🌍 বিশ্ব সাহিত্য

ভূমিকা

বিশ্ব সাহিত্য বলতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতির সাহিত্য এবং তাদের নিজস্ব উৎপত্তিস্থলের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত সাহিত্যকে বোঝানো হয়। অতীতে এটি মূলত পশ্চিম ইউরোপীয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু আধুনিক যুগে বিশ্ব সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা হয়—যেখানে পাঠকরা অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলের সাহিত্যকর্মে প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন।

ডেভিড ড্যামরোশের মতে,

“একটি রচনা বিশ্ব সাহিত্যে প্রবেশ করে তখনই, যখন সেটি সাহিত্য হিসেবে পঠিত হয় এবং তার ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক উৎসের বাইরে প্রচলিত হয়।”

অন্যদিকে, ভেঙ্কট মণির মতে, সাহিত্যের বিশ্বায়ন মূলত মুদ্রণ সংস্কৃতির বিকাশ এবং তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে ঘটে। গ্রন্থাগার, প্রকাশক, বই বিক্রেতা এবং পাঠক — সকলে মিলে বিশ্বসাহিত্যের “তৈরি” প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


ইতিহাস

বিশ্ব সাহিত্যের ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয় করেন জোহান উলফগ্যাং ফন গ্যেটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি “বিশ্ব সাহিত্য” শব্দটি ব্যবহার করে ইউরোপে আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক বিনিময়ের ধারণা দেন।

১৮২৭ সালে গ্যেটে বলেন —

“জাতীয় সাহিত্য এখন অর্থহীন শব্দ; বিশ্ব সাহিত্যের যুগ আসন্ন।”

গ্যেটে বিশ্বাস করতেন যে সাহিত্য মানবজাতির সর্বজনীন সম্পদ, যা জাতি, ভাষা ও সীমানা পেরিয়ে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।

কার্ল মার্কসফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাদের কমিউনিস্ট ইশতেহারে (১৮৪৮) “বিশ্ব সাহিত্য” ধারণাকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতিফলন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের মতে, বৌদ্ধিক সৃষ্টিগুলো ধীরে ধীরে সাধারণ সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে, এবং অসংখ্য জাতীয় সাহিত্য থেকে একটিই বিশ্ব সাহিত্য উদ্ভব হচ্ছে।

পরবর্তীতে এইচ. এম. পসনেট (১৮৮৬) মত দেন যে, বিশ্ব সাহিত্য আধুনিক নয়—বরং প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই বিশ্বজনীন সাহিত্যিক যোগাযোগের সূচনা ঘটে।


যুদ্ধোত্তর বিকাশ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ব সাহিত্য ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যয়ন নবজাগরণের মুখ দেখেছিল।
প্রথমদিকে এই পাঠ্যক্রম প্রধানত গ্রীক, রোমান ও পশ্চিম ইউরোপীয় সাহিত্যকেন্দ্রিক ছিল।
তবে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে শীতল যুদ্ধের অবসান, বিশ্বায়ন, এবং অভিবাসনের কারণে বিশ্ব সাহিত্যের পরিসর ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়।

“দ্য নর্টন অ্যান্থোলজি অফ ওয়ার্ল্ড মাস্টারপিসেস”-এর ১৯৯৫ সালের সম্প্রসারিত সংস্করণে প্রথমবারের মতো অ-পশ্চিমা সাহিত্য যুক্ত হয়, যা বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্তির দিকটিকে চিহ্নিত করে।


সমসাময়িক ধারণা

আধুনিক যুগে বিশ্ব সাহিত্যের সংজ্ঞা নিয়ে নানা মতভেদ দেখা যায়।

  • ডেভিড ড্যামরোশ (২০০৩, What is World Literature?) বলেন—
    বিশ্ব সাহিত্য একটি বিশাল সংকলন নয়, বরং এটি সাহিত্যকর্মের প্রচার ও গ্রহণের প্রক্রিয়া।
    তিনি মনে করেন, অনুবাদের মাধ্যমেও একটি রচনা নতুন অর্থ ও প্রাণ পেতে পারে।
  • ফ্রাঙ্কো মোরেত্তি “দূরবর্তী পাঠ” (distant reading) ধারণা দেন, যা সাহিত্য ইতিহাস ও প্রকাশনার পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেয়।
  • প্যাসকেল ক্যাসানোভা (La République mondiale des lettres, 1999) যুক্তি দেন যে, প্রান্তিক দেশের লেখকদের রচনাগুলোকে “মহানগর সাহিত্য বাজারে” প্রবেশ করতে হয় বিশ্ব সাহিত্যে স্বীকৃতি পেতে।

তবে অনেক সমালোচক যেমন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মনে করেন, অনুবাদের প্রক্রিয়ায় অনেক সময় মূল ভাষার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গভীরতা হারিয়ে যায়। তাই বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নে মূল ভাষা ও প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব অপরিসীম।


সাম্প্রতিক উদ্যোগ

চীন, এস্তোনিয়া ও তুরস্কে বর্তমানে বিশ্ব সাহিত্য বিষয়ক একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে।
World Literature Institute ২০১১ সালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্বোধন করা হয় এবং পরবর্তী সেশনগুলো অনুষ্ঠিত হয় ইস্তাম্বুল বিলগি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১২) ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (২০১৩)-তে।

বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলনের মধ্যে রয়েছে—

  • Manfred Schmeling, Weltliteratur Heute (1995)
  • Christopher Prendergast, Debating World Literature (2004)
  • David Damrosch, Teaching World Literature (2009)
  • Theo D’haen (ed.), The Routledge Companion to World Literature (2011)

উপসংহার

বিশ্ব সাহিত্য একটি চলমান, পরিবর্তনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা—যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে মানবিক ঐক্যের বার্তা বহন করে। এটি জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে সাহিত্যকে বিশ্বজনীন পরিসরে স্থাপন করেছে, যা মানব সভ্যতার যৌথ বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার।