অন্ধকার যুগ: বাংলা সাহিত্যের নিস্তব্ধ অধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বহু বিচিত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই সাহিত্যধারায় যেমন আমরা চর্যাপদের ধ্যানমগ্নতা, মঙ্গলকাব্যের মহিমা, তেমনি পাই আধুনিক কাব্যের তীব্র মানবতাবাদ। কিন্তু এই ধারাবাহিকতার মধ্যেও এক রহস্যময় নিস্তব্ধতা বিদ্যমান—যা “অন্ধকার যুগ” নামে পরিচিত। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই সাহিত্য-শূন্য সময়কাল বাংলা সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে এক রহস্যময় ও বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
“অন্ধকার যুগ” বলতে সাধারণভাবে ১২শ শতক থেকে ১৪শ শতক পর্যন্ত সময়কালকে বোঝানো হয়, যদিও কেউ কেউ এর বিস্তৃতি ১১শ শতকের শেষ থেকে ১৪শ শতকের শেষ পর্যন্ত ধরে থাকেন। এই সময়টিতে বাংলা সাহিত্যের কোনো উল্লেখযোগ্য রচনা বা সাহিত্যিক প্রবণতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলত, এ যুগকে “literary void” বা “সাহিত্যিক শূন্যতা”-র যুগ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
এই সময়কালে বাংলা অঞ্চল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত অস্থির ছিল। সেন রাজবংশের পতনের পর বাংলা বারো ভুঁইয়াদের হাতে ছিন্নভিন্ন হয়। পরবর্তীতে মুসলিম শাসনের সূচনা হয় (১৩০০-এর কাছাকাছি)। এই শাসনপরিবর্তন এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাজে একধরনের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যার প্রভাব সাহিত্যেও পড়ে।
১৩শ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয় তুর্কি ও আফগান সেনাদের মাধ্যমে। প্রাক-মুসলিম হিন্দু রাজাদের রাজদরবার ও তীর্থভিত্তিক সাহিত্যচর্চা একপ্রকার বিলুপ্ত হতে থাকে। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফার্সি ভাষার প্রভাব বাড়ে, ফলে বাংলাভাষার বিকাশে কিছুটা বাধা সৃষ্টি হয়।
যদিও লিখিত সাহিত্য ছিল না, তবু এ সময় বাংলার গ্রামীণ জনগণের মধ্যে মৌখিক লোকসাহিত্য, পালা, কাহিনি ও গান বহাল ছিল। তা লিপিবদ্ধ না হওয়ায় সাহিত্যচর্চার ধারা থেমে গেছে বলেই ধরা হয়।
🔶 অন্ধকার যুগ বলার যুক্তি ও বিতর্ক
যে কারণে এ যুগকে “অন্ধকার” বলা হয়:
– কোনো লিখিত সাহিত্য নিদর্শন নেই
– পাণ্ডুলিপির অভাব
– রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অস্থিরতা
– শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বৌদ্ধ বা হিন্দু বৌদ্ধ বিহার বা মঠ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়
তবে বিতর্কও আছে:
– অনেকের মতে সাহিত্যচর্চা চলছিল, কিন্তু তা লিপিবদ্ধ হয়নি বা হারিয়ে গেছে
– মৌখিক সাহিত্যকে উপেক্ষা করে “অন্ধকার” বলা ঠিক নয়
– “অন্ধকার যুগ” কথাটি পাশ্চাত্য সাহিত্যধারা অনুসৃত ও একপেশে মূল্যায়ন
🔶 চর্যাপদের পরে শূন্যতা
চর্যাপদ (৮ম–১২শ শতক) বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের এই গানের পরই যেন সাহিত্যের ধারাবাহিকতা থেমে যায়। এই অন্তর্বর্তী শূন্যতাই পরবর্তী যুগে “অন্ধকার যুগ” নামে অভিহিত হয়।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চিহ্নিত করতে গিয়ে গবেষকেরা সাধারণত নিচের ধারায় যুগ বিভাজন করেন:
1. প্রাচীন যুগ (চর্যাপদ: ৮ম–১২শ)
2. অন্ধকার যুগ (১২শ–১৪শ শতক)
3. মধ্যযুগ (মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি: ১৫শ–১৮শ শতক)
4. আধুনিক যুগ (১৯শ শতক থেকে বর্তমান)
যদিও লিখিত সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় না, তবে ধারণা করা হয় এই সময়কালে মৌখিক সাহিত্য প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। গ্রামবাংলার লোকজ সংস্কৃতিতে ভাটিয়ালি, পালা, জারি, সারি, কবিগান, লোককথা ও রূপকথা ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। ধর্মীয় আচার, কৃষিজীবনের গান, মৌখিক উপাখ্যান—এসব ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী।
– লোকগান: ধানকাটা, জেলেদের গান, বাউল সঙ্গীত (প্রাথমিক রূপ)
– কথানাট্য ও পালা: ধর্মীয় কাহিনি, মিথ ও সমাজকেন্দ্রিক পালা
– রূপকথা ও কাহিনি: ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ধরণের কাহিনির মূল ভিত্তি সম্ভবত এই সময়ের মৌখিক সাহিত্যচর্চা।
🔶 অন্ধকার যুগের সাহিত্যিক অবদান কি একেবারে নেই?
গবেষকগণ কিছু সম্ভাব্য সাহিত্যধারা এই যুগে রচিত হয়েছিল বলে মত দেন, যেমন:
– লোকপুরাণ ও দেবকাহিনি
– অমর্ত্যবাদ ও তন্ত্রসাধনার শ্লোক
– কিছু মিশ্র ফারসি-সঙ্কর বাংলা রচনার সূত্রপাত
মুসলিম শাসনের ফলে ফারসি ভাষার দাপট বৃদ্ধি পায়। প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ফারসি ব্যবহৃত হওয়ায় বাংলা ভাষার সাহিত্যিক প্রবাহ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে কিছু চিন্তাশীল পণ্ডিত মনে করেন, এই বহুভাষিক প্রভাব পরবর্তীতে বাংলাকে বহুমাত্রিক করে তোলে।
“অন্ধকার” না “নিরব” যুগ?
বর্তমান গবেষণায় অনেকেই ‘অন্ধকার’ শব্দটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাঁদের মতে—
– এই সময় সাহিত্যচর্চা একেবারে থেমে যায়নি; কেবল লিপিবদ্ধ হয়নি।
– মৌখিক সাহিত্যকে “সাহিত্য” বলে গণ্য না করাই এই ‘অন্ধকার’ বলার প্রধান কারণ।
– এই যুগ ছিল রূপান্তরের যুগ, এক ধরনের সাংস্কৃতিক রিহার্সাল।
🔶 গবেষকদের মূল্যায়ন ও মতভেদ
▶ ড. সুকুমার সেন:
“This was a period of literary silence… but not necessarily of intellectual barrenness.”
▶ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ:
“চর্যাপদের পর একটি দীর্ঘ শূন্যতা দেখা যায়, তবে সেটি মৌখিক সাহিত্যের ধারা ছিল না বললে ভুল হবে।”
▶ ড. দীনেশচন্দ্র সেন:
“এই যুগেই বাংলা ভাষা নিজস্বতাকে পরিপক্ব করে তোলে।”
এই শূন্যতার যুগের পরেই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে মঙ্গলকাব্য, শ্রীচৈতন্যের ভক্তিমূলক পদাবলি, যা ধর্মভিত্তিক সাহিত্যের এক নতুন রূপ এনে দেয়।
– রূপসাগর, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল—সবই লোকচর্চার বীজ থেকে বিকশিত।
– বৈষ্ণব সাহিত্য হয় এই রূপান্তরের শিখর।
– মৌখিক সাহিত্য পরবর্তী সাহিত্যিকদের জন্য রূপকাঠামো তৈরি করে।
বাংলা সাহিত্যের “অন্ধকার যুগ” এক রহস্যময় অধ্যায় হলেও এটি নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির সময়কাল। একে নিছক সাহিত্যশূন্য বলার চেয়ে বরং বলা যেতে পারে—অপ্রাপ্ত কিংবা অলিখিত সাহিত্যের যুগ। এই যুগের মৌখিক ধারা, লোকজ চর্চা ও ভাষার অভিযোজনই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ভিত্তি রচনা করে। ফলে, অন্ধকার হলেও এই যুগের রয়েছে সুগভীর ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক গুরুত্ব।
https://www.munshiacademy.com/বাংলা-সাহিত্যে-অন্ধকার-য/