চল চল চল
কাজী নজরুল ইসলাম
ধরন: কবিতা
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।
ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল।
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কা-
মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহবান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।
ঊর্ধ্ব আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচ-কাওয়াজ-
খোল রে নিদ-মহল!
কবে সে খেয়ালী বাদশাহী,
সেই সে অতীতে আজো চাহি’
যাস মুসাফির গান গাহি’
ফেলিস অশ্রুজল।
যাক রে তখত-তাউস
জাগ রে জাগ বেহুঁস।
ডুবিল রে দেখ কত পারস্য
কত রোম গ্রীক রুশ,
জাগিল তা’রা সকল,
জেগে ওঠ হীনবল!
আমরা গড়িব নতুন করিয়া
ধুলায় তাজমহল!
চল চল চল।।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী
পুরো নাম: কাজী নজরুল ইসলাম
জন্ম: ২৪ মে ১৮৯৯ (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ)
জন্মস্থান: চুরুলিয়া গ্রাম, আসানসোল মহকুমা, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মৃত্যু: ২৯ আগস্ট ১৯৭৬, ঢাকা, বাংলাদেশ
সমাধিস্থল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে
শিক্ষা ও শৈশব:
নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে নজরুল মক্তব শিক্ষার পাশাপাশি মসজিদে ইমামতি, লেটার লেখক এবং লেটার রাইটার হিসেবে কাজ করেন। পরে রানিগঞ্জের লেটোর দলে (গ্রামীণ যাত্রাগান) যোগ দেন, যেখানে তিনি গান লিখতেন, অভিনয় করতেন এবং সুর করতেন।
এরপর তিনি দরিদ্র পরিবারের অভাব দূর করতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯১৭ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে (৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট) যোগ দেন এবং করাচিতে প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে থেকেই আরম্ভ হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা।
সাহিত্যকর্ম:
নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন শুরু হয় কবিতা ও গান লেখার মাধ্যমে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অগ্নিবীণা” (১৯২২) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে ঝড় ওঠে।
প্রধান কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধগ্রন্থ:
- কবিতা: অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয়োল্লাস, দোলনচাঁপা
- গল্প: ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলি মালা
- উপন্যাস: বাদল প্রভাত, কুহেলিকা
- প্রবন্ধ: যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী
- গান: প্রায় ৪০০০-এর বেশি গান রচনা করেন, যার মধ্যে ইসলামি গান, হিন্দু ধর্মীয় গান, প্রেমের গান, দেশাত্মবোধক গান এবং বিদ্রোহী সঙ্গীত উল্লেখযোগ্য।
বিদ্রোহ ও রাজনীতি:
নজরুল ইসলামের লেখায় সব সময় সাম্য, মানবতা, স্বাধীনতা ও বিদ্রোহের ভাষা পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে তাঁর কবিতা “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হলে তা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক জোরালো আওয়াজ হয়ে ওঠে।
তিনি “ধূমকেতু” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যেখানে ব্রিটিশবিরোধী লেখার কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়।
ধর্মীয় ভাবনা ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা:
নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি বলেছেন,
“আমি হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক স্বর হয়ে গেছি… আমি এক নতুন যুগের পথিক।”
তিনি ইসলামী গান যেমন লিখেছেন, তেমনি শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন ও হিন্দু ধর্মীয় গানেও পারদর্শী ছিলেন।
পরে জীবন ও বাংলাদেশে আগমন:
১৯৪২ সালে নজরুল এক রহস্যময় অসুস্থতায় বাকশক্তি হারান। অনেক চিকিৎসার পরও তিনি আর স্বাভাবিক হননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে তাঁকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং “জাতীয় কবি” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য উপাধি ও সম্মাননা:
- জাতীয় কবি (বাংলাদেশ)
- একুশে পদক (মরণোত্তর): ১৯৭৬
- পদ্মভূষণ (ভারত): প্রদান করা হয়নি, তবে প্রস্তাব ছিল
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়: সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি
উক্তি:
“আমি চির বিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা রণভূমে রণ ক্লান্ত, আমি বিরুদ্ধতার মহান্দ্রভুজন।”