলেন শান্ত, শিল্পপ্রিয় এবং পর্যবেক্ষণক্ষম।
তিনি খুব ভালো আঁকতে পারতেন, এবং শৈশবে তাঁর শিক্ষকরা ভাবতেন তিনি হয়তো একজন চিত্রশিল্পী হবেন। কিন্তু লুইয়ের ধ্যান-ধারণা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের দিকে গড়ে উঠতে থাকে।
শিক্ষাজীবন
তিনি প্রথমে আরবোয়া ও পরে প্যারিসে অধ্যয়ন করেন। শুরুতে একাডেমিকভাবে খুব উজ্জ্বল না হলেও পরিশ্রম ও আগ্রহের মাধ্যমে তিনি দ্রুত উন্নতি করেন।
১৮৪৭ সালে তিনি École Normale Supérieure থেকে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি স্ট্রাসবুর্গ ও লিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন।
প্রাথমিক গবেষণা : অপটিক্যাল আইসোমারিজম
পাস্তুরের প্রথম উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল ক্রিস্টাল ও অপটিক্যাল আইসোমারিজম বিষয়ে। তিনি দেখান যে কিছু জৈব যৌগে আলোর বাম ও ডানমুখী প্রতিফলন ঘটে, যার পেছনে আছে আণবিক গঠনের ভিন্নতা।
এই পর্যবেক্ষণ রসায়নে স্টেরিওকেমিস্ট্রি নামক নতুন শাখার ভিত্তি স্থাপন করে।
জীবাণুবিদ্যার (Microbiology) জনক হিসেবে উত্থান
পাস্তুরের সবচেয়ে বড় অবদান জীবাণুবিদ্যার বিকাশে।
১৮৫৭ সাল থেকে তিনি জীবাণু সংক্রান্ত গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সেই সময় ধারণা ছিল—রোগ ও পচনের কারণ হলো “স্বতঃস্ফূর্ত উৎপত্তি” বা ‘Spontaneous Generation’। অর্থাৎ, জীবাণু বা জীব স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্ম নেয়।
● Spontaneous Generation-এর বিরুদ্ধে প্রমাণ
পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত হাঁসের ঘাড়বিশিষ্ট ফ্লাস্ক (swan-neck flask) পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন:
বায়ুতে জীবাণু থাকে, এবং জীবাণু ছাড়া কোন কিছুতেই জীবের উৎপত্তি হয় না।
এই পরীক্ষা জীবাণুতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে এবং বহু কুসংস্কার ও ভুল বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা ভেঙে দেয়।
পাস্তুরিকরণ প্রক্রিয়া (Pasteurization)
শুধু জীবাণু আবিষ্কার করেই পাস্তুর থেমে থাকেননি, বরং জীবাণুর ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধেরও পথ দেখান।
তিনি লক্ষ্য করেন—দুধ, মদ ও অন্যান্য তরল খাবার কিছুদিন পর নষ্ট হয়ে যায়, যার পেছনে দায়ী ব্যাকটেরিয়া।
● সমাধান:
তিনি আবিষ্কার করেন, তরলকে কম তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় গরম করলে ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু স্বাদ ও গুণাবলি নষ্ট হয় না। এই প্রক্রিয়ার নাম হয়—
🔹 Pasteurization
আজও বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ নিরাপদ দুধ ও পানীয় গ্রহণ করে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
নিচে “লুই পাস্তুর : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ” প্রবন্ধের দ্বিতীয় ও শেষ অংশ উপস্থাপন করা হলো। এতে আলোচিত হয়েছে—রোগ প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার, জলাতঙ্ক চিকিৎসা, পাস্তুর ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা, মৃত্যু ও বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার।
রোগ প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার
লুই পাস্তুর জীবাণুবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধেও এক বৈপ্লবিক যুগের সূচনা করেন। তিনি দেখান—ব্যাকটেরিয়া দুর্বল করে শরীরে প্রবেশ করালে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, যা ভবিষ্যতে রোগ প্রতিরোধ করে।
● পাখির কলেরা (Cholera in chicken)
পাস্তুর প্রথম পরীক্ষায় দেখেন—দীর্ঘদিন সংরক্ষিত (দুর্বল) জীবাণু দিয়ে ইনফেকশন করালে মুরগি অসুস্থ হয় না, বরং ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী জীবাণু দিয়েও আক্রান্ত হয় না। এখান থেকেই তিনি টিকা তৈরির ভিত্তি আবিষ্কার করেন।
জলাতঙ্ক (Rabies) চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্য
লুই পাস্তুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও মানবিক অবদান ছিল জলাতঙ্ক রোগের টিকা উদ্ভাবন।
তৎকালীন সময়ে জলাতঙ্ক ছিল প্রায় অব্যর্থ মৃত্যুদণ্ডের নাম। কারণ এ রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। পাস্তুর মৃতপ্রায় কুকুরের মস্তিষ্ক থেকে ভাইরাস সংগ্রহ করে তা দুর্বল করেন এবং প্রথমবার মানুষের দেহে প্রয়োগ করেন।
● ইতিহাসের এক মুহূর্ত:
১৮৮৫ সালে, ৯ বছর বয়সী জোসেফ মাইস্টার নামে একটি বালক জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলে পাস্তুর তাঁর ওপর টিকা প্রয়োগ করেন।
ফলাফল: ছেলেটি সুস্থ হয়ে ওঠে। এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে এবং পাস্তুর একজন জাতীয় বীর হয়ে ওঠেন।
পাস্তুর ইনস্টিটিউট : বিজ্ঞান ও চিকিৎসার কেন্দ্র
পাস্তুরের সফলতা দেখে ফরাসি সরকার এবং সমাজে সচেতন মানুষ উদ্যোগ নিয়ে ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন—“Institut Pasteur”।
এই গবেষণা কেন্দ্র:
- সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করে
- টিকা তৈরি করে
- বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ দেয়
আজও বিশ্বের বহু দেশে এই ইনস্টিটিউটের শাখা রয়েছে, যারা স্বাস্থ্যসেবায় নিরলস কাজ করে চলেছে।
নৈতিকতা ও মানবতাবাদী বিজ্ঞানচর্চা
লুই পাস্তুর ছিলেন কেবল বিজ্ঞানী নন, তিনি ছিলেন এক নৈতিক গবেষক ও মানবসেবী। তিনি কখনও পেটেন্ট নেননি তাঁর আবিষ্কারের জন্য। বরং বলেন:
“আমি চাই আমার আবিষ্কার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকুক।”
তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ, কিন্তু কখনও অন্ধবিশ্বাসে আস্থা রাখেননি। তাঁর গবেষণায় যুক্তি, পরীক্ষা ও মানবকল্যাণ ছিল মূল চালিকা শক্তি।
মৃত্যুবরণ ও বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার
লুই পাস্তুর ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের নিচে সমাহিত করা হয়।
তাঁর জীবন ও কর্ম এতই মূল্যবান ছিল যে মৃত্যুর পরে বহু দেশে তাঁর নামে রাস্তা, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
মূল্যায়ন ও প্রভাব
● জীবাণুবিদ্যার জনক
তিনি প্রমাণ করেছেন—রোগের পেছনে থাকে জীবাণু, আর তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
● চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব
টিকা, পাস্তুরিকরণ, রোগ প্রতিরোধ—সবকিছুতেই পাস্তুর অগ্রপথিক।
● মানবিক বিজ্ঞানচর্চা
তাঁর গবেষণা শুধুই একাডেমিক ছিল না, ছিল মানবকল্যাণকেন্দ্রিক। তিনি বারবার বলেছেন:
“Science knows no country, because knowledge belongs to humanity.”
উপসংহার
লুই পাস্তুর ছিলেন এক অনন্য বিজ্ঞানী, যিনি রোগ, ব্যাকটেরিয়া ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক ও মানবিক সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন। তাঁর আবিষ্কার কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে এবং এখনো করছে।
তিনি দেখিয়ে গেছেন—বিজ্ঞান শুধু তত্ত্ব নয়, বরং কর্মের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণে প্রয়োগযোগ্য। তাই আজও যখন আমরা দুধ পান করি, টিকা নিই, কিংবা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করি—সেই প্রতিটি ক্ষেত্রে লুই পাস্তুরের বিজ্ঞান প্রতিফলিত হয়।
https://www.munshiacademy.com/লুই-পাস্তুর-আবিষ্কার-ও-কর/