চর্যাপদে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব

Spread the love

চর্যাপদে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব

 

charjapod-চর্যাপদ

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ শুধু কাব্যরূপেই নয়, তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি ও ধর্মের অন্তর্গত বাস্তবতা ও প্রতিফলনের প্রামাণ্য দলিল হিসেবেও বিবেচিত।

 

🔸 ভূমিকা

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত এই গূঢ় ধর্মীয় পদাবলি প্রথম আবিষ্কৃত হয় নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দ্বারা। চর্যাগানগুলোর অন্তর্নিহিত রূপক এবং দার্শনিক গভীরতা ছাড়াও এতে তৎকালীন সমাজের বাস্তবচিত্র, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ধর্মীয় মতাদর্শের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়।

🔸 সামাজিক প্রভাব

চর্যাপদ তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নানা অসাম্য ও সংকটের কথা গোপন রূপকে প্রকাশ করেছে। এর লেখকেরা ছিলেন মহাসিদ্ধ বৌদ্ধ সহজযানী সাধক, যাঁরা সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতি, জাতপাত, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভণ্ডামিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

১. জাতপাতবিরোধিতা:
চর্যাগানে হিন্দু বর্ণব্যবস্থার কড়া সমালোচনা লক্ষ্য করা যায়। তারা উচ্চবর্ণের দম্ভ ও নিম্নবর্ণের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, এক চর্যায় বলা হয়েছে:

“চণ্ডালিনী বলল, কাহারে দিব সোন।”
এখানে চণ্ডালিনী নিম্নবর্ণের নারী, যাঁর মুখেও আত্মপ্রকাশ পাচ্ছে চেতনার শক্তি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার।

২. নারী ও সমাজ:
চর্যাপদের নারীচরিত্রগুলো সবসময়ই বদ্ধ, নিগৃহীত ও প্রতীক্ষারত অবস্থায় উপস্থিত। এতে নারীর প্রতি সমাজের নিষ্ঠুরতা এবং অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। স্ত্রী এখানে একদিকে জীবনদেহের রূপক, অন্যদিকে সমাজের নিগৃহীত লিঙ্গ।

৩. দারিদ্র্য ও শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট:
চর্যাপদের অনেক গানে দেখা যায়, চরিত্ররা কৃষক, জেলে, গৃহস্থ—যাদের জীবনে কেবল পরিশ্রম আর সংগ্রাম। এও সমাজের বাস্তব দিক।

🔸 রাজনৈতিক প্রভাব

চর্যাপদের রচয়িতারা সরাসরি রাজনীতি নিয়ে কিছু না বললেও রাজশক্তির ভূমিকা ও সামাজিক নিপীড়ন তাদের রচনার ভেতরে প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

১. শাসকের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ:
“রাজা” চর্যায় কখনো ন্যায়দর্শী, আবার কখনো দমনকারী শক্তির রূপে প্রতিভাত। সাধারণ মানুষের জীবনে শাসক কীভাবে প্রভাব বিস্তার করত, তা রূপকে ব্যক্ত হয়েছে।

২. সন্ন্যাসীদের ওপর নির্যাতন:
সহজযানী বৌদ্ধ সাধকগণ ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতার দ্বারা নিপীড়িত হতেন। চর্যায় তাঁদের স্বাধীন সাধনার পথে বাধা এবং ভয়ের আবহও উঠে এসেছে।

৩. রাজনীতি ও ধর্মের মেলবন্ধন:
তৎকালীন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু সময় ধর্ম সম্প্রসারণ পেলেও পরবর্তী সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে বৌদ্ধধর্ম পরাজিত হয়। এর আভাস চর্যাপদে লক্ষ্য করা যায়।

🔸 ধর্মীয় প্রভাব

চর্যাপদের প্রধান প্রভাব ধর্মীয় হলেও এটি প্রথাগত ধর্মচর্চার বিরোধী ও আধ্যাত্মিক বোধকে প্রাধান্য দিয়েছে।

১. সহজযান ও মহাসূন্যবাদ:
চর্যাপদ মূলত বৌদ্ধধর্মের সহজযান মতবাদের অনুরণনে রচিত। সহজযানে বিশ্বাস করা হয় মুক্তি লাভের জন্য বাহ্য আচারের দরকার নেই—আত্ম-অনুভব, প্রেম, জ্ঞান ও ধ্যানই প্রধান।

২. আধ্যাত্মিক সাধনা ও মনোভাব:
চর্যায় দেহতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, যোগতত্ত্ব—এই তিনটি ধারার প্রভাব রয়েছে। দেহই সাধনার ক্ষেত্র, আর সেই দেহের ভেতরেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব। বাহ্যিক মন্দির বা উপাসনার প্রয়োজন নেই।

৩. ধর্মীয় রূপক ও ভাষা:
চর্যাপদের ভাষা একাধারে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও দেশজ শব্দে গঠিত। ধর্মীয় প্রতীকে পূর্ণ এই ভাষা রূপক, দেহতত্ত্ব ও মনের অভিজ্ঞতাকে একত্রে ধারণ করে।

উদাহরণস্বরূপ:

“গহন কুসুম গন্ধ বন-মাঝে” — এখানে গহন বন মানে দেহতত্ত্ব, কুসুম মানে চেতনা বা অভিজ্ঞতা।

🔸 উপসংহার

চর্যাপদ শুধু বাংলা সাহিত্যের আদিগ্রন্থ নয়, এটি একযোগে সামাজিক প্রতিবাদ, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ধর্মীয় বিপ্লবের দলিল। এর গূঢ় রূপক ভাষা বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলেও, বাস্তব সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিফলন তাতে সমানভাবে উজ্জ্বল।

এমন একটি নিদর্শনই প্রমাণ করে বাংলা সাহিত্য শুরু থেকেই গভীর ও প্রভাবপূর্ণ ছিল, যেখানে সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি এক সুতোয় বাঁধা।

 

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদে-সামাজিক-রাজনৈত/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *