মুহ্মদ জাফর ইকবাল : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love
Muhammed_Zafar_Iqbal
Muhammed_Zafar_Iqbal

🌟 মুহম্মদ জাফর ইকবাল : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

👨‍👩‍👧‍👦 জীবন ও পরিবার

মুহম্মদ জাফর ইকবাল (২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২, সিলেট) বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক, পদার্থবিদ, শিক্ষাবিদ ও মুক্তচিন্তার ধারক। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এবং মাতা আয়েশা আখতার খাতুন গৃহিণী ছিলেন। সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট পরিবারে তাঁর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং ছোট ভাই আহসান হাবীব জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট ও সাহিত্যিক।

প্রাথমিক জীবন:

১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর, পিতার কর্মস্থল সিলেটে মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্ম। তার নাম আগে ছিল বাবুল। তার পিতা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। বাবা ফয়জুর রহমান আহমদের পুলিশের চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। পিতা লেখালেখির চর্চা করতেন এবং পরিবারের এই সাহিত্যমনস্ক পরিবেশে জাফর ইকবাল খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন। তিনি তার প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন সাত বছর বয়সে। ১৯৭১ সালের ৫ মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এক নদীর ধারে তার পিতাকে গুলি করে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া জাফর ইকবালকে পিতার কবর খুঁড়ে তার মাকে স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারটি বিশ্বাস করাতে হয়েছিল।

🎓 শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন

জাফর ইকবাল ১৯৬৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে ১৯৮২ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

তিনি ১৯৮৩-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ক্যালটেক-এ পোস্টডক্টরাল গবেষক এবং পরে বেল কমিউনিকেশন রিসার্চ-এ কাজ করেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০১৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

ব্যক্তিগত জীবন

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তার বড় ভাই এবং রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদের সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট, সাহিত্যিক আহসান হাবীব তার ছোট ভাই। তার বোন তিনজন- সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ ও রুখসানা আহমেদ।

✍️ সাহিত্য কর্ম

বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ হিসেবে মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম প্রথম সারিতে। মাত্র সাত বছর বয়সে “কপোট্রনিক ভালোবাসা” নামে প্রথম গল্প লেখেন। তাঁর লেখার ধরণে বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ, কিশোরদের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমের ছাপ স্পষ্ট।

তাঁর জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে রয়েছে:
📘 দীপুর নাম্বার টু
📘 আমার বন্ধু রাশেদ
📘 আমি তপু
📘 টেলিপ্যাথি, প্যারাসাইকোলজি, বিপদ ইত্যাদি।

তাঁর লেখা কলাম ‘সাদাসিধে কথা’ প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি সমাজ, শিক্ষা ও রাজনীতি নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন।

🏅 সম্মাননা ও অবদান

  • বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০০৪
  • শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে ২০০৫ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার
  • কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক, ২০০২
  • খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক, বাংলা ১৪১০
  • শেলটেক সাহিত্য পদক ২০০৩
  • ইউরো শিশুসাহিত্য পদক ২০০৪
  • মোহা. মুদাব্বর-হুসনে আরা সাহিত্য পদক ২০০৫
  • মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা পদক ২০০৫
  • আমেরিকা অ্যালুমনি এ্যসোসিয়েশন পদক ২০০৫
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালুমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক ‘০৫
  • শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১১
  • জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পুরস্কার আজীবন সম্মাননা

⚠️ সহিংসতা ও প্রতিকূলতা

২০১৮ সালে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতার সময় তিনি হামলার শিকার হন। এছাড়া বিভিন্ন সময় ধর্মীয় মৌলবাদ, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে কথা বলায় বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে তাঁর মতামত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং কিছু বই দোকানে তাঁর বই বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিতর্ক ও সমালোচনা

২০২৩ সালে সরকারের নতুন শিক্ষা নীতি আওতায় বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। জাফর ইকবাল ৭ম শ্রেণির পাঠ্যবইসহ একাধিক নতুন পাঠ্যবইয়ের সহ-লেখক এবং প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তবে “বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ)” পাঠ্যবইটি প্রকাশের পর চৌর্যবৃত্তি ও যান্ত্রিক অনুবাদের অভিযোগ উঠে। পরে জাফর ইকবাল বইটির জন্য তার ভুলের কথা স্বীকার করেন ও হাসিনা খানের সাথে যৌথ বিবৃতিতে জানান, “এ বছর বইটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ চালু হয়েছে এবং সামনের শিক্ষাবর্ষ থেকে এতে যথেষ্ট পরিমার্জন ও সম্পাদনার সুযোগ রয়েছে।”

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ‘রাজাকার’ স্লোগানে মর্মাহত হয়ে ১৬ জুলাই তিনি লিখেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমার মনে হয়, আর কোনোদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইব না। ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে, এরাই হয়তো সেই ‘রাজাকার’। আর যে কয়দিন বেঁচে আছি, আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। একটাই তো জীবন, সেই জীবনে আবার কেন নতুন করে রাজাকারদের দেখতে হবে?” এই মন্তব্যকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয় এবং উক্ত দিনেই রকমারিসহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বইয়ের দোকান তার বই বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।

স্বাক্ষর:

মুহম্মদ_জাফর_ইকবালের_স্বাক্ষর.svg
মুহম্মদ_জাফর_ইকবালের_স্বাক্ষর.svg

✅ উপসংহার

মুহম্মদ জাফর ইকবাল শুধু একজন লেখক নন, তিনি কিশোর সমাজের জন্য এক আদর্শ। বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ, সাহিত্য ও সমাজভাবনায় তিনি যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। তাঁর বইগুলো যেমন জ্ঞান দেয়, তেমনি স্বপ্ন দেখায়। তিনি বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্যের এক অনন্য নির্মাতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে একজন আলোকবর্তিকা।

 

https://www.munshiacademy.com/মুহ্মদ-জাফর-ইকবাল-জীবন-ও-স/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *