পুষ্পকথা

পুষ্পকথা : সময়, জীবন ও রাজনৈতিক মিশ্রণের শৈল্পিক দর্পণ

পুষ্পকথা : সময়, জীবন ও রাজনৈতিক মিশ্রণের শৈল্পিক দর্পণ
মুনশি আলিম


পুষ্পকথা একটি উপন্যাস। মোজাম্মেল হক নিয়োগী অত্যন্ত যতœসহকারে এই উপন্যাসটি লেখার চেষ্টা করেছেন। মূলত এটি ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় খÐ। প্রথম খÐের নাম ফাঁদ। আঠারো ফর্মার এই উপন্যাসটি ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় অনুপ্রাণ থেকে। এতে মোট পর্ব রয়েছে ৪৩টি। উপন্যাসটিতে মোট পৃষ্ঠা রয়েছে ২৮৮টি। পুরো উপন্যাসে ধারণ করা হয়েছে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়কে। সেই সময়ের মধ্যে ঢাকার বদলে যাওয়ার চিত্র, মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি, সারা দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলি অন্যতম। মূলত পুষ্পকথা হলো রাজনৈতিক আবহে একটি সামাজিক উপন্যাস।

কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর উপন্যাস পড়লে অনেক দিন মনে থাকে। পুষ্পকথা উপন্যাসটিও মনে রাখার মতো। নির্দিষ্ট সময়ের পথরেখায় পা ফেলে চরিত্রগুলোর নির্মাণ ও মনস্তাত্তি¡ক নিবিড় বিশ্লেষণের পাশাপাশি নব্বই দশকের শেষ ও শূন্য দশকের শুরুর দিককার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঘটনাবলি নিয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাস।

উপন্যাসটির প্রতিটি পর্বেই রয়েছে মূল ঘটনার বিস্তার। এছাড়া পর্বের পরম্পরায় কাহিনির ঐকমত্যের পাশাপাশি রয়েছে সময়ের ঐক্য। নাট্যকার বা উপন্যাসিককে এ বিষয়টি বেশি করে মাথায় রাখতে হয়। আবার শুধু মাথায় রাখলেই চলে না; এগুলোর যুতসই প্রয়োগও করতে হয়। পুষ্পকথা উপন্যাসে ঘটনার ঐক্যের পরম্পরা যেমন রক্ষিত হয়েছে তেমনই সময়কেও যথোপযুক্তভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।

উপন্যাসের প্রায় পুরো শরীর জুড়েই লেপটে রয়েছে আধুনিক জীবনের ক্ষতাক্ত চিত্র। বৈশি^ক রাজনৈতিক বিরূপ প্রভাব এদেশের জনমনেও যে তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে তা পুষ্পকথা উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। এককথায় নাগরিক জীবনকে মনস্তাত্তি¡কভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাঁর রচনার ক্যানভাসে অবলীলায় স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে ক্লেদাক্ত নাগরিক জীবনের ভেতরবাহির।

পুষ্পকথা ইপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো পুষ্প। তবে পুষ্প চরিত্রের পূর্ণতা আনয়নে কাদের চরিত্রটির ভূমিকা অপরিসীম। মূলত পুষ্প এবং কাদের এই উপন্যাসে হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল দুটি চরিত্র। উপন্যাসের আদ্যোপান্ত পঠনপাঠনে মনে হবে প্রধান চরিত্র পুষ্প নয়, কাদের। কেননা, উপন্যাসের শেষপর্যায়ে পাঠকহৃদয়ে পুষ্পর জন্য যতটুকু না আবেগের প্রশমন ঘটে তার চেয়ে বেশি ঘটে কাদেরের ক্ষেত্রে। মূলত পুষ্পের তুলনায় কাদের চরিত্রই বেশি উজ্জ¦ল হয়ে ফুটে ওঠেছে। এটা অনেকটা মেঘনাদবধ মহাকাব্যের মেঘনাদ এবং রাবণ চরিত্রের মতো হয়েছে। অর্থাৎ মেঘনাদবধ মহাকাব্যে কবির প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা ছিল মেঘনাদের প্রতি। কবির পুরোটা সত্তা দিয়েই তিনি প্রধান চরিত্র হিসেবে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন মেঘনাদকে। কিন্তু ঘটনার বিস্তার, ঘটনার ঘনঘটায়, সংলাপের ধরনধারণে, দেশপ্রেমের জীবন্ত নিদর্শনে নানাভাবেই মেঘনাদকে ছাপিয়ে রাবণ চরিত্রই হয়ে ওঠেছে উজ্জ্বল।

পুষ্পকথা উপন্যাসে প্রতিটি পর্বেই রয়েছে পাঠককে ধরে রাখার জন্য চুম্বকাংশ। আছে আবেগের ঘনঘটা। আছে প্রত্যেকটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ। কাহিনির সূত্র ধরে পাঠক অবলীলায় হেঁটে চলবে বলেই আমার বিশ^াস। এককথায় পাঠককে ধরে রাখার জন্য যে যে গুণগুলো অপরিহার্য তার পুরোটাই যেন এই উপন্যাসে রয়েছে। আমার বিশ^াসপ্রত্যেক পাঠকমাত্রেই এটা স্বীকার করবে।

তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে কাদেরের প্রতি ঔপন্যাসিকের যেনো নিজেরই নগ্ন ছায়া পড়েছে। যেমনটি পড়েছিল পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে হোসেন মিয়ার ওপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। জীবনে থেমে যেতে নেই। পরিশ্রমই হলো বেঁচে থাকার হাতিয়ার। আপ্তবাক্যগুলো কাদের চরিত্রের মাধ্যমেই তিন ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া কাদের চরিত্রে বইয়ের প্রতি নেশা ধরিয়ে প্রকারান্তরে নিজেরই ছায়াপাত ঘটনো হয়েছে।

পুষ্পকথা উপন্যাসের সংলাপগুলেকে যথেষ্ট যুতসই মনে হয়েছে। বিশেষ করে চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ চয়নে নিঃসন্দেহে তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রধান চরিত্রের সংলাপগুলোকে যেমন দার্শনিক পদবাচ্যের আবহে গড়ে তুলেছেন তেমনই পার্শ চরিত্রগুলোর মুখে যুতসই সংলাপ চয়নের মাধ্যমে নিটোল বাস্তবতাকেই জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সংলাপগুলো যেখানে যেমন হওয়া উচিত ঠিক যেনো সেরকমই হয়েছে। কোথাও কোনোরকম জড়তা পরিলক্ষিত হয় না।
ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে। বিশেষ করে ভাষার সরলীকরণ এই উপন্যাসের মাহাত্মকে অনেকটাই বেগবান করেছে। যথাসম্ভব সরল বাক্যের পথ ধরেই তিনি হেঁটেছেন। এছাড়া চরিত্র অনুযায়ী সংলাপের ভাষাও যথোপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এদিক থেকে নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসার দাবিদার।

উপমা, বুলেট বাক্যের ব্যবহারেও তিনি সিদ্ধহস্ত। এককথায় মোজাম্মেল হক নিয়োগীর বুলেক বাক্যে মাঝেমধ্যেই পাঠক সিক্ত হবে। বিশেষ করে এসব বুলেট বাক্যের যথোপযুক্ত ব্যবহারে কেন্দ্রীয় চরিত্রদ্বয় পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে বিশেষভাবে স্পর্শের, গন্ধের আর প্রত্যাশিত রক্তমাংসের। তবে পর্ব নং ৮-এ এসে কিছুটা খটকা লেগেছে। কথাসাহিত্যিকের ভাষ্য অনুযায়ী“মানুষ একবার বহুগামী হলে কখনোই একজন জীবনসঙ্গী নিয়ে থাকতে পারে না।” এই আপ্ত দার্শনিক পদবাচ্যটি কাহিনির দৃশ্যাদৃশ্যে এসে সাংঘর্ষিক মনে হয়। কেননা, শেষতক মাসুদ মনের মানুষ নীপাকেই বেছে নিয়ে আধুনিক সংসার যাপন করছে। আধুনি শব্দ লিভ টুগেদার হলেও আপামর জনসাধারণের ভাষায় সেটাই হয়ে উঠেছে দাম্পত্যজীবন। এমনকি কাদের নিজেই এ আপ্ত বুলেটবাক্যটিকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে। কেননা পুষ্প বহুগামী হলেও কাদেরের অপার ভালোবাসার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে; নিজেই হয়ে ওঠেছে নিটোল সংসারী।

পুষ্পকথা উপন্যাসের প্রধান অপ্রধান চরিত্রগুলো হলোপুষ্প, কাদের, নাজনিন, মাসুদ, গৌতম, সুদীপা, নীপা, জালাল হকার, ফাতেমা, নাসের আমির হোসেন, তবারক মিয়া, মনির হোসেন, জুম্বন, কানুলাল চা বিক্রেতা, শহিদ, সামাদ, নিলুফা, কাঞ্চন, সফুরা, আনোয়ার, ম্যানেজার রশিদ, এমডি শাহ্ জোবায়ের, পত্রিকা সম্পাদক আজিজ খান, কাজের বয় ফরিদ, মনিরা, তালেব হোসেন, সেলসম্যান জাভেদ, ফয়সাল, আকলিমা, নীরা, মোতালেব, ময়েজউদ্দিন ফুটবলার, হানিফ, বাসেত চৌধুরী, নজিবত, রহমত আলী দোকানদার, সাফিয়া, নাহিদা, সালেহীন, সুফিয়ান, কাজের মেয়ে ফাতেমা, সাবরিনা, মদিনা, খাদেম, ডা. রাফিয়া, হাশিম কম্পাউন্ডার, সাবুদ আলী, সিরাজ, রমিজা, মিনা, সাফিয়া, রিনা, মানিক, চা বিক্রেতা তাহের, সামাদ কনটেকদার প্রমুখ প্রভৃতি।
পুষ্পকথা মূলত ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় খÐ। প্রথম খÐে পুষ্প ছিল আবাসিক পতিতা। এই খÐে সে শুদ্ধ, সংগ্রামী ও মানবিক জীবনের প্রতীক। তবু পুরো উপন্যাসের প্রায় বেশিরভাগ জায়গাজুড়েই রয়েছে পুষ্পর ট্রমা, আতঙ্ক, ভীতি ইত্যাদি জটিল মনস্তাত্তি¡ক ঘটনাগুলোর আত্মীকরণ।

চাইলেই অতীতকে ভুলে থাকা যায় না। যেমনটি পারেনি পুষ্প। ঘটনার প্রাসঙ্গিকতায়, সাংসারিক নানা টানাপোড়নে, নানা কর্মযজ্ঞের প্রাক্কালে তার মনে পড়েছে অতীত জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন নানা স্পর্শকাতর ঘটনা।

মৌলিক উপন্যাসের কলেবর ছোটো হলেও কোনো সমস্যা নেই। উপন্যাসের শিল্প অক্ষুণœ রেখে কলেবরকে যদি ছোটো করা যায় তবে তা নিঃসন্দেহে প্রশসংসার দাবিদার। অহেতুক চুইনগামের মতো না টেনে মূলত মূলের প্রতিই বেশি খেয়াল রাখা উচিত। পুরো উপন্যাসটি একটু সময় নিয়ে ঘষামাজা করলে উপন্যাসটির কলেবর নিঃসন্দেহে আরও ছোটো হতে পারত বলে আমার বিশ^াস। অনেক পর্বেই অনভিপ্রেত ঘটনার অতিশায়ন পরিলক্ষিত হয়। যেমনÑ২৯ নং পর্বটি অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়। এ পর্বটি না থাকলেও মূল উপন্যাসের তেমন কোনো ক্ষতি নেই।

মানুষ দোষেগুণেই মানুষ। অতীত রোমন্থন করা আমাদের সহজাত প্রবণতা। মূলত অতীতকে ভোলা যায় না; আর সে অতীত যদি হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন তবে তো কথাই নেই। মেঘে ঢাকা চাঁদের মতোই সে জীবনে অতীত উঁকি দেয় মাঝেমধ্যে।

বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর উপন্যাসগুলোতে কোনো চরিত্রকে নৈতিক স্খলনের জন্য শাস্তিপ্রদান করতেন। সাবুদ আলীর পরিণামও যেনো একই হলো। তাকে পঙ্গু করে পানিশমেন্ট দেওয়া হলো। তবে একজন ঋদ্ধ পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবে যে, এ উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে ঔন্যাসিককে অনেক দৌড়ঝাপ করতে হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ঘটনার বাস্তবতার জন্য সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে সবিস্তারে জানতে হয়েছে। সবিস্তারে যেমন জানতে হয়েছে বিভিন্ন গাড়ির মডেল এবং ব্যাবসার পলিসি।

ফুটপাতে চাঁদাবজি এখকার জনজীবনে নিত্যঘটনা মাত্র। বরং না হলেওই যেনো উলেটো মনে হয়। ওই যে, ভুক্তভোগী এক লোক যেমন বলেছিলেনÑএখানে বিদ্যুৎ যায় না, মাঝেমধ্যে আসে। উপন্যাসে যেমন কাহিনি থাকে তেমনই থাকে উপকাহিনি। এই কাহিনি এবং উপকাহিনির গ্রন্থন বা মেলবন্ধনই সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। কাহিনি যখন শিল্পোত্তীর্ণ হয় তথনই তা প্রাণ পায়; আর তখনই পাঠক রসে সিক্ত হয়। ভাবাবেগের জলে অবগাহন করে। আর এ রস সৃষ্টি করাই লেখক জীবনের সার্থকতা। উপন্যাসটিতে শৈল্পীকভাবেই ফুটে ওঠেছে হকারজীবনের নানা দিক।

সাংসারিক কেমেস্ট্রি সৃষ্টিতে কথাসাহিত্যিক তার সেরাটাই দিতে চেয়েছেন। উপন্যাসটি মিথ নির্ভর নয়, তবে রাজনীতি নির্ভরও বলা চলে। চরিত্রের মুখে গানের সংযোজন উপন্যাসটিকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা। ঘটনার পরম্পরা রক্ষা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। প্রাসঙ্গিক উপমার জগত থেকে ঘুরে এসে মূলে ফেরা সত্যিই অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অনেকে পরম্পরা রক্ষা করতে গিয়ে মূল থেকেই বিচ্যুত হয়ে পড়ে।

অপ্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে মানিক অন্যতম। তবে এটি খুবই স্পষ্ট যে, মানিক চরিত্রটি তেমন বিকশিত হয়নি। চরিত্রটি আরও একটু শক্তিশালী বা উজ্জ্বল করা যেতে পারত।

পুষ্পকথা উপন্যাসে কাদের অন্যতম প্রধান চরিত্র। সে এমএ পাস। ইচ্ছাশক্তি থাকলেই যে পড়াশোনার শেষপ্রান্তে পৌঁছা যায়Ñকাদেরের মাধ্যমেই ঔপন্যাসিক তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।

তবে তাঁর রচনায় বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে গ্রামীণ চরিত্রগুলো। বিশেষ করে, সিরাজ, রমিজা, মিনা, সাফিয়া, রিনা প্রমুখ চরিত্রগুলো। সাবুদ আলীর পরিবারে গ্রামীণ পরিবেশের পারিবারিক দ্ব›দ্ব সত্যিকার অর্থেই একেবারেই জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠেছে। পূর্ব এবং বর্তমান মিলিয়ে মনে হবে যেনোÑগ্রামীণ রাজনীতির একাল-সেকাল; যৌতুক লোভীদের একাল-সেকাল।

উপন্যাস হলো অনেকটা বটগাছের মতো। বটগাছে যেমন মূল কাÐের পাশাপাশি অনেক শাখা উপশাখা থাকে তেমনই থাকে উপন্যাসে। মূল কাহিনির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে নির্মাণ করা হয় উপকাহিনি। আবার অনেক উপন্যাসই থাকে পর্বে পবে সাজানো। আবার এ পর্বগুলো সময়ের ঐকমত্যে সাজানো। পুষ্পকথা উপন্যাসটিও বিভিন্ন পর্বে সাজানো। এসব পর্বের মেলবন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। দ্য দা ভিঞ্চিকোড উপন্যাসে ঔপন্যাসিক ড্যান ব্রাউন যেমন এক পর্বের সঙ্গে অন্য পর্বের কাহিনি, উপকাহিনি, সময়ের ঐক্য, অনুভূতির সরল ও জটিল রসায়নের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে রচনাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ঠিক তেমনই মোজাম্মেল হক নিয়োগীও তাঁর সর্বোচ্চটি দিয়ে চেষ্টা করেছে মজবুত গাঁথুনির।

পুষ্পর পতিতাবৃত্তির টাকা না গ্রহণের সিদ্ধান্ত মূলত ঔপন্যাসিকের নিজেরই সিদ্ধান্ত। ওই যে পদ্ম নদীর মাঝি উপন্যাসের শেষ সংলাপটি যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মনের কথাÑ“হ, কপিলাও চলুক”; কেবল তা প্রকাশ করেছে কুবেরের মুখে, অনেকটা সেরকমই।

উপন্যাসটিতে সরাসরি ইতিহাসের মন্থন নেই; তবে কখনো সখনো উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিক ইতিহাস। তবে ঔপন্যাসিকের আদর্শিক মনোভাবের কারণে অনেক চরিত্রই রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। প্রথম পর্বে পুষ্প এবং কাদেরের ভাড়া বাসার অবস্থান ও প্রকৃতির মধ্যে উঠে এসেছে দেশীয় দুর্নীতির চালচিত্র। সেখানে রাজউকের কর্মকর্তাদের চরিত্রকেও নৈতিকতার পাল্লায় তুলে বিচার করা হয়েছে।

পরিশ্রমে যে ভাগ্যের পরিবর্তন হয় সে দিকটি ঔপন্যাসিক মাথায় রেখেই তিনি তাঁর প্লটের বীজতলা সাজিয়েছেন। তবে উপন্যাসের শেষপ্রান্তে এসে মনে হয়েছে লেখক যেনো অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই কাদের চরিত্রের যবনিকা টেনেছেন। কাদেরের মৃত্যুতে পাঠক অনেকটাই শোকাহত হবে। হয়ত কারও কারও হৃদয়ে গভীর ক্ষরণও হতে পারে। বলা যায়Ñ শেষপর্বে এসে পাঠকের চিন্তায় বিবমিষা লেগে থাকে। চিন্তর ক্ষরণ ঘটতে থাকেÑবিয়টি অন্যরকমও হতে পারত। অন্যভাবেও শেষ করা যেতে পারত। কাদেরকে জীবিত রেখেও উপন্যাসটি চলতে পারত। দেশীয় রাজনীতির শিকার অন্য চরিত্রগুলোকেও করা যেতে পারত। কাদেরের মৃত্যু অপ্রত্যাশিত। অনেকটা ভুল সিদ্ধান্তের ফসল। আর এ কারণে পুষ্পের তুলনায় বলা যায়Ñলেখকের অনিচ্ছা সত্তে¡ও প্রধান চরিত্র হিসেবে পাঠকের মনোবীণায় উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় কাদের চরিত্রটি। ফলে নামকরণ হিসেবে পুষ্পকথা অনেকটাই ¤øান হয়ে যায়।

উপন্যাস হলো যুতসই আবেগঘন কাহিনির মোড়কে সময়ের দর্পণ। পুুষ্পকথা উপন্যাসে উল্লিখিত চরিত্রগুলোকে ঔপন্যাসিক মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।

ডাক্তারের সিরিয়াল লেখক তথা কম্পাউন্ডারের ছোটোখাট দুর্নীতির চিত্রও অত্যন্ত নিপুণভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোকে এমন জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়Ñছিনতাই যেনো শহরের নিত্যঘটনা। উপন্যাসে ক্রমে উঠে এসেছে দেশীয় রাজনীতির ভয়াল ছাপ; বিশেষ করে ১৯৯৬, ২০০১ সালের ভয়াভহ রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র। এছাড়াও উঠে এসেছে ঢাকার জনজীবন, ব্যতিব্যস্ততা, রিকশাচালকদের প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, বিশ^রাজনীতি, টুইন টাওয়ার হামলা, ইরাক দখল, ছাড়াও দেশীয় রাজ রাজনৈকিত অস্থিরতার চিত্রসহ তার প্রভাব।

নারীবাদী চরিত্র হিসেবে নীপা অনেকটাই উজ্জ্বল। এই চরিত্রটি উপন্যাসটিকে দিয়েছে বিশেষ ব্যঞ্জনা। ভিলেজ পলিটিক্সের জীবন্ত চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে সাবুদ আলী চরিত্রে।

নদী দখলকারীদের মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেছেন বর্তমানের চিত্রকে। এককথায়, পুষ্পকথা উপন্যাসটিতে চরিত্র অনুযায়ী চেহারা বর্ণন, আধুনিক জীবন, লিভ টুগেদার, স্থানের যর্থার্থতা, হকারদের প্রাত্যহিক জীবনে শক্তিমানদের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম, সংগ্রামী নারী হিেেসবে পুষ্পার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পÑসবকিছুকেই মনে হয় চিরচেনা গল্প। চরিত্রগুলোকে মনে হয় চিরচেনা। তবে কিছু চরিত্র সৃষ্টি অহেতুক মনে হয়েছে। বোদ্ধা পাঠকের কাছে তা দৃষ্টিকটুও লাগতে পারে। চরিত্রের অতিরঞ্জন মৌলিক উপন্যাসের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এছাড়াও উপন্যাসের কয়েকটি পর্বে রার বার মদের বারে গিয়ে মাসুদ, গৌতম ও কাদেরের আড্ডার বিষয়টি যুতসই মনে হয়নি। মনে হয়েছে কিছুটা হলেও বাস্তবতা ক্ষুণœ হয়েছে।

গ্রামের এক দারিদ্র্য পরিবারের ছেলে হয়েও কাদের কীভাবে লেখাপড়া করল? এখানেই পাওয়া যায় গ্রাম বাংলার মায়েদের আত্মত্যাগের দৃশ্য। চুরি করে পাট বিক্রি করে, লুকিয়ে চাল বা ধান বিক্রি করে ছেলেকে লেখাপড়ার করানোর গ্রামের মায়েদের চিরাচরিত ঘটনা এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে নির্মোহভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী পারে পুষ্প জীবনতরী বেয়ে যেতে? উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে নিম্নশ্রেণি মানুষের জীবনসংগ্রাম, পুঁজিবাদ সমাজে উচ্চবিত্তের ভোগবিলাস… প্রেম, বিচ্ছেদ, লিভটুগেদার ইত্যাদি সব মিলিয়ে যেনো বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্রই ফুটে ওঠেছে পুষ্পকথা উপন্যাসে।

ঔপন্যাসিক নিজের আদর্শ দিয়ে রূপায়ণ করেছেন মূল চরিত্রটি। উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে তিনি যেমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনই বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন চরিত্রগুলোর সংলাপ চয়নে। কিছু সংখ্যক বানান প্রমাদ, কোথাও কোথাও অতিরঞ্জিত বয়ান সত্তে¡ও উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সামাজিক উপন্যাসের জন্য, ত্রয়ী উপন্যাসের জন্য মাইলফলক স্বরূপ।
মোজাম্মেল হক নিয়োগী যেমন নিপুণ শব্দশ্রমিক তেমন দক্ষ শব্দকারিগরও। কথার বুননে তিনি সিদ্ধহস্থ। তাঁর উপন্যাস পড়া শেষ হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টায় কিন্তু এর রেশ থেকে যায় জীবনের বাঁকে বাঁকে। তাঁর কর্মগুণে সময়ই হয়ত তাঁকে একদিন পৌঁছে দেবে সাহিত্যের সর্বোচ্চ শিখরে। বোদ্ধা পাঠক আর মহাকালের হাতেই রইলো তাঁর সাহিত্যের প্রকৃত বিচার। জয়তু কথাসাহিত্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *