চর্যাসংগীত: বাংলা গীতিকবিতার আদি ধ্বনি

✍️ চর্যাসংগীত: বাংলা গীতিকবিতার আদি ধ্বনি

chorjapod cover
chorjapod cover

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ কেবল আদিগ্রন্থ হিসেবে নয়, বরং প্রাচীন গীতিকবিতা ও সংগীতচর্চারও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত এই চর্যাগানগুলো তৎকালীন বৌদ্ধ সহজযানী সাধকদের ধর্মচর্চার অভিব্যক্তি হলেও, কাব্যরীতি, সুর, রাগ-রাগিণী এবং ধ্রুবপদ ইত্যাদি উপাদানের উপস্থিতিতে এগুলো একপ্রকার প্রবন্ধগীত বলেই প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব পদাবলি, সুফি-মুর্শিদি গান, বাউল গান, শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি গীতিধর্মী সাহিত্যে এর সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। এই দিক থেকে চর্যাসংগীত বাংলা সংগীতসাহিত্যের প্রথম সংগীতচর্চা ও ছন্দ-সুরের দলিল

🎼 চর্যাগান: ছন্দ ও সুরের ঐতিহাসিক ভিত্তি

চর্যাপদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর চরণবিন্যাস, অন্ত্যমিল এবং গীতিধর্মিতা। প্রতিটি পদই বহু চরণবিশিষ্ট ও সংগীতযোগ্য রচনারূপে গঠিত। ছন্দের ক্ষেত্রে প্রধানত পয়ার, ত্রিপদী, ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়— চরণের শেষাংশে মিল রেখে গীতির সুর মেলানো হয়েছে সুচারুভাবে। এমনকি, চর্যাপদে ধ্রুবপদ বা ধুঁয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা গানকে সংগীতধর্মী কাঠামোর মধ্যে বেঁধে রাখে।

নীহাররঞ্জন রায় বলেন—

“চর্যাপদের প্রত্যেক পদের শেষে ‘ধ্রু’ শব্দটির ব্যবহার প্রাচীন গীতিকবিতার ধ্রুবপদের দিকেই ইঙ্গিত করে। এতে চর্যার সংগীতচরিত্র স্পষ্ট।”
(বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস)

🎶 রাগ-রাগিণীতে চর্যার নিবন্ধ

চর্যাপদের বিশেষত্ব হল— প্রতিটি পদ নির্দিষ্ট রাগে গাওয়ার জন্য নির্দেশিত। চর্যাপদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও প্রাচীন টীকার মাধ্যমে এই রাগনির্দেশ পাওয়া যায়। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাগ এবং সেই রাগে গাওয়া পদগুলির উল্লেখ করা হলো:

  • পটমঞ্জরী রাগে গাওয়া হয়েছে ১১টি পদ (যেমন: পদ ১, ৬, ৭, ৯, ১১, ১৭ ইত্যাদি)
  • মল্লারী রাগে ৫টি পদ (যেমন: পদ ৩০, ৩৫, ৪৪)
  • ভৈরবী, কামোদ, বরাড়ী, গুঞ্জরী – প্রতিটি রাগে গাওয়া হয়েছে ৪টি করে পদ
  • গৌড় রাগে – পদ ২, ৩, ১৮
  • আশাবরী, রামকেলি, দেশাখ, মালসী – প্রতিটি রাগে গাওয়া হয়েছে ২টি করে পদ
  • অরু, ধানশী, দেবগিরি, বঙ্গাল – প্রত্যেকে একটি করে পদে ব্যবহৃত

এইসব রাগ সাধারণত দেশজ সঙ্গীতরীতি অনুসরণ করে। চর্যাগানের সংগীতধর্মিতা এবং রাগাশ্রয়ী গঠন চর্যাকে গীতিকবিতার এক পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়।

🔁 ধ্রুবপদ ও গানের গঠনেরীতি

চর্যাপদের প্রতিটি পদের শেষে ‘ধ্রু’ শব্দটি দেখা যায়, যা প্রাচীন সংগীতের ধ্রুবপদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। সংস্কৃত টীকায় ধ্রুবপদের কার্যব্যাখ্যা করা হয়েছে—

“ধ্রুবপদেন দৃঢ়ীকুর্বন, ধ্রুবপদেন চতুর্থানন্দমুদ্দীপয়ন্নাহ।”

তিব্বতি ভাষ্যেও এই পদকে “ধু-পদ” নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রতিটি পদের অন্তিম অংশ ছিল পুনরাবৃত্ত ধ্রুবপদ, যা শ্রোতাদের স্মরণে ও আকর্ষণে ব্যবহৃত হতো। এই ধ্রুবপদ ব্যবহার পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলি ও প্রবন্ধগীত ধারায় অব্যাহত থাকে।

🎵 প্রবন্ধগীত ও ধাতুরীতি

আধুনিক বাংলা গানে যেমন স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ এই চার কলি ব্যবহৃত হয়, তেমনিভাবে চর্যার যুগে ব্যবহৃত হতো— উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ নামে চারটি অংশ, যাদের বলা হতো “ধাতু”

চর্যাগানে মেলাপক ধাতু অনুপস্থিত, ফলে এগুলোকে বলা হয় ত্রিধাতুক প্রবন্ধগীত। গীতিকবিতার এই প্রাচীন কাঠামো প্রমাণ করে, সংগীতচর্চা তৎকালীন ধর্মীয় ও দার্শনিক অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল।

🌾 পরবর্তী প্রভাব ও উত্তরসূরিতার ধারা

চর্যাগানের সরল গীতিকাঠামো, রূপকপ্রধান ভাষা এবং সাধনভিত্তিক আবেগ বাংলার বহু ধারার সাধনসঙ্গীতে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। যেমন:

  • বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধা-কৃষ্ণের রসভাব প্রকাশে
  • বাউল গানে দেহতত্ত্ব ও তত্ত্ববোধ চর্চায়
  • নাথ ও দেহযোগী গানে আত্মসাধনার গূঢ় অভিব্যক্তিতে
  • সুফি-মুর্শিদি গানে উপমা ও বোধনির্ভর আধ্যাত্মিক সংগীতে

অর্থাৎ, চর্যাপদের গীতিধর্মিতা বাংলার সংগীত ও কাব্যচর্চার প্রাণসুত্র হয়ে উঠেছে।

📘 উপসংহার

চর্যাপদ শুধু বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন নয়, এটি বাংলা গীতিকবিতা ও সংগীতের আদি ধ্বনি। পদে পদে রাগনির্দেশ, ধ্রুবপদের প্রয়োগ, ছন্দের বুনন ও ধাতুরীতি চর্যাকে পরিণত করে গীতিকবিতার আদিরূপে। চর্যাগান ধর্ম, সাহিত্য, সংগীত— এই তিনের মিলিত প্রকাশ। পরবর্তীকালে সাধকগীতি, বৈষ্ণব পদাবলি, সুফি-মুর্শিদি সংগীত, বাউল গানে তার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সঙ্গীততত্ত্ব ও সাহিত্যের যুগ্ম আলোকে চর্যাপদ বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়।

📚 তথ্যসূত্র (References):

  1. ড. নীহাররঞ্জন রায় – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
  2. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (সম্পাদনা, ১৯০৭)
  3. ড. সুকুমার সেন – বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত
  4. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – চর্যাপদের রাগ ও সুরভিত্তি আলোচনা
  5. তিব্বতী অনুবাদ: পোথী সংগ্রহ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা
  6. বাংলা একাডেমি অভিধান ও গবেষণাপত্র

https://www.munshiacademy.com/চর্যাসংগীত-বাংলা-গীতিকব/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *