মেঘনাদ সাহা : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ
ভূমিকা
ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞানচর্চায় যে কজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মেঘনাদ সাহা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রযুক্তি চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সংসদ সদস্য। তাঁর গবেষণা তাপ-আয়ন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব এনেছিল।
📌 সাহা আয়নিকরণ সূত্র (Saha Ionization Equation) আজও তারিখ পরিবর্তন ছাড়াই বিশ্বজুড়ে জ্যোতির্বিদরা ব্যবহার করছেন।
জন্ম ও শৈশব
মেঘনাদ সাহার জন্ম ৬ অক্টোবর ১৮৯৩ সালে, ব্রিটিশ ভারতের ঢাকার কালিয়া গ্রামে (বর্তমানে বাংলাদেশ)।
তাঁর পরিবার ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত। পিতা জগন্নাথ সাহা ছিলেন একজন মুদি দোকানি।
● শিক্ষা নিয়ে সংগ্রাম:
- সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তান হওয়ায় অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়
- তবুও তিনি প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এগিয়ে যান
শিক্ষাজীবন
● প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা:
- শুরু হয় কালিয়া ও ঢাকা বিদ্যালয় থেকে
- পরে পড়েন ঢাকা কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা-তে
● বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে:
- ১৯১১-১৫: প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত ও পদার্থবিদ্যায় স্নাতক
- তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যাঁর সঙ্গে তিনি অনেক যৌথ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন
📌 তিনি ছাত্রজীবনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার
গবেষণার সূচনা
মেঘনাদ সাহার গবেষণার শুরু জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল সমস্যাকে বোঝার আগ্রহ থেকে। তিনি তাপ-আয়ন, নক্ষত্রের বর্ণালি বিশ্লেষণ, এবং পরমাণুর আচরণ নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু করেন।
সাহা আয়নিকরণ সূত্র
● উদ্ভব:
১৯২০ সালে তিনি প্রকাশ করেন Saha Ionization Equation—যা তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ঐতিহাসিক অবদান।
● এটি কী ব্যাখ্যা করে?
সূত্রটি ব্যাখ্যা করে—
নক্ষত্র বা গ্যাসীয় বস্তুতে তাপমাত্রা ও চাপের ভিত্তিতে পরমাণু বা অণু আয়নিত হওয়ার মাত্রা কীভাবে নির্ধারিত হয়
📌 এই সূত্র ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কোনো নক্ষত্রের স্পেকট্রাম দেখে তার তাপমাত্রা, গঠন ও ধাতবতার পরিমাণ বুঝতে পারেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
● সাহার সূত্রের গুরুত্ব বুঝে নেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা, যেমন:
- হেনরি নরিস রাসেল
- এডিংটন
- আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন সূত্রটিকে নক্ষত্রের আভ্যন্তরীণ কাঠামো ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন
● এর ফলে:
- সাহা স্বীকৃতি পান বিশ্বব্যাপী
- ১৯২০-এর দশকে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যান
নিচে “মেঘনাদ সাহা : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ” প্রবন্ধের দ্বিতীয় ও শেষ অংশ উপস্থাপন করা হলো। এতে রয়েছে—তাঁর একাডেমিক ও রাজনৈতিক কর্মজীবন, সামাজিক চিন্তাভাবনা, প্রতিষ্ঠান গঠন, বিজ্ঞানচর্চায় নেতৃত্ব, এবং তাঁর উত্তরাধিকার ও চিরস্থায়ী প্রভাব।
অধ্যাপনা ও প্রতিষ্ঠান গঠন
● অধ্যাপনা জীবন:
মেঘনাদ সাহা শিক্ষকতা শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯১৬)। পরে তিনি আল্লাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯১৯-১৯৩৮) কাজ করেন, যেখানে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আধুনিক গবেষণার সূচনা করেন।
● গঠিত প্রতিষ্ঠান:
- Institute of Nuclear Physics (বর্তমানে Saha Institute of Nuclear Physics)
- Indian Science News Association
- “Science and Culture” নামক বিজ্ঞান পত্রিকার প্রতিষ্ঠা
- ভারতের প্রথম National Academy of Sciences (1930) প্রতিষ্ঠা
📌 সাহা বিশ্বাস করতেন, “বিজ্ঞান যদি সমাজের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, তবে তা নিছক কল্পনা মাত্র।”
সমাজচিন্তা ও বিজ্ঞান প্রসার
মেঘনাদ সাহা ছিলেন একজন বিজ্ঞান চিন্তক যিনি বিজ্ঞানকে কেবল গবেষণাগারে আটকে রাখতে চাননি। তিনি বলতেন:
“বিজ্ঞানকে আমাদের দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতা দূর করতে কাজে লাগাতে হবে।”
● তাঁর চিন্তার দিক:
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে শিল্পোন্নয়নে ব্যবহার
- নদী নিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার
- দেশের পরিকল্পনায় বিজ্ঞানীদের সক্রিয় ভূমিকা
রাজনৈতিক জীবন ও সংসদ সদস্য
মেঘনাদ সাহা সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, জাতীয়তাবাদী ও সমাজচিন্তক।
● ১৯৫২ সালে:
- প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্য হন
- স্বাধীন ভারতের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা হন
- সরকারি নীতিতে বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তক হন
অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
তিনি ছিলেন:
- ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত ও কুসংস্কারের বিরোধী
- বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের পক্ষে
- ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী সমাজগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা
📌 তিনি বহুবার বলেছিলেন—
“যে জাতি বিজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিতে জানে না, তার গন্তব্য দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা।”
আন্তর্জাতিক অবদান ও সম্মাননা
● তিনি ছিলেন:
- রাশিয়ার লোমোনোসভ পদকপ্রাপ্ত
- রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (Fellow of the Royal Society – FRS)
- বহু আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে প্রতিনিধি
● তাঁর নাম আজও জীবিত রয়েছে:
- Saha Ionization Equation
- Saha Institute of Nuclear Physics
- Saha Crater on Moon (International Astronomical Union কর্তৃক নামকরণ)
মৃত্যু
মেঘনাদ সাহা মৃত্যুবরণ করেন ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
তিনি ছিলেন সেসময়কার সংসদ সদস্য, আর মৃত্যুর দিনও তিনি যাচ্ছিলেন পার্লামেন্টে যোগ দিতে।
এটি প্রমাণ করে, তিনি আজীবন ছিলেন সক্রিয়, সংগ্রামী ও দায়বদ্ধ একজন বিজ্ঞানী।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
● মেঘনাদ সাহার অবদান তিনটি স্তরে চিরস্থায়ী:
স্তর | অবদান |
---|---|
বিজ্ঞান | আয়নিকরণ সূত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব |
শিক্ষা | পদার্থবিদ্যার আধুনিক পাঠক্রম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান |
সমাজ | বিজ্ঞানমনস্কতা, জাতীয় উন্নয়নে প্রযুক্তির প্রয়োগ |
উপসংহার
মেঘনাদ সাহা ছিলেন এমন এক বিজ্ঞানী, যিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে জাতির উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন— সত্যিকার বিজ্ঞানী কেবল গবেষক নন, তিনি একজন দায়িত্বশীল সমাজনেতা।
“প্রযুক্তি নয়, চিন্তা বদলায় জাতির ভবিষ্যৎ”—এই দর্শনের প্রতিচ্ছবি ছিলেন সাহা।
তাঁর আয়নিকরণ সূত্র যেমন নক্ষত্রের গঠন ব্যাখ্যা করে, তেমনি তাঁর জীবন ব্যাখ্যা করে—কীভাবে একজন সাধারণ গ্রামের ছেলে হয়ে ওঠে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের একজন।
https://www.munshiacademy.com/মেঘনাদ-সাহা-আবিষ্কার-ও-কর/