পলাশীর যুদ্ধ: কারণ, ফলাফল ও প্রভাব


পলাশীর যুদ্ধ: কারণ, ফলাফল ও প্রভাব

ভূমিকা

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ কেবল বাংলার ইতিহাসেই নয়, সমগ্র ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনকারী এক মহাগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাধান্য, দুর্বল হয়ে পড়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা, আর ক্রমে শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ অধ্যায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সীমাহীন প্রতিকূলতা, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, কোম্পানির রাজনৈতিক কূটচাল এবং মীরজাফর–জগৎশেঠ–রাজবল্লভদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই পলাশীর ময়দানে পরাজয় আসে। যুদ্ধের কারণ, তার তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এত গভীর যে এটিকে ভারতীয় উপনিবেশগত ইতিহাসের সূচনা বিন্দু বলা চলে।


১. পলাশীর যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা

আঠারো শতকের মধ্যভাগে বাংলা ছিল সমৃদ্ধ অর্থনীতি, উন্নত বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের এক শক্তিশালী জনপদ। কোম্পানি এ অঞ্চলে বাণিজ্য সুবিধা পেলেও তারা চাইছিল অধিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফর্টিফিকেশন’ সুবিধা। অন্যদিকে তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা কঠোরভাবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। ফলে নবাব ও কোম্পানির সম্পর্কে উত্তেজনা তীব্র হয়ে ওঠে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চাকাঙ্ক্ষা

বাণিজ্যের নামে কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ। তাদের হাতে ছিল প্রচুর সম্পদ, বিশেষ করে বাংলা থেকে পাওয়া বাণিজ্যলাভ। ইংরেজেরা ফোর্ট উইলিয়াম শক্তিশালী করতে চাইলে সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন—এটি তাঁর সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

ঔপনিবেশিক কৌশলে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র

বাংলার দরবারে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ধনকুবের শ্রেণির লোভ, এবং মীরজাফরের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোম্পানির পরিকল্পনাকে আরও সহজ করে তোলে। জগৎশেঠ ও কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নবাবের নীতি ও কঠোরতার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।


২. পলাশীর যুদ্ধের কারণ

যুদ্ধের মূল কারণগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সমন্বয়।

ক. রাজনৈতিক কারণ

১. নবাব ও কোম্পানির অবিশ্বাস

সিরাজউদ্দৌলা ক্ষমতায় আসামাত্রই কোম্পানির কার্যকলাপে সন্দিহান হন। কোম্পানি নবাবকে না জানিয়ে দুর্গ নির্মাণ ও অস্ত্র মজুত করছিল।

২. ইংরেজদের ‘ফর্টিফিকেশন’ সংকট

ইংরেজরা কলকাতা দুর্গ (ফোর্ট উইলিয়াম) শক্তিশালী করছিল। নবাব এটিকে সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেন।

৩. নবাবের দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান

সিরাজউদ্দৌলার দৃঢ়তা ইংরেজদের কাছে অপছন্দনীয় হয়; তারা চাইছিল দুর্বল ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য একজন নবাব।

খ. অর্থনৈতিক কারণ

১. বাণিজ্য শুল্ক সংক্রান্ত বিরোধ

কোম্পানি ‘দস্তক’ ব্যবহারের মাধ্যমে শুল্ক এড়িয়ে বিশাল লাভ করছিল। নবাব এই অবৈধ সুবিধা বন্ধ করতে চাইলে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়।

২. বাংলা–বাণিজ্যের ওপর ইংরেজ প্রভাব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা

কোম্পানি চেয়েছিল—বাংলার সম্পদ, বিশেষত বস্ত্র, নীল, লবণ, রেশম—তাদের নিয়ন্ত্রণে আসুক।

গ. ব্যক্তিগত ও অভ্যন্তরীণ কারণ

১. মীরজাফরের অসন্তোষ

সিরাজউদ্দৌলা সেনাপতি মীরজাফরকে বরখাস্ত করার পর তিনি নবাবের ওপর ক্ষুব্ধ হন।

২. জগৎশেঠ ও ধনকুবেরদের ষড়যন্ত্র

নবাবের আর্থিক নীতি জগৎশেঠদের স্বার্থে আঘাত হানায় তারা কোম্পানির সঙ্গে হাত মেলায়।

৩. নবাব দরবারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব

ইয়ারলতিফ, রাজবল্লভ, কৃষ্ণদাস প্রভৃতি ব্যক্তিরা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন।


৩। পলাশীর যুদ্ধ (২৩ জুন ১৭৫৭)

ভাগীরথীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী সংখ্যায় বহু হলেও মীরজাফর ও তাঁর অনুসারীদের ৯০% সৈন্য যুদ্ধেই যোগ দেয়নি। ইংরেজ বাহিনী ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট, কিন্তু রবার্ট ক্লাইভের কৌশল, কামান প্রযুক্তি এবং পূর্বনিয়োজিত বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে।

যুদ্ধের প্রকৃত সংঘর্ষ মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মীরমদন ও মোহনলাল বীরত্ব দেখালেও বিশ্বাসঘাতকতার কাছে নবাবের বাহিনী টিকতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নবাব পিছু হটে বগুড়ায় পালান এবং পরবর্তীতে ধরা পড়ে নিহত হন।


৪। পলাশীর যুদ্ধের তাৎক্ষণিক ফলাফল

১. মীরজাফরের নবাব হওয়া

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ক্রীতদাস-শাসক হিসেবে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসায়।

২. কোম্পানির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা

দেওয়ানি, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন—সবকিছুতে কোম্পানি কর্তৃত্ব বিস্তার করে।

৩. বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন

পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজেরা বাংলার অর্থভাণ্ডার হস্তগত করে। ক্লাইভসহ কোম্পানির অনেক কর্মকর্তা দুর্লভ ধনসম্পদ লুট করে ধনী হয়ে ওঠেন।

৪. প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অস্থিরতা

বাংলায় লুটপাট, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং দুর্বল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।


৫। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

ক. রাজনৈতিক প্রভাব

১. কোম্পানি-বাহিত ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা

পলাশী ছিল ইংরেজ শাসনের প্রথম ধাপ। পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করে ব্রিটিশরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রকৃত শাসক হয়।

২. ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি

এই জয় ইংরেজদের অসীম আত্মবিশ্বাস দেয় এবং সমগ্র ভারতে তাদের শাসন বিস্তারের পথ সুগম করে।

খ. অর্থনৈতিক প্রভাব

১. বাংলার শিল্প-বাণিজ্যের পতন

বিশেষ করে মসলিন ও রেশম শিল্প ভেঙে পড়ে। ইংরেজ শাসনে ভারতীয় শিল্পীর স্বাধীনতা সীমিত হয়।

২. কোম্পানির ধনসম্পদ বৃদ্ধি

বাংলা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজস্বের মূল উৎস।

৩. দুর্ভিক্ষের পূর্বভূমি সৃষ্টি

১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্র তৈরি হয় পলাশীর পরবর্তী লুণ্ঠন, রাজস্বনীতি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে।

গ. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

১. সমাজে অনিশ্চয়তা ও বিভেদ

নবাব দরবারের পতন, জমিদার শ্রেণির পুনর্গঠন এবং শোষণমূলক কাঠামো সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে।

২. শিক্ষার রূপান্তর

ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ১৮৩৫-এর পর ভারতীয় মূল্যবোধের ওপর চাপ সৃষ্টি করে; তবে নতুন মধ্যবিত্তের উত্থানও ঘটে।

৩. জাতীয় চেতনার বীজ

পলাশীর পরাজয় পরবর্তীকালে ভারতীয়দের মধ্যে প্রতিরোধ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উজ্জীবিত করে।


৬। পলাশীর যুদ্ধ: একটি ঐতিহাসিক মূল্যায়ন

এই যুদ্ধ একটি বৃহৎ সামরিক সংঘর্ষ নয়; এটি ছিল বিশ্বাসঘাতকতা ও উপনিবেশিক কৌশলের আদর্শ উদাহরণ। সংখ্যায় বৃহৎ সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দুর্বল নেতৃত্ব একটি সমৃদ্ধ, স্বাধীন বাংলাকে পতনের পথে ঠেলে দেয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন তরুণ ও দৃঢ়চিত্ত, কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও পরামর্শদাতার অভাব তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করে। ইংরেজরা এশীয় রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিল, তারা দুর্বলতা বুঝতে পেরে সেটিই কাজে লাগায়।


পলাশীর যুদ্ধ ছিল বাংলার ইতিহাসে এক করুণ মোড়। এই যুদ্ধের ফলেই ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরের দাসত্বের যাত্রা শুরু হয়। বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয় শিল্প-বাণিজ্য, ক্ষয়প্রাপ্ত হয় সংস্কৃতি, দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হয় জনজীবন। যুদ্ধটি আমাদের শেখায়—অভ্যন্তরীণ ঐক্যের অভাব, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা একটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে পারে। পলাশীর পরাজয় তাই শুধু ইতিহাস নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও সতর্কবার্তা।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *