মানবসভ্যতার প্রাচীনতম কৌতূহলের একটি হলো রাতের আকাশ। অগণিত নক্ষত্রের এই বিস্তৃত কালো মঞ্চে মানুষ খুব তাড়াতাড়িই কিছু নির্দিষ্ট নক্ষত্রকে জোড়া লাগিয়ে আকার তৈরি করতে শুরু করে। এই বিশেষ গুচ্ছ বা বিন্যাসকেই বলা হয় নক্ষত্রমণ্ডলী বা Constellation। খালি চোখে আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় যেন এই নক্ষত্রগুলো একসাথে কাছাকাছি অবস্থান করছে এবং মিলে কোনো ছবি বা চিহ্ন তৈরি করেছে। কিন্তু বাস্তবে নক্ষত্রমণ্ডলী কোনো প্রকৃত গুচ্ছ নয়—এগুলো কেবল আকাশের দ্বিমাত্রিক মানচিত্রে মানুষের কল্পিত রেখাচিত্র।
নক্ষত্রমণ্ডলী আসলে কী?
বৈজ্ঞানিক ভাষায়, নক্ষত্রমণ্ডলী হলো আকাশের নির্দিষ্ট অংশ চিহ্নিত করার একটি পদ্ধতি। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংঘ (IAU) বর্তমানে আকাশকে ৮৮টি স্বীকৃত নক্ষত্রমণ্ডলীতে ভাগ করেছে, যাতে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা সহজ হয়।
যেসব নক্ষত্রকে আমরা একই মণ্ডলীর অংশ ভাবি—
- তারা একে অন্যের কাছে অবস্থান করে না,
- তাদের দূরত্ব ভিন্ন,
- অনেক সময় তাদের বয়স, গঠন ও উজ্জ্বলতাও ভিন্ন।
শুধু পৃথিবী থেকে দেখলে তাদের অবস্থান এমনভাবে সাজানো মনে হয় যেন তারা একটি পরিচিত আকার তৈরি করেছে।
নক্ষত্রমণ্ডলী কীভাবে তৈরি হলো?
প্রাচীন যুগে মানুষ আকাশকে গল্প, দেবতা, প্রাণী, অস্ত্র বা দৈনন্দিন জীবনের উপকরণের আকৃতি হিসেবে কল্পনা করত।
যেমন:
- ওরায়ন—একজন শিকারী,
- ঊরসা মেজর—একটি বিশাল ভালুক,
- কর্কট, সিংহ, কন্যা—রাশিচক্রের অংশ।
এই কল্পনা ছিল নাবিক, কৃষক, ভ্রমণকারী ও যোদ্ধাদের পথ নির্দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋতু পরিবর্তন, কৃষিকাজের সময়, দিকনির্ণয়—সবকিছুতেই নক্ষত্রমণ্ডলী ছিল পথপ্রদর্শক।
নক্ষত্রমণ্ডলীগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ?
১. মানমন্দিরের আকাশ-মানচিত্র
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যের কোনো বস্তু কোথায় আছে তা বোঝাতে নক্ষত্রমণ্ডলীকে নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করেন।
২. দিকনির্ণয় ও সময় গণনা
পোলারিস বা ধ্রুবতারা সবসময় উত্তর দিকে থাকে। তাই নক্ষত্রমণ্ডলী প্রাচীন নাবিকদের জন্য ছিল কম্পাসের মতো।
৩. ঋতু ও কৃষিকাজ
অনেক দেশেই নির্দিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলীর উদয় বা অস্ত দেখে বছরের সময় নির্ধারণ করা হতো।
৪. সংস্কৃতি ও পুরাণ
গল্প, ধর্ম, শিল্প—সব জায়গায় নক্ষত্রমণ্ডলীর ছাপ দেখা যায়।
নক্ষত্রমণ্ডলী বনাম নক্ষত্রগুচ্ছ
অনেকে এই দুইকে এক মনে করেন, কিন্তু তারা এক নয়।
- নক্ষত্রমণ্ডলী: কল্পিত রেখাচিত্র—নক্ষত্রগুলো একই জায়গায় নেই।
- নক্ষত্রগুচ্ছ (Star Cluster): বাস্তবে কাছাকাছি অবস্থান করা নক্ষত্রদের দল, যেমন প্লিয়াডিস।
নক্ষত্র কেন একই মণ্ডলীতে দেখা যায়?
এটি পৃথিবীর দৃষ্টিকোণের কারণে। আকাশকে আমরা গম্বুজের মতো ধরে নিই এবং তাতে নক্ষত্রগুলোকে প্রক্ষেপ করি। এ কারণে পৃথিবী থেকে একই দিক থেকে দেখা নক্ষত্রগুলোকে আমরা একটি নির্দিষ্ট চিত্রে দেখেছি।
কিছু জনপ্রিয় নক্ষত্রমণ্ডলী
- ওরায়ন — শিকারী
- ঊরসা মেজর — সপ্তর্ষিমণ্ডলী
- স্করপিয়াস — বিচ্ছু
- লিও — সিংহ
- সিগনাস — রাজহাঁস
- ক্যাসিওপিয়া — ‘W’ আকৃতির রানি
এগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পথ নির্দেশনা ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।