মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমর গবেষক

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (২২ জুলাই ১৯২৬ – ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও মননশীল বুদ্ধিজীবী। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গভীর গবেষক ছিলেন এবং বাংলা শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী আল-বদর বাহিনীর হাতে শহীদ হন। তার জীবন ও কর্ম আজও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য প্রেরণার উৎস।
প্রারম্ভিক জীবন ও পারিবারিক পটভূমি
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বজলুর রহমান চৌধুরী এবং মা মাহফুজা খাতুন ছিলেন। পিতৃবিয়োগে তিনি মাত্র নয় বছর বয়সে শৈশব হারান। পরিবারের সম্পত্তি রক্ষা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে তার মায়ের দৃঢ় মনোবল তাকে পড়াশোনায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। মোফাজ্জলের দুই ছোট ভাই – এহতেশাম হায়দার ও লুতফুল হায়দার এবং ছোট বোন রওশন আখতার রাজিয়া শিক্ষাজীবনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৬ সালে সৈয়দা তাহমিনা মনোয়ারা নুরুন্নাহারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের দুই পুত্রসন্তান – সুমন (১৯৬৪) ও শোভন (১৯৬৭) জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা ও প্রাথমিক কর্মজীবন
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা নোয়াখালীর আহমদিয়া হাই ইংলিশ স্কুলে সম্পন্ন হয়। মেধা তালিকায় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা তিনি ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তার উচ্চতর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে, যেখানে তিনি বাংলায় (সম্মান) ভর্তি হন। পরে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ইংরেজি অনার্স পড়া শুরু করলেও, বাংলা ভাষার প্রতি তার গভীর আগ্রহ তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসে।
১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় নন-কলেজিয়েট হিসেবে অংশগ্রহণ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। তার এই সাফল্যের জন্য তাকে ‘সুরেন্দ্রনলিনী স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে ‘সার আশুতোষ গোল্ড মেডেল’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
১৯৪৭ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-ভবনের বৃত্তি লাভ করেন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে “সাহিত্যভারতী” উপাধি অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
পেশাগত জীবন ও গবেষণা
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তার কর্মজীবন শুরু করেন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে পাণ্ডুলিপি রচয়িতা হিসেবে। ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং একই সঙ্গে সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজেও খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এবং আফ্রিকান স্টাডিজ-এ ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি লাভ করেন। সেখানে দুই বছর গবেষণা করে কথ্য বাংলার শব্দ ও ছন্দোবিজ্ঞানের উপর অভিসন্দর্ভ তৈরি করেন। যদিও তখনকার মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানের প্রভাবের কারণে এটি প্রকাশ করা হয়নি, স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমি থেকে এটি প্রকাশিত হয়।
তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য, বাংলা ভাষা ও বানান সংস্কার, এবং কথ্য বাংলার ফনোলজি। তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থসমূহে বাংলা শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- Some Supra-Segmental Phonological Features of Bengali (১৯৫৯)
- Colloquial Bengali (১৯৬৩ ও ১৯৬৬)
- বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার (১৯৬২)
- রবি পরিক্রমা (১৯৬৩)
- সাহিত্যের নব রূপায়ণ (১৯৬৯)
- রঙীন আখর (১৯৬৩)
১৯৭১ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকের দিনে, পাকিস্তানি সেনা ও আল-বদর বাহিনী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে তার বাসা থেকে অপহরণ করে। এরপর তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয় ঐ দিনই তাকে হত্যা করা হয়।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১) লাভ করেন। ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার মরণোত্তর প্রদান করা হয়।
উপসংহার
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন একজন অনন্য মননশীল ব্যক্তিত্ব। তার গবেষণা, সাহিত্যচর্চা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় অবদান আজও বাংলা ভাষা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার জন্য তার আত্মত্যাগ তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রেখেছে।