বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন: আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

Spread the love

বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

ভূমিকা

মানব সভ্যতার ইতিহাসে কিছু মনীষী তাঁদের মেধা ও গবেষণার মাধ্যমে সময় ও বিশ্বদৃষ্টিকে পাল্টে দিয়েছেন। বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন তেমনি একজন অসামান্য প্রতিভাধর মনীষী, যিনি আধুনিক পদার্থবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর অবদান বিজ্ঞানের বহু শাখাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। নিউটনের তত্ত্ব, সূত্র ও গবেষণা আজও বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছে।

নিউটনের জন্ম ও শৈশব

আইজ্যাক নিউটনের জন্ম হয় ১৬৪৩ সালের ৪ জানুয়ারি (গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার প্রদেশের উলসথর্পে নামক গ্রামে। তাঁর পিতা আইজ্যাক নিউটন ছিলেন একজন কৃষক, যিনি তাঁর জন্মের তিন মাস পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন। মা হান্না অ্যাসকফ নিউটন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন এবং শিশু নিউটনকে নানা-নানির কাছে রেখে যান। ফলে শৈশবে নিউটন একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতায় বেড়ে উঠেন। এই নিঃসঙ্গতা হয়তো তাঁর চিন্তাশক্তিকে আরও প্রখর করে তোলে।

শিক্ষা ও প্রাথমিক জ্ঞানচর্চা

নিউটন প্রথমে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। পরে ভর্তি হন গ্রান্থাম গ্রামার স্কুলে। কিশোর বয়সে নিউটনের মধ্যে যন্ত্রপাতি তৈরি, সূর্যঘড়ি নির্মাণ ও পর্যবেক্ষণমূলক কাজে প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়।

১৬৬১ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। সেসময় ইউরোপে গ্যালিলিও, কেপলার ও ডেকার্তেসের আবিষ্কার ও মতবাদ ব্যাপক আলোচিত হচ্ছিল। তরুণ নিউটন তাঁদের কাজ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন এবং শিগগিরই স্বতন্ত্র চিন্তার সূচনা করেন।

প্লেগ মহামারী ও নিউটনের সেরা সময়

১৬৬৫ সালে লন্ডনে ভয়াবহ প্লেগ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। নিউটন তাঁর গ্রামে ফিরে যান। এই সময়টিতেই তিনি একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন—যা পরবর্তীতে “নিউটনের ওয়ান্ডার ইয়ারস” বা “অলৌকিক বছর” নামে পরিচিত হয়।

এই সময়ে তিনি—

  • গাণিতিক ক্যালকুলাসের ভিত্তি তৈরি করেন
  • বর্ণালির বিশ্লেষণ করেন
  • অভিকর্ষ সূত্র নিয়ে চিন্তা করেন
  • নিউটনের গতি সূত্রের ধারণা দেন

নিউটনের গাণিতিক অবদান

নিউটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো “ক্যালকুলাস”। যদিও একই সময়ে জার্মান গণিতবিদ লাইবনিটজও ক্যালকুলাসের ওপর কাজ করছিলেন, নিউটন নিজস্বভাবে তার ভিত্তি তৈরি করেন এবং একে নাম দেন “Fluxions”

নিউটন ক্যালকুলাসের সাহায্যে:

  • গতি ও বলের গণনা করেন
  • তরলের প্রবাহ বিশ্লেষণ করেন
  • প্রকৃতির পরিবর্তনশীল গতিবিধির ব্যাখ্যা দেন

এই কাজ পরবর্তীতে আধুনিক পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের ভিত্তি স্থাপন করে।

নিউটনের পদার্থবিদ্যায় অবদান

নিউটনের গতি সূত্র (Laws of Motion):

তিনি পদার্থবিদ্যায় বিখ্যাত তিনটি গতি সূত্র প্রদান করেন—

  1. প্রথম সূত্র (Inertia):
    প্রত্যেক বস্তু বিশ্রামে বা সোজা রেখায় সমবেগে গমন করতে থাকবে, যতক্ষণ না কোনো বাহ্যিক বল তাকে বাধা দেয়।
  2. দ্বিতীয় সূত্র (F = ma):
    বস্তুর গতির পরিবর্তনের হার বলের সমানুপাতিক এবং সেই বস্তুর ভরের সাথে সম্পর্কিত।
  3. তৃতীয় সূত্র (Action-Reaction):
    প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

এই সূত্রগুলো শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নয়, বরং এগুলো ব্যবহার করে মানুষ মহাকাশযান পরিচালনা থেকে শুরু করে প্রতিদিনের যন্ত্রপাতি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।

অভিকর্ষ সূত্র (Law of Universal Gravitation)

নিউটনের সবচেয়ে আলোচিত ও মৌলিক আবিষ্কার “সার্বজনীন অভিকর্ষ সূত্র”। তিনি বলেন:

পৃথিবীর যেকোনো দুটি বস্তু একে অপরকে একটি আকর্ষণ শক্তি দ্বারা আকর্ষণ করে, যা তাদের ভরের গুণফলের সাথে সমানুপাতিক এবং দূরত্বের বর্গের বিপরীতানুপাতিক।

এই সূত্রের মাধ্যমে নিউটন ব্যাখ্যা করেন:

  • কেন আপেল নিচে পড়ে
  • চাঁদ কেন পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে
  • গ্রহগুলোর কক্ষপথের গতি কেমন করে নির্ধারিত হয়

অপটিক্স বা আলোকবিদ্যা

নিউটনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ক্ষেত্র ছিল আলোকবিদ্যা। তিনি প্রমাণ করেন যে সাদা আলো প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ, যা প্রিজমের মাধ্যমে ভেঙে দেখা সম্ভব। তাঁর বই “Opticks”-এ আলোর প্রতিসরণ, প্রতিচ্ছায়া ও বর্ণালির বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে। তিনি নিউটনিয়ান রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ নির্মাণ করেন, যা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায় রচনা করে।

বিজ্ঞানী নিউটনের কর্মজীবন

নিউটনের জীবনের বিভিন্ন পর্বে তিনি নানা দায়িত্ব পালন করেছেন:

  • ১৬৬৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসর নিযুক্ত হন।
  • ১৭০৩ সালে রয়াল সোসাইটির সভাপতি হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
  • তিনি ইংল্যান্ডের মুদ্রা ব্যবস্থায় সংস্কার আনেন এবং রয়্যাল মিন্টের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ধর্ম ও দর্শন চিন্তায় নিউটন

আইজ্যাক নিউটন ছিলেন একজন ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তি। যদিও তিনি বিজ্ঞানকে যুক্তি ও পরীক্ষার ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছেন, তথাপি তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস গভীর ছিল। তিনি খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন শাখার মৌলিক গ্রন্থপাঠ করতেন এবং ঈশ্বরকে একটি সর্বশক্তিমান নিয়ন্তা বলে বিশ্বাস করতেন। তাঁর মতে, “প্রকৃতির নিয়মসমূহ ঈশ্বরের সৃষ্টি, এবং বিজ্ঞান সেই সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের একটি উপায়।”

নিউটনের লেখনীতে দর্শনের ছোঁয়া পাওয়া যায়। যেমন, তিনি মানবজীবনের উদ্দেশ্য, নীতিনৈতিকতা ও পরকাল নিয়েও লিখেছেন, যদিও তাঁর এসব দার্শনিক রচনাগুলো ততটা আলোচিত নয় যতটা তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজ।

নিউটনের গ্রন্থসমূহ

নিউটনের বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হলো তাঁর রচিত বইগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত:

১. Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica (১৬৮৭)

এটি নিউটনের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সংক্ষেপে একে “Principia” বলা হয়। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর:

  • গতি সূত্র
  • অভিকর্ষ সূত্র
  • জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাখ্যা

সমন্বিতভাবে উপস্থাপন করেন। এতে তিনি গ্যালিলিও, কেপলার ও ডেকার্তেসের কাজকে বিশ্লেষণ করে নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।

২. Opticks (১৭০৪)

এই বইয়ে আলোকবিজ্ঞানের নানা বিষয় যেমন আলো ও রঙ, প্রতিসরণ, প্রতিচ্ছবি এবং বর্ণালির ব্যাখ্যা রয়েছে।

নিউটনের উত্তরাধিকার ও প্রভাব

নিউটনের আবিষ্কার শুধু তাঁর সময়কে নয়, পরবর্তী শত শত বছরব্যাপী বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে। নিচে তাঁর উত্তরাধিকার বিশ্লেষণ করা হলো:

আধুনিক পদার্থবিদ্যার ভিত্তি

নিউটনের সূত্র ছাড়া আজকের রকেট প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, ব্রিজ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি—সবকিছু অচল হতো।

গণিত ও প্রকৌশল বিজ্ঞানে বিপ্লব

ক্যালকুলাসের মাধ্যমে নিউটন প্রকৌশল, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পরমাণু পদার্থবিদ্যার জটিল সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছেন।

আইনস্টাইন ও আধুনিক বিজ্ঞান

আলবার্ট আইনস্টাইন নিজে নিউটনকে ‘Scientific Giant’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব নিউটনের অভিকর্ষ সূত্রকে আধুনিকীকরণ করে, তবুও নিউটনের মৌলিক ধারণাই ছিল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি।

মৃত্যুবরণ ও রাষ্ট্রীয় সম্মান

নিউটন মারা যান ১৭২৭ সালের ৩১ মার্চ, ৮৪ বছর বয়সে। তিনি প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাধিস্থ হন, যা রাজকীয় সম্মানপ্রাপ্তদের জন্য নির্ধারিত স্থান। তাঁর সমাধিতে উৎকীর্ণ আছে:

“Here lies what was mortal of Isaac Newton.”
(এখানে শায়িত আছেন আইজ্যাক নিউটনের নশ্বর দেহ)

মূল্যায়ন ও সমাপ্তি

স্যার আইজ্যাক নিউটন নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর গাণিতিক মেধা, বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রকৃতি বিশ্লেষণের ক্ষমতা মানবজাতিকে এক নতুন পথে পরিচালিত করেছে। আজকের যুগে যে আমরা মহাকাশে যান পাঠাতে পারি, বস্তুর গতি ব্যাখ্যা করতে পারি, তা নিউটনের তত্ত্ব ও সূত্রের ভিত্তিতেই সম্ভব হয়েছে।

নিউটন নিজেই বলেছিলেন:

“If I have seen further, it is by standing on the shoulders of giants.”
(আমি যদি আরও দূরে দেখতে পেরেছি, তা হলে সেটি পূর্বসূরি মহাপুরুষদের কাঁধে দাঁড়িয়ে)

এই বিনয়ী বাক্য নিউটনের ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। তাঁর কর্ম ও কীর্তি বিজ্ঞানের জগতে চিরকাল অম্লান থাকবে।

উপসংহার

আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ বিজ্ঞানের মৌল ভিত্তিকে দৃঢ় করেছে। তাঁর সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায় কীভাবে যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়। তাঁর আবিষ্কার শুধু জ্ঞান নয়, মানবসমাজের সভ্যতা, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বিজ্ঞানী নিউটন আমাদের দেখিয়ে গেছেন—একটি আপেলের পতন দিয়েও মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব

https://www.munshiacademy.com/বিজ্ঞানী-আইজ্যাক-নিউটন-আ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *