পদ্মা কবিতা : সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ
পদ্মা কবিতা ফররুখ আহমদ কবি-পরিচিতি : ফররুখ আহমদের জন্ম ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। কর্মজীবনে বহুবিচিত্র পেশা অবলম্বন করেছেন তিনি।
তবে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকাল ধরে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন ঢাকা বেতারে ‘স্টাফ রাইটার’ হিসেবে। চল্লিশের দশকে আবির্ভূত শক্তিমান কবিদের অন্যতম ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে।
এরপর একে একে তাঁর অনেক কাব্যগ্রন্থ, কাব্যনাট্য ও কাহিনিকাব্য প্রকশিত হয়েছে। ইসলামি ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী এ কবির কবিতায় প্রধানত প্রকাশ ঘটেছে ইসলামি আদর্শ ও জীবনবোধের। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলোর নাম- কাব্যগ্রন্থ: ‘সিরাজাম মুনীরা’; কাব্যনাট্য: ‘নৌফেল ও হাতেম’; সনেট সংকলন: ‘মুহূর্তের কবিতা’ এবং কাহিনিকাব্য: ‘হাতেম তায়ী’।
এছাড়া তিনি ছোটদের জন্য বেশ কিছু ছড়া ও কবিতা লিখে গেছেন। সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেছেন এবং মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
**পদ্মা কবিতা ফররুখ আহমদ**
অনেক ঘূর্ণিতে ঘুরে, পেয়ে চের সমুদ্রের স্বাদ,জীবনের পথে পথে অভিজ্ঞতা কুড়ায়ে প্রচুরকেঁপেছে তোমাকে দেখে জলদস্যু- দুরন্ত হার্মাদতোমার তরঙ্গভঙ্গে বর্ণ তার হয়েছে পাণ্ডুর।সংগ্রামী মানুষ তবু দুই তীরে চালায়ে লাঙলকঠিন শ্রমের ফল শস্য দানা পেয়েছে প্রচুর;
উর্বর তোমার চরে ফলায়েছে পর্যাপ্ত ফসলজীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে নিঃসংশয়, নির্ভীক জওয়ানসবুজের সমারোহে জীবনের পেয়েছে সম্বল।বর্ষায় তোমার স্রোতে গেছে ভেসে সাজানো বাগান,অসংখ্য জীবন, আর জীবনের অজস্র সম্ভার,হে নদী! জেগেছে তবু পরিপূর্ণ আহ্বান,মৃত জড়তার বুকে খুলেছে মুক্তির স্বর্ণবারতোমার সুতীব্র গতি। তোমার প্রদীপ্ত স্রোতধারা ॥
ফররুখ আহমদের ‘পদ্মা’ কবিতাটি ‘কাফেলা’ (১৯৮০) নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। ‘কাফেলা’ কাব্য সাতটি সনেটের সমন্বয়ে রচিত। সংকলনভুক্ত কবিতাটি পাঁচ সংখ্যক সনেট। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। এসবের মধ্যে পদ্মা সর্ববৃহৎ। “পদ্মা” কবিতায় এ নদীর দুই রূপ প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে এর ভয়ংকর, প্রমত্ত রূপ- যা দেখে বহু সমুদ্র ঘোরার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, দুরন্ত জলদস্যুদের মনেও ভয়ের সঞ্চার হয়। অন্যদিকে, পদ্মার পলিতে প্লাবিত এর দুই পাড়ের উর্বর ভূমি মানুষকে দিয়েছে পর্যাপ্ত ফসল, জীবনদায়িনী সবুজের সমারোহ।
আবার, এই পদ্মাই বর্ষাকালে জলস্রোতে স্ফীত হয়ে ভাসিয়ে নেয় মানুষের সাজানো বাগান, ঘর, এমনকি জীবন পর্যন্ত। সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে আবারও প্রাণের স্পন্দন জেগে ওঠে পদ্মাকে ঘিরেই। অর্থাৎ একই পদ্মা কখনও ধ্বংসাত্মক রূপে, কখনও কল্যাণময়ী হয়ে এদেশের জনজীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। ‘পদ্মা’ চতুর্দশপদী (sonnet) কবিতা। তিন পঙ্ক্তিযুক্ত চারটি স্তবক এবং শেষে দুই পঙ্ক্তিযুক্ত একটি স্তবকে কবিতাটি বিন্যস্ত। প্রতি পঙ্ক্তিতে রয়েছে ১৮ মাত্রা। কবিতাটির মিলবিন্যাস কখক খগখ গঘগ ঘঙঘ ঙঙ।