তাহারেই পড়ে মনে
সুফিয়া কামাল
“হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম, “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান? ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান।”
কহিলাম, “ওগো কবি! রচিয়া লহ না আজও গীতি, বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি- এ মোর মিনতি ।”
কহিল সে মৃদু মধু-স্বরে-
“নাই হলো, না হোক এবারে-
আমারে গাহিতে গান, বসন্তেরে আনিতে বরিয়া-
রহেনি, সে ভুলেনি তো, এসেছে তা ফাগুনে স্মরিয়া।”
কহিলাম : “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই? যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটেনি শাখে? পুষ্পারতি লভেনি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নাই অর্ঘ্য বিরচন?”
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরে আসি –
“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে ।”
📘 তাহারেই পড়ে মনে – জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক ৩০টি প্রশ্ন
✍️ কবি: সুফিয়া কামাল | 🕊️ বিষয়: স্মৃতি, ঋতু, অভিমান
💠 জ্ঞানমূলক প্রশ্ন (Knowledge-Based Questions)
- 🖋️ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবি কে?
- 🌸 কবিতাটিতে কোন ঋতুর আগমন চিত্রিত হয়েছে?
- 🎙️ শুরুতে কবিকে কে প্রশ্ন করছে?
- 😶 কবি কেন নীরব?
- 🚪 “দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?” – এখানে কী বোঝানো হয়েছে?
- 🍋 “বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি?” – এর প্রকৃত ইঙ্গিত কী?
- 🌊 “অলখের পাথার” – শব্দযুগলের মানে কী?
- 🎶 কবি কি আগমনী গান শুনেছেন?
- 🥀 কবির অভিমান কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে?
- 💭 “সে ভুলেনি তো” – এখানে ‘সে’ কার প্রতীক?
- 🌺 “ফুল কি ফোটেনি শাখে?” – কবির বক্তব্য কী?
- ❌ কবি কেন বসন্তকে ‘বৃথা’ বলেন না?
- 🔥 “মাঘের সন্ন্যাসী” – এই প্রতীকের তাৎপর্য কী?
- 🧠 “তাহারেই পড়ে মনে” – এখানে কবির স্মৃতি কোন দিক নির্দেশ করে?
- 📜 কবিতাটি কতটি স্তবকে রচিত?
💠 অনুধাবনমূলক প্রশ্ন (Comprehension-Based Questions)
- 🕊️ কবি কেন বসন্তকে গান দিয়ে বরণ করেন না?
- 🌿 বসন্ত এখানে কী প্রতীকেরূপে ব্যবহৃত হয়েছে?
- 😔 কবি নীরব থাকলেও কেন ঋতুরাজ এসেছে বলে মনে হয় না?
- 💔 কবি কি স্মৃতি ভুলতে পারছেন? কেন?
- 🌫️ ‘কুহেলি উত্তরী’ কী প্রতীক নির্দেশ করে?
- 🚶♂️ “পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে” – এর শৈল্পিক বিশ্লেষণ করো।
- 🥀 অভিমান কীভাবে কবির কণ্ঠরোধ করেছে?
- 🌀 ঋতু ও স্মৃতির মেলবন্ধন কীভাবে কবিতায় ফুটে উঠেছে?
- 🌸 বসন্তের সৌন্দর্য কবিকে স্পর্শ করছে না কেন?
- 🕯️ স্মৃতি কীভাবে বর্তমান অনুভবকে গ্রাস করে – ব্যাখ্যা করো।
- ⚖️ কবির প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব কোথায়?
- 🌼 “ফুল ফোটার” প্রতীকের অন্তর্নিহিত অর্থ কী?
- 🌱 প্রকৃত বসন্ত কবির চোখে কিসের প্রতীক?
- 🗣️ কথোপকথনের আড়ালে কবি কী দ্বন্দ্ব প্রকাশ করছেন?
- 📖 কবিতার সারাংশে স্মৃতি ও অভিমান কীভাবে যুক্ত হয়েছে?
📘 বহুনির্বাচনী প্রশ্নোত্তর (MCQ):
১. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার রচয়িতা কে?
ক) কাজী নজরুল ইসলাম
খ) সুকান্ত ভট্টাচার্য
গ) সুফিয়া কামাল ✅
ঘ) জীবনানন্দ দাশ
২. কবিতায় ‘তাহারে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
ক) বসন্ত
খ) প্রিয়জন ✅
গ) কবিতা
ঘ) ঋতুপ্রবাহ
৩. ‘ফাগুন যে এসেছে ধরায়’—এই চরণে কোন ঋতুর কথা বলা হয়েছে?
ক) শীত
খ) বসন্ত ✅
গ) গ্রীষ্ম
ঘ) শরৎ
- “নাই হলো, না হোক এবারে”—চরণটির ভঙ্গি কেমন?
ক) আদেশমূলক
খ) আহ্বানমূলক
গ) আত্মসমর্পণমূলক ✅
ঘ) প্রতিবাদমূলক
৫. “কুহেলি উত্তরী তলে” চরণে কোন ঋতুর প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়?
ক) মাঘ ✅
খ) আষাঢ়
গ) চৈত্র
ঘ) পৌষ
৬. কবি বসন্তকে কেন অবহেলা করেছেন?
ক) ঋতুটি কষ্ট দেয় বলে
খ) প্রিয়জন ফিরে আসেনি বলে ✅
গ) ফুল ফোটেনি বলে
ঘ) কবিতার সময় বসন্ত ছিল না
৭. ‘পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে’—এখানে কী বোঝানো হয়েছে?
ক) মৃত্যুর প্রতীক ✅
খ) প্রেমের পথ
গ) শূন্যতা
ঘ) প্রকৃতির গমনপথ
৮. কবিতায় ‘আগমনী গান’ কী বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে?
ক) বসন্তের গান
খ) প্রিয়জনের ফিরে আসার সম্ভাবনা ✅
গ) মাধবীলতার গন্ধ
ঘ) পুষ্প উৎসব
৯. ‘মাধবী কুঁড়ির বুকে’ গন্ধ কি থাকে?—এই প্রশ্নের ভঙ্গি কী?
ক) কাব্যিক-ঋতুবেদনা ✅
খ) বিদ্রোহমূলক
গ) উত্তেজনামূলক
ঘ) তথ্যভিত্তিক
১০. কবিতায় কথোপকথন কাদের মধ্যে?
ক) কবি ও বসন্ত
খ) কবি ও প্রশ্নকারী ✅
গ) কবি ও প্রিয়জন
ঘ) কবি ও ঋতু
১১. কবির অনুভব কিসের প্রতি গভীরভাবে নিবদ্ধ?
ক) স্মৃতিময় প্রিয়জনের প্রতি ✅
খ) ঋতুবদলের প্রতি
গ) ফাগুনের প্রতি
ঘ) সমাজের প্রতি
১২. ‘ফুল কি ফোটেনি শাখে?’ চরণটি কেমন রচনাশৈলীতে গঠিত?
ক) অলঙ্কারধর্মী প্রশ্ন ✅
খ) ঘোষণা
গ) উত্তর
ঘ) ঐতিহাসিক তথ্য
১৩. কবিতার ভাষা কেমন?
ক) তথ্যগত
খ) আবেগপ্রবণ ও কাব্যিক ✅
গ) কঠিন ও জটিল
ঘ) হুবহু গদ্য
১৪. কবির চোখে বসন্তের আবির্ভাব—
ক) আনন্দের প্রতীক
খ) উপেক্ষিত সৌন্দর্য ✅
গ) অতীত ভোলার ইঙ্গিত
ঘ) ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
১৫. ‘রচিয়া লহ না আজও গীতি’—এখানে কী ধরনের আবেদনের পরিচয় পাওয়া যায়?
ক) আদেশ
খ) অনুরোধ ✅
গ) নিষেধ
ঘ) প্রতিবাদ
১৬. কবি বসন্তকে কী উপহার দিতে চেয়েছিলেন?
ক) পুষ্প
খ) গান ✅
গ) বসন
ঘ) কবিতা
১৭. কবির মন কিসে আচ্ছন্ন?
ক) নতুন প্রেমে
খ) পুরোনো স্মৃতিতে ✅
গ) প্রকৃতির রূপে
ঘ) পুষ্পার্পণে
১৮. কবিতায় ‘তাহারে’ শব্দটি কয়বার এসেছে?
ক) ২ বার ✅
খ) ১ বার
গ) ৩ বার
ঘ) ৪ বার
১৯. কবিতাটি কোন ধারায় লেখা?
ক) গদ্যছন্দ
খ) সংলাপধর্মী কবিতা ✅
গ) সনেট
ঘ) ছোটগল্প
২০. ‘তাহারেই পড়ে মনে’—এই কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে—
ক) প্রকৃতির সৌন্দর্য
খ) স্মৃতিময় অভিমান ও অপেক্ষা ✅
গ) ফাগুনের রূপ
ঘ) বসন্ত বন্দনা
তাহারেই পড়ে মনে কবিতার ছন্দ
📌 ছন্দের ধরন:
👉 অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
👉 মাত্রা: ৮/৯ মাত্রা (অসামান্য সুষমতায়)
👉 তাল: মিল এবং স্বরবৃত্ত অনুপ্রেরণায় নমনীয় ধারা
🧩 উদাহরণসহ বিশ্লেষণ:
“হে কবি, নীরব কেন
ফাগুন যে এসেছে ধরায়”
🔹 এই দুই পঙ্ক্তির অক্ষরগণনা করলে পাই:
- হে / ক / বি, / নী / র / ব / কে / ন → ৮ অক্ষর
- ফা / গু / ন / জে / এ / সে / ছে / ধ / রা / ই → ১০ অক্ষর
🔸 এখানে পঙ্ক্তিভেদে ৮–১০ অক্ষরের পরিবর্তন দেখা যায়।
🔸 তবে প্রতিটি চরণে একটি সুনির্দিষ্ট ছন্দময়তা বজায় আছে, মূলত এটি অক্ষরবৃত্তের মুক্ত প্রবাহ।
🎼 বিশেষ লক্ষণ:
- আন্তঃমিল আছে: যেমন — “চাহিয়া / বাহিয়া”, “আসি / সন্ন্যাসী” ইত্যাদি
- আবৃত্তিযোগ্যতা প্রবল — কবিতাটি আবেগময় সংলাপের মতো উচ্চারণযোগ্য
- ছন্দের শৈলীতে বৈচিত্র্য রয়েছে — মাঝে মাঝে প্রশ্নধর্মী ও সংলাপাত্মক ভঙ্গি
📝 সারসংক্ষেপ:
“তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাটি মূলত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত হলেও এটি কোনো কঠোর মাত্রাবিন্যাস মেনে চলে না। কবি ছন্দের স্বাধীন প্রয়োগ করে বক্তব্য ও আবেগের প্রকাশকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
📘 কবিতার ব্যাখ্যা:
সুফিয়া কামালের “তাহারেই পড়ে মনে” একটি আবেগঘন, দার্শনিক এবং ঋতুপ্রধান কবিতা। কবিতাটি বসন্ত ঋতুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, এর গভীরে রয়েছে স্মৃতিমন্থন, বিচ্ছেদবেদনা, এবং একান্ত ব্যক্তিগত অভিমানের এক করুণ রূপ।
🪷 প্রথম অংশে:
কবিতার সূচনায় কবিকে প্রশ্ন করা হচ্ছে—“হে কবি, নীরব কেন?” বসন্ত এসেছে, ফুল ফুটেছে, আমের মুকুলে সুবাস ছড়িয়েছে, দক্ষিণ দুয়ার খুলেছে, তবে কবির অন্তর কেবল নিরুত্তাপ। তিনি গান ধরছেন না, বন্দনা করছেন না ঋতুরাজ বসন্তকে। এই বিস্ময়ের জায়গা থেকেই প্রশ্ন ওঠে।
🌿 দ্বিতীয় অংশে:
কবি নিজেই জবাব দেন—তিনি এখনো শুনতে পাননি প্রিয় জনের ‘আগমনী গান’। বসন্ত এসেছে প্রকৃতিতে, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে তা পৌঁছায়নি। কবি বসন্তের বাহ্য রূপে নয়, তার অন্তর উৎসবের প্রতীক্ষায় ছিলেন। প্রিয়জনের (সম্ভবত হারিয়ে যাওয়া কাউকে) ফিরে আসার আশায় বসন্তকেও উপেক্ষা করছেন।
🌸 তৃতীয় অংশে:
প্রশ্নকারী ব্যক্তি আবার অনুরোধ করে বলেন, “তবু বসন্ত বন্দনা করো, গানে বসন্তকে অভ্যর্থনা করো।” কিন্তু কবির জবাব আরও মর্মস্পর্শী—তিনি বলেন, বসন্ত নিজেই জানে তার আগমন কবিকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি। সেই যে এক স্মৃতিময় মানুষ—সে চলে গেছে “পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে,” আর সেই স্মৃতি কবির মনে অমলিন।
🎭 শেষ অংশে:
কবির ভেতরে এখনও সেই শূন্যতা, সেই বিচ্ছেদবোধ। বসন্ত এলেও, হৃদয়ের বসন্ত আসেনি। তাই প্রকৃতির বাহ্য উচ্ছ্বাস কবিকে স্পর্শ করে না। তাঁর মনে পড়ে সেই বিদায় নেওয়া মানুষটিকে, যাকে ভুলতে পারছেন না।
🕊️ প্রধান ভাব:
এই কবিতার কেন্দ্রীয় ভাব হলো—স্মৃতির কাছে বর্তমানের আনন্দও হার মানে। কবি বসন্তের রঙে না ভেসে নিজেকে নিবেদন করেন সেই অদৃশ্য প্রিয় স্মৃতির কাছে, যাকে ভুলতে পারেন না, যাকে হৃদয়ের গভীরে ধারণ করে রেখেছেন।
✍️ শৈলী ও কাব্যরীতি:
- সংলাপধর্মী কাব্যরীতি (কবি ও প্রশ্নকারীর মধ্যে কথোপকথন)
- আবেগময়তা ও অভিমান কবিতার গভীরতা বাড়িয়েছে
- প্রকৃতি ও স্মৃতির দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মানবিক অনুভবকে প্রকাশ করেছেন
- সাংবাদিক-নির্ভর নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি নির্ভর ভাষা ব্যবহৃত
https://www.munshiacademy.com/তাহারেই-পড়ে-মনে-কবিতার-ব/