বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০–১৯৭৬)। তাঁকে বলা হয় “মজলুম জননেতা”—অর্থাৎ, নিপীড়িত মানুষের নেতা। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, মানবপ্রেমিক, ঔপনিবেশিকবিরোধী, সমাজতন্ত্রী ও কৃষকশ্রমিকের অধিকাররক্ষার সাহসী সংগ্রামী। তাঁর জীবন ছিল ত্যাগ, সংগ্রাম ও ন্যায়ের পথের প্রতীক।


🌱 জন্ম ও শৈশব

মওলানা ভাসানীর জন্ম ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জ জেলার (বর্তমান টাঙ্গাইলের) ধনবাড়ী উপজেলার দানাবাড়ী গ্রামে। তাঁর পিতা হাযী শরাফত আলী খান এবং মাতা মজিদা খাতুন। শৈশবেই পিতামাতাকে হারিয়ে তিনি ছিলেন অভাবগ্রস্ত ও অনাথ। তবে ধর্মচেতা ও পরিশ্রমী মনোভাব তাঁকে দ্রুতই সমাজচেতনার দিকে নিয়ে যায়।


📖 শিক্ষা ও ধর্মীয় জীবন

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে ইসলামি শিক্ষা লাভ করেন। সেখানেই তিনি ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি সমাজ ও রাজনীতিতে ইসলামী ন্যায়বোধের চর্চা শুরু করেন। শৈশব থেকেই তিনি অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন।


🔥 রাজনৈতিক জীবনের সূচনা

মওলানা ভাসানী প্রথমে খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯–১৯২৪)-এর মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি পরে অসহযোগ আন্দোলন-এ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হন।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বামপন্থী ও কৃষকশ্রমিকবান্ধব রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।


🚩 সংগ্রাম ও আন্দোলন

ভাসানী ছিলেন সর্বদা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবনজুড়ে ছিল সংগ্রাম—

  • ফারাক্কা লং মার্চ (১৯৭৬)-এ তিনি ভারতের পানিবণ্টন নীতির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আন্দোলন পরিচালনা করেন।
  • তিনি কৃষকের জমির ন্যায্য অধিকার, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি এবং রাষ্ট্রের সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থার জন্য লড়েছেন।
  • তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মার্থ ব্যাখ্যা করেছেন মানবতার আলোকে—যেখানে ধর্ম মানুষের মুক্তির সহায়ক, বিভেদের নয়।

🕊️ ব্যক্তিত্ব ও দর্শন

মওলানা ভাসানী ছিলেন একাধারে সুফি, সমাজতন্ত্রী ও মানবপ্রেমিক। তাঁর পোশাক ছিল সাধারণ, ভাষা ছিল অকৃত্রিম। তিনি বলতেন—

“আমি মজলুমের পক্ষে, আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে।”

তাঁর আদর্শ ছিল জনগণের জন্য রাজনীতি, ক্ষমতার জন্য নয়।


🌼 মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

এই মহান নেতা ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে সেখানে সমাহিত করা হয়। আজও তাঁর সমাধি জনমানসে এক পবিত্র স্থানের মর্যাদা পেয়েছে।


💬 মূল্যায়ন

মওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলার রাজনীতির জনগণের বিবেক। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, সোহরাওয়ার্দী, শের-এ-বাংলা ফজলুল হক প্রমুখ নেতার সমসাময়িক হলেও নিজের নীতি ও দর্শনে ছিলেন অনন্য। তাঁর নাম উচ্চারিত হয় গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে।


🕊️ উপসংহার

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা, ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা ও কৃষকশ্রমিকের অধিকার—সবখানেই মওলানা ভাসানীর অবদান গভীরভাবে জড়িত। তিনি ছিলেন এক চিরকালীন বিদ্রোহী সন্ন্যাসী, যিনি রাজনীতিকে দেখেছেন মানবতার সেবার মাধ্যম হিসেবে।