বাংলাদেশের পুথি সাহিত্য

Spread the love

বাংলাদেশের পুথি সাহিত্য

✍️ একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পুথি সাহিত্য এক অসামান্য সম্পদ। এটি শুধু সাহিত্য নয়, বরং সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মানবচেতনার এক ঐতিহাসিক দলিল। ‘পুথি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পাণ্ডুলিপি বা হাতের লেখা গ্রন্থ। তবে সাহিত্যে এই শব্দটি প্রধানত মধ্যযুগীয় কাব্যকেন্দ্রিক পদ্য রচনাকে নির্দেশ করে, যেগুলো তালপাতা বা কাপড়ের উপর হাতে লেখা হতো এবং গানের ছন্দে আবৃত্তি করা হতো।

বাংলাদেশে পুথি সাহিত্য একটি অনন্য ধারা, যা ইসলামি ভাবাদর্শ, লোকজ সংস্কৃতি এবং বাংলার গ্রামীণ সমাজকে মিলিয়ে এক বিশেষ সাহিত্যিক রূপ দিয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা পুথি সাহিত্যের উৎপত্তি, বিষয়বস্তু, বৈশিষ্ট্য, জনপ্রিয় পুথিকার ও পুথিসংগ্রহ, এবং বাংলাদেশের পুথি সাহিত্যের গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

পুথি সাহিত্যের উৎপত্তি ও ধারাবাহিকতা

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পুথি সাহিত্যের সূচনা আনুমানিক ১৫শ শতাব্দীতে। ইসলাম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সুফি-দরবেশ ও ধর্মপ্রচারকরা বাংলায় প্রচুর ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষামূলক পদ্য রচনা করেন। আরবি-ফারসি প্রভাবে এসব সাহিত্য রচিত হলেও, এর ভাষা ছিল স্থানীয় জনগণের সহজবোধ্য বাংলা। ফলে এই সাহিত্য দ্রুত লোকজ পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মুসলিম কবিরা তাদের সাহিত্যকে ব্যবহার করেছেন ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচারের একটি মাধ্যম হিসেবে। তারা ইসলামি ইতিহাস, নবীজীবনী, কারবালার কাহিনি, সুফি দর্শন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখেছেন, যা পুথি সাহিত্যের মূলে স্থান করে নিয়েছে।

পুথি সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য

পুথি সাহিত্য কিছু নির্দিষ্ট ভাষাগত ও বিষয়ভিত্তিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। সেগুলো হলো—

১. গান ও কাব্যনির্ভর রচনা

পুথিগুলো সাধারণত পদ্যে রচিত। এগুলো ছিল পাঠযোগ্যই নয়, গায়কীর উপযোগী। অনেক সময় গ্রাম্য মেলার আসরে, মসজিদ বা খানকায় পুথিপাঠের আয়োজন হতো। পাঠক গানের সুরে ছন্দ মিলিয়ে পড়তেন—এই পাঠককে বলা হতো ‘পুথিয়াল’।

২. লোকজ উপাদান

পুথি সাহিত্য বাংলার গ্রামীণ জীবন, লোকবিশ্বাস, আচার, রীতিনীতিকে ধারণ করে। এতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিল দেখা যায়।

৩. ধর্মীয় প্রভাব

সর্বাধিক রচিত পুথির বিষয়বস্তু ছিল ইসলামি ইতিহাস, নবী করিম (স.)-এর জীবন, হজরত হাসান-হোসাইনের কারবালার ঘটনা, হজ, রোজা, নামাজের উপকারিতা ইত্যাদি।

৪. সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা

অনেক পুথিতে গ্রামীণ জীবনের অসঙ্গতি, কৃষকের দুর্দশা, বঞ্চিত নারীর চিত্র, শিক্ষার অভাব ইত্যাদিকে তুলে ধরা হয়েছে।

পুথি সাহিত্যের ভাষা ও ছন্দ

পুথির ভাষা সাধারণত সহজ, কথ্য বাংলা, কিছু কিছু ফারসি ও আরবি শব্দ সংমিশ্রিত। এতে দোহার, পয়ার, ত্রিপদী, সপ্তপদী, মঙ্গলপ্রবাহ ইত্যাদি ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের ভাষা-ছন্দ সহজবোধ্য ও আবেগঘন হওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে সহজে দাগ কাটত।

পুথির প্রচলিত বিষয়বস্তু

বাংলাদেশের পুথি সাহিত্য বিষয়বস্তুর দিক থেকে বেশ বৈচিত্র্যময়। নিচে কয়েকটি প্রধান বিষয় উপস্থাপন করা হলো:

১. ধর্মীয় কাহিনি

  • নবীজীবনী (মুহাম্মদ চরিত)
  • কারবালার কাহিনি
  • শবে মেরাজ
  • বোরহানউদ্দিন গাজী, ইমাম গাজ্জালী প্রভৃতি সুফির জীবনী

২. নৈতিক শিক্ষা

  • নামাজ পুথি
  • দোজখ-জান্নাতের বিবরণ
  • হালাল-হারামের বর্ণনা
  • মা-বাবার মর্যাদা

৩. প্রেম ও রোমান্স

  • ইউসুফ-জুলেখা
  • লাইলি-মজনু
  • সয়ফুল মুলুক
  • শাহনামা ও লংকাকাব্য

৪. ঐতিহাসিক ও যুদ্ধকাহিনি

  • বাদশাহ-নবাবদের যুদ্ধ
  • ইসলামী সাম্রাজ্যের বিবরণ

উল্লেখযোগ্য পুথিকার ও তাঁদের রচনা

বাংলাদেশে বহু পুথিকার ছিলেন যারা পুথি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন:

১. মাওলানা রুহুল আমিন

  • “কারবালার পুথি” রচয়িতা

২. মাওলানা মুহাম্মদ গারীবুল্লাহ

  • “রসুল বিবরণ” পুথির জন্য বিখ্যাত

৩. সৈয়দ সুলতান

  • “নবীবংশ” ও “রসুলবিজয়”

৪. নুরনবী রচিত “মেরাজনামা”

  • মেরাজের বর্ণনায় এটি অমর একটি পুথি

৫. আবদুল হাকিম (চট্টগ্রাম)

  • আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে দক্ষ ছিলেন, ভাষারীতি পরিশীলিত

বাংলাদেশের পুথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

বাংলাদেশে বহু পুথি এখনো বিভিন্ন গ্রাম, খানকা, লাইব্রেরি ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিঘর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থাগার এবং ইসলামি ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে শত শত পুথির দলিল রয়েছে। এছাড়াও চৌধুরী পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ, পটিয়া-মহেশখালী অঞ্চলে বহু অমূল্য পুথি এখনো পাওয়া যায়।

পুথি সাহিত্যের ভূমিকা ও গুরুত্ব

বাংলাদেশের পুথি সাহিত্য শুধু সাহিত্য নয়, বরং একটি লোকজ ইতিহাস। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে—

  • গ্রামের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগ
  • সমাজ কাঠামো
  • নারীর অবস্থা
  • লোকজ সংস্কৃতি
  • রাজনীতি ও সংস্কার

পুথি সাহিত্যের মাধ্যমে জানা যায়—আধুনিক কালের আগেও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা কতটা সমৃদ্ধ ছিল। বিশেষ করে অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত সমাজে এই সাহিত্য শ্রুতি ও আবৃত্তির মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতো।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুথি সাহিত্য

বর্তমানে পুথি সাহিত্য অনেকটা বিলুপ্তির পথে। ছাপাখানার আগমনের পর এই হাতে লেখা সাহিত্য গুরুত্ব হারাতে থাকে। তদুপরি, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম এই ধরনের লোকজ সাহিত্যকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। তবুও গবেষকদের মধ্যে এখন নতুন করে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ‘পুথি পাঠ’ ও গবেষণা চালু রয়েছে।

বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থাগার ও কিছু সংগঠন ডিজিটাল আকারে পুথি সংরক্ষণের চেষ্টা করছে। তবে স্থানীয় পর্যায়ে এই সাহিত্য রক্ষা ও জনপ্রিয়করণ জরুরি।

উপসংহার

বাংলাদেশের পুথি সাহিত্য এক অমূল্য ঐতিহ্য, যা কেবল সাহিত্যই নয়, আমাদের লোকজ ইতিহাস, ধর্মীয় চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করে। এই সাহিত্য রক্ষায় জরুরি গবেষণা, ডিজিটাল সংরক্ষণ, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম।

যতদিন বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে, ততদিন পুথি সাহিত্যের আবেদন তার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের মননে টিকে থাকবে—যেমনটি কবি বলেছিলেন,
“পুরনো যে পুথির পাতায় ধুলা জমে আছে,
তাতে লুকানো সোনার কিরণ আজো জ্বলজ্বলে।”

https://www.munshiacademy.com/বাংলাদেশের-পুথি-সাহিত্য/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *