“তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা…”
— শামসুর রাহমান
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হেGধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো । রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম ।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর ।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা-মাতার লাশের উপর ।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে থুথুড়ে এক বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল ।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে ।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজি তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে –
সেই তেজি তরুণ যার পদভারে
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
(সংক্ষেপিত)
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
এখানে শামসুর রাহমানের “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা” কবিতা এবং তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর ভিত্তি করে ১৫টি বহুনির্বচনি প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হলো:
- শামসুর রাহমানের কবিতার কোন গ্রন্থ থেকে “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা” কবিতাটি নেওয়া হয়েছে?
- A) বন্দী শিবির থেকে
- B) রৌদ্র করোটিতে
- C) বিধ্বস্ত নীলিমা
- D) নিরালোকে দিব্যরথ
উত্তর: A) বন্দী শিবির থেকে
- শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস কোথায়?
- A) ঢাকা
- B) চট্টগ্রাম
- C) নরসিংদী
- D) কুষ্টিয়া
উত্তর: C) নরসিংদী
- শামসুর রাহমানের কোন কবিতার নাম “বন্দী শিবির থেকে”?
- A) স্বাধীনতার কবিতা
- B) আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি
- C) দুঃসময়ের মুখোমুখি
- D) বন্দী শিবির থেকে
উত্তর: D) বন্দী শিবির থেকে
- “খাণ্ডবদাহন” শব্দটি কবিতায় কোন ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে?
- A) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
- B) ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
- C) ১৯৭৫ সালের জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড
- D) ১৯৪৭ সালের দেশভাগ
উত্তর: A) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
- কবিতার “সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর” কাকে ইঙ্গিত করে?
- A) মুক্তিযুদ্ধের শহীদ
- B) সাধারণ জনগণ
- C) হিন্দু ধর্মের বিধবা নারীরা
- D) শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী
উত্তর: C) হিন্দু ধর্মের বিধবা নারীরা
- “যত্রতত্র” শব্দের অর্থ কী?
- A) বিশেষ স্থান
- B) সব জায়গায়
- C) একত্রিত
- D) নির্দিষ্ট সময়
উত্তর: B) সব জায়গায়
- শামসুর রাহমান ১৯৭১ সালে কি করেছিলেন?
- A) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন
- B) যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেন
- C) সাংবাদিকতা করেছিলেন
- D) দেশত্যাগ করেন
উত্তর: C) সাংবাদিকতা করেছিলেন
- শামসুর রাহমানের প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে কোনটি নেই?
- A) রৌদ্র করোটিতে
- B) বিধ্বস্ত নীলিমা
- C) নিজ বাসভূমে
- D) পৃথিবীর আলো
উত্তর: D) পৃথিবীর আলো
- শামসুর রাহমান ২০০৬ সালে কোন তারিখে মৃত্যুবরণ করেন?
- A) ১ জানুয়ারি
- B) ১৭ আগস্ট
- C) ২৫ ডিসেম্বর
- D) ১৫ মার্চ
উত্তর: B) ১৭ আগস্ট
- কবিতায় “ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো” অর্থ কী?
- A) শান্তির প্রতীক
- B) মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা
- C) ছাত্রদের প্রতিবাদ
- D) সামরিক শক্তি
উত্তর: B) মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা
- কবিতায় “হরিণের হাড়” কীসের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?
- A) মুক্তিযুদ্ধের সাহস
- B) শহীদদের রক্ত
- C) প্রাকৃতিক দুর্যোগ
- D) মানবিক বিপর্যয়
উত্তর: B) শহীদদের রক্ত
- “রুস্তম শেখ এখন পোকার দখলে” এই পংক্তি কী নির্দেশ করে?
- A) প্রাচীন ঐতিহ্য
- B) এক শহীদ ব্যক্তির মরদেহ
- C) শহরীয় প্রেক্ষাপট
- D) যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশ
উত্তর: B) এক শহীদ ব্যক্তির মরদেহ
- “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা” কবিতার মূল ভাব কী?
- A) সংগ্রামের জয়
- B) দেশভাগের ক্ষতি
- C) স্বাধীনতা অর্জনের পথের সংগ্রাম
- D) রাজনৈতিক অধিকার
উত্তর: C) স্বাধীনতা অর্জনের পথের সংগ্রাম
- “বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে” কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত?
- A) প্রথম গান
- B) রৌদ্র করোটিতে
- C) বন্দী শিবির থেকে
- D) দুঃসময়ের মুখোমুখি
উত্তর: C) বন্দী শিবির থেকে
- শামসুর রাহমানের কাব্যধারায় কি ধরনের চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়?
- A) প্রকৃতি ও গ্রামীণ জীবন
- B) আধুনিক শহর জীবন
- C) ঐতিহাসিক কাহিনীগুলো
- D) ধর্মীয় উত্সব
উত্তর: B) আধুনিক শহর জীবন
আরও কিছু নহুনির্বাচনি প্রশ্ন
#.
তেজি তরুণ রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় –
i. স্বাধীনতার জন্যে
ii. শত্রু হননের জন্যে
iii. অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞে
নিচের কোনটি সঠিক?
i ও ii
i ও iii
ii ও iii
i, ii ও iii
বাংলা সাহিত্য তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
#.
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কবিতায় রুস্তম শেখের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে—
i. নৌকার
ii. রিকশার
iii. ফুসফুসের পোকার
নিচের কোনটি সঠিক?
i ও ii
i ও iii
ii ও iii
i, ii ও iii
কবি পরিচিতি
📅 শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৪শে অক্টোবর ঢাকার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রাম। তাঁর পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা আমেনা খাতুন। তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পেশা ছিল সাংবাদিকতা, কিন্তু কবিতা লিখতে ছিলেন একনিষ্ঠ।
শামসুর রাহমানের কবিতায় বিশেষত মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, বৈরাগ্য এবং সংগ্রামের কথা স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতায় আধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য যেমন উপমা ও চিত্রকল্পের সার্থক ব্যবহার, তেমনি বিষয়বস্তু ও উপাদানে শহরকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রধান কাব্যগ্রন্থসমূহ:
- প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
- রৌদ্র করোটিতে
- বিধ্বস্ত নীলিমা
- নিরালোকে দিব্যরথ
- নিজ বাসভূমে
- বন্দী শিবির থেকে
- দুঃসময়ের মুখোমুখি
- ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
- এক ধরনের অহংকার
- আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি
- আমি অনাহারী
- বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে
এছাড়া তাঁর কিছু অনুবাদ-কবিতা ও শিশুতোষ কবিতাও রয়েছে। শামসুর রাহমান তাঁর অসাধারণ কাব্যকৃতির জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
শব্দার্থ ও টিকা
- খাণ্ডবদাহন: খাণ্ডব হল মহাভারতের একটি বিখ্যাত অরণ্য, যা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির দ্বারা ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগের ইঙ্গিত দেয়। এটি হানাদার বাহিনির হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
- সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর: মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হওয়া হরিদাসীর স্বামীর মৃত্যুর পর তার সিঁথি থেকে সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে, যা সনাতন ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি ইঙ্গিত।
- যত্রতত্র: সব জায়গায়, যেখানেই।
- ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রাবাস ও বস্তি ধ্বংস করেছিল, কারণ এই স্থানগুলো আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল।
পাঠ পরিচিতি
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। এটি বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটি বাঙালি জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের ও আত্মত্যাগের চিত্র তুলে ধরে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির রক্তে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি বাহিনী শহর ও গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় এবং জাতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। তবে, এই একাত্তরের সংগ্রামে অংশ নেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ—শ্রমিক, কৃষক, রিকশাওয়ালা, শিক্ষক, নারীরা। তাদের সকলেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে, দেশের জন্য প্রাণ দেয়।
এই কবিতায় কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে আত্মত্যাগ এবং সংগ্রাম হয়েছে, তা অমুল্য। কবিতার ভাষায়, ‘হরিণের হাড়’ এবং ‘নবীন রক্তে প্রাণস্পন্দন’—এগুলো বাঙালি জাতির জীবনের নতুন আগামীর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কবির দৃঢ় বিশ্বাস, ‘স্বাধীনতা একদিন আসবে’।
মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য দলিল হিসেবে এই কবিতা স্বাধীনতা অর্জনের গল্পের জীবন্ত প্রমাণ হয়ে থাকবে। 🕊️