🖋️ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

🔹 পরিচয়
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (২২ জুলাই, ১৮৪৭ – ৩ নভেম্বর, ১৯১৯) ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম বাঙালি সাহিত্যিক, যিনি বাংলা ব্যঙ্গকৌতুক সাহিত্যের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি সরকারি চাকরিজীবী, কিউরেটর এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।
🔹 জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
🔸 জন্ম: ২২ জুলাই ১৮৪৭, রাহুতা গ্রাম, চব্বিশ পরগনা জেলা, ব্রিটিশ ভারত
🔸 পিতা: বিশ্বম্ভর মুখোপাধ্যায়
🔸 মাতা: ভবসুন্দরী দেবী
🔸 মৃত্যু: ৩ নভেম্বর ১৯১৯, কলকাতা
🔹 শিক্ষা ও কর্মজীবন
ত্রৈলোক্যনাথ চুঁচুড়ার ডাফ সাহেবের স্কুলে এবং ভদ্রেশ্বরের কাছে তেলিনীপাড়া বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। সংসারের অসচ্ছল অবস্থার জন্য ১৮৬৫ সালে বাড়ি থেকে রোজগারের জন্য চলে যান এবং নানা দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথমে দ্বারকা (বীরভূম) উখড়া (রাণীগঞ্জ) এবং শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রভৃতি স্থানে শিক্ষকতার কাজ করেন। কিন্তু কোথাও কাজ পছন্দ না হওয়ায় কটকে চলে যান। ১৮৬৮ সালে কটকে জেলার পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর হন। কটকে ওড়িয়া ভাষা শিখে ওড়িয়া ‘উৎকল শুভকরী’ নামে মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পুলিশের চাকরি করাকালীন বিখ্যাত স্যার উইলিয়াম হান্টার সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হন। হান্টার সাহেব এঁর কথাবার্তা এবং অগাধ পান্ডিত্যে সন্তুষ্ট হয়ে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় নিজের বেঙ্গল গেজেটিয়ার সংকলন অফিসে কেরানীর পদে নিযুক্ত করেন। এরপর ইনি উত্তর পশ্চিম প্রদেশের কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের অফিসে প্রধান কেরানীর পদে নিযুক্ত হন। পরে বিভাগীয় ডাইরেক্টরের একান্ত সহকারী হন।
১৮৭৭-১৮৭৮ সালে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হলে তিনি প্রাণ বাঁচানোর জন্য গাজর চাষ করার জন্য সরকারকে উপদেশ দেন। তার কথানুযায়ী সরকার ১৮৮৭ সালে কয়েকটি জেলায় গাজরের চাষ করার বন্দোবস্ত করেন। এর ফলে দু বছর পরে রায়বেরিলী ও সুলতানপুর জেলায় দুর্ভিক্ষের সময় তার প্রস্তাবিত গাজর চাষের জন্য বহু প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।
১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে ভারত সরকারের রাজস্ব বিভাগে বদলী হন। সেই সময় ইনি উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পোন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেন এবং বিশেষ কৃতকার্যও হন। ১৮৮৩ সালে কলকাতায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে কয়েকটি বিষয়ে অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাজ্যে প্রদর্শনী আরম্ভ হয় তখন ত্রৈলোক্যনাথকে সেখানে পাঠানো হয়। সেই সময় তিনি ইউরোপের নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন এবং এ ভিজিট টু ইউরোপ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইটিতে তার সমস্ত কাজ ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত রয়েছে।
১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে এই বিভাগ ত্যাগ করে কলকাতা মিউজিয়ামে সহকারী কিউরেটর হন । ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে দেশীয় শিক্ষা বাণিজ্যে যাতে উন্নতি হয় তার যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কলকাতা, বোম্বে প্রভৃতি বড় বড় শহরে এবং বড় বড় রেলস্টেশনে ভারতীয় কারুকার্যের যে সকল দোকান দেখতে পাওয়া যায় তা এঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময় ইনি সরকারের অনুমতিক্রমে আর্ট ম্যানুফ্যাকচারারস অফ ইন্ডিয়া নামক একটি বই লেখেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে যে সব শিল্প দ্রব্য নির্মিত হত সেই সব শিল্প দ্রব্যের একটি তালিকা ইংরাজীতে প্রকাশ করেন। ত্রৈলোক্যনাথ বর্ধমানে থাকাকালীন ফার্সি ভাষা শিক্ষা করে অভূতপূর্ব নাম করেছিলেন।
🔸 পড়াশোনা করেন চুঁচুড়ার ডাফ সাহেবের স্কুল এবং তেলিনীপাড়া বিদ্যালয়ে।
🔸 জীবিকার সন্ধানে ছোটবেলায় বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতা করেন।
🔸 ১৮৬৮ সালে কটকে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন।
🔸 কটকে ওড়িয়া ভাষা শেখেন এবং “উৎকল শুভকরী” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
🔸 স্যার উইলিয়াম হান্টারের নজরে পড়ে কলকাতায় গেজেটিয়ার অফিসে নিযুক্ত হন।
🔸 ইউরোপ ভ্রমণ করে রচনা করেন: “A Visit to Europe”।
🔸 কলকাতা মিউজিয়ামের সহকারী কিউরেটর ছিলেন।
🔸 “Art Manufacturers of India” ও “List of Indian Economic Products” প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন।
🔹 সাহিত্যকর্ম ও অবদান
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গ, কৌতুক ও উদ্ভট রসের সূচনা করেন। তার রচনায় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও গভীর মানবিক বোধ মিলেমিশে এক অভিনব স্বাদ সৃষ্টি করেছে।
📚 উল্লেখযোগ্য রচনা:
🔸 কঙ্কাবতী
🔸 ভূত ও মানুষ
🔸 ডমরু-চরিত
🔸 ফোকলা দিগম্বর
🔸 নয়নচাঁদের ব্যবসা
🔸 বীরবালা
🔸 লুল্লু
🔸 জাপানের উপকথা
🔸 পিঠে-পার্বণে চীনে ভূত
🔸 মেঘের কোলে ঝিকিমিকি সতী হাসে ফিকিফিকি
🔸 A Handbook of Indian Products
🔸 A Descriptive Catalog of Products
🔹 সাহিত্য মূল্যায়ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “কঙ্কাবতী” সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন—
“এইরূপ অদ্ভুত রূপকথা ভাল করিয়া লেখা বিশেষ ক্ষমতার কাজ।… এমন লেখকের অভ্যুদয় বাঙালি শিশুসাহিত্যে একটি আশাব্যঞ্জক দিক।”
🔹 মৃত্যুবরণ
১৯১৯ সালের ৩ নভেম্বর, এক দুর্ঘটনায় ঝর্ণা কলম বুকে ফুটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি পরলোকগমন করেন।
🔹 উপসংহার
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গরসের অন্যতম প্রবর্তক। তাঁর লেখায় যেমন সমাজ-বাস্তবতার কটাক্ষ আছে, তেমনি আছে এক চমকপ্রদ কল্পনাশক্তির খেলা। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।
https://www.munshiacademy.com/ত্রৈলোক্যনাথ-মুখোপাধ্যা/