ফজলুর রহমান খান: আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

🔷 ভূমিকা
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী ও স্থপতি হিসেবে পরিচিত ফজলুর রহমান খান আধুনিক আকাশচুম্বী ভবনের নকশা ও নির্মাণে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী নন, ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা—যাঁর চিন্তা ও প্রযুক্তি আজও বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়।
🔷 জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
- জন্ম: ৩ এপ্রিল ১৯২৯
- স্থান: ঢাকায়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
- পরিবার: পিতা আবদুর রহমান খান ছিলেন একজন গণিত শিক্ষক, যাঁর প্রভাব ফজলুর ওপর ব্যাপক ছিল।
🔷 শিক্ষাজীবন
- শুরু: ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি।
- ১৯৫০: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক।
- স্কলারশিপ: ফুলব্রাইট বৃত্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা।
- ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (IIT), শিকাগো:
- মাস্টার্স ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
- সেখানে কিংবদন্তি স্থপতি Ludwig Mies van der Rohe এর প্রভাবে স্থাপত্যে ঝোঁক বৃদ্ধি পায়।
🔷 পেশাগত জীবন
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যস্ততার কারণে আর সম্ভব হয়নি।
- ১৯৫৫ সালে “Skidmore, Owings & Merrill (SOM)” কোম্পানিতে যোগদান।
- শিকাগো ভিত্তিক এই ফার্মেই তিনি তাঁর বিখ্যাত প্রকৌশল উদ্ভাবনগুলোর প্রয়োগ করেন।
🔷 প্রধান অবদান: Structural Engineering-এ বিপ্লব
১. Tube Structural System (টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম):
- আকাশচুম্বী ভবনের নির্মাণে মূল ধারণা পরিবর্তন করে।
- ভবনের বাইরের অংশকে টিউবের মতো শক্ত করে তোলার ফলে অনেক উঁচু ভবন নির্মাণ সহজ হয়।
২. Trussed Tube, Bundled Tube & Outrigger Systems:
- এসব ডিজাইন ভবনের ওজন কমিয়ে, শক্তি বাড়ায়।
- বাতাস ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণে সহায়ক।
🔷 বিশ্বখ্যাত স্থাপত্যকর্ম
🏙️ John Hancock Center (চিকাগো, ১০০ তলা)
- Bundled Tube System ব্যবহারে প্রথম সাফল্য।
- তীব্র বাতাস ও লোড শোষণে সক্ষম ভবন।
🏙️ Willis Tower (সাবেক Sears Tower)
- একসময় বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন (১১০ তলা)।
- এখনো Structural Engineering-এর অন্যতম সেরা নিদর্শন।
🏙️ Hajj Terminal (সৌদি আরব):
- জ্যামিতিক ডিজাইন ও ছায়াযুক্ত ছাদবিশিষ্ট স্থাপত্যের এক বিস্ময়।
- বছরে লক্ষাধিক হাজিদের ধারণক্ষম।
🔷 ব্যক্তিত্ব ও দর্শন
- প্রখর মেধা ও সৃজনশীলতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিনয়ী ও মানবিক।
- পেশাগত জীবনে যুক্ত ছিলেন মানবতার সেবায়; বিল্ডিং ডিজাইনকে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী সহজ ও পরিবেশবান্ধব করে তোলাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
🔷 বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাঁর মনোভাব
- বারবার বলেছিলেন, তিনি একজন বাঙালি এবং বাংলাদেশের মাটিতেই তাঁর শিকড়।
- বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখার ইচ্ছা পোষণ করলেও তাঁর বৈশ্বিক ব্যস্ততা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি।
🔷 পুরস্কার ও স্বীকৃতি
- Fellow of American Institute of Architects
- National Academy of Engineering, USA
- Honorary Doctorates from several universities
- স্থাপত্য ও প্রকৌশলে যুগান্তকারী অবদানের জন্য বিশ্বজুড়ে সম্মানিত হন।
🔷 মৃত্যু
- তারিখ: ২৭ মার্চ ১৯৮২
- স্থান: সৌদি আরব, মক্কায় হজের সফরের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ
- তাঁকে দাফন করা হয় মক্কায়।
🔷 ফজলুর রহমান খানের কর্মের তাৎপর্য
- আধুনিক স্থাপত্যের পটভূমিতে “টিউব-সিস্টেম” একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার।
- তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ছাড়া বর্তমান বিশ্বের উচ্চ ভবনগুলোর চিন্তাই করা যেত না।
- বাংলাদেশের তরুণ প্রকৌশলীদের অনুপ্রেরণার উৎস।
🔷 উপসংহার
ফজলুর রহমান খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী, উদ্ভাবক ও মানবিক চিন্তাবিদ। তিনি শুধু আকাশছোঁয়া ভবনই নির্মাণ করেননি, বরং মানুষের জন্য টেকসই, কার্যকর ও নিরাপদ বাসগৃহ নির্মাণের নতুন যুগের সূচনা করেছেন। তাঁর কর্ম ও দর্শন বাংলাদেশের গর্ব, আর বিশ্বের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।