চর্যাপদে নারীদের অবস্থান

Spread the love

✍️ চর্যাপদে নারীদের অবস্থান: একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ

 

চর্যাপদে নারীদের অবস্থান
চর্যাপদে নারীদের অবস্থান

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এক অমূল্য দলিল। চর্যাগীতি মূলত বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মীয় সাধন সংগীত হলেও এতে অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন স্তরের বাস্তব জীবনচিত্র—বিশেষ করে নারীদের অবস্থান। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচিত হবে চর্যাপদে নারীর সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা, যা আজকের সমাজ-বিশ্লেষণেও মূল্যবান তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

🔷 নারীর স্বাধীনতা ও জীবনচেতনা

চর্যাপদের ভাষ্য অনুযায়ী, চর্যার যুগে নারীরা তুলনামূলকভাবে স্বাধীন ছিলেন। তাঁরা সঙ্গী নির্বাচন, পেশা বাছাই, নৃত্যগীত, ধর্মাচরণ এমনকি গুরুপদ লাভের অধিকার রাখতেন। এই নারীদের আমরা পাই কখনও প্রেমিকা, কখনও স্ত্রী, কখনও ব্যবসায়ী, কখনও গৃহবধূ বা সাধিকা রূপে।

কুক্কুরীপাদের ২ নম্বর পদে এক গৃহবধূর ছলনার চিত্র পাওয়া যায়:

“সে দিনের বেলায় কাকের ডাকে ভয় পায়,
কিন্তু রাতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যায়।”

এখানে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমচর্চা ও সামাজিক নিয়ম অগ্রাহ্য করার ইঙ্গিত রয়েছে। একই পদে কৌতুক ও কৌশলের মধ্য দিয়ে নারীকে আত্মনির্ভর এবং স্বাধীনচেতা এক চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

🔷 অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ

চর্যাপদে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ডোম্বীপাদের ১৪ নম্বর পদে নারীদের নৌকা চালানো, যাত্রী পারাপার, জল সেচন প্রভৃতি কাজের উল্লেখ রয়েছে।

তথ্যসূত্র:

“ডোম্বী গাঙে যায়, নৌকা চালায়, জল সেচে, লোকে ওঠে-নামে”
—এই ধরনের কাজ নারীর জনজীবনে সক্রিয় ভূমিকা ও সামাজিক স্বীকৃতি নির্দেশ করে।

এছাড়া কাহ্নপাদের ১০ নম্বর পদে এক ডোম্বী নারীর তাঁত ও চেঙারি বিক্রির উল্লেখ রয়েছে, যা প্রমাণ করে নারীরা শুধু গৃহকাজে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং হস্তশিল্প এবং বাজার অর্থনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন

🔷 যৌনতা, প্রেম ও নারী-স্বাধীনতা

চর্যাগীতিতে নারীদের প্রেম, কামনা এবং যৌনচেতনার যে প্রকাশ দেখা যায়, তা মধ্যযুগীয় সমাজের তুলনায় ব্যতিক্রমী। এই প্রকাশ বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদের কায়িক সাধনা ও দেহতত্ত্বে বিশ্বাস-এর ফসল। তাই চর্যাপদে নারী শরীর ও প্রেম-ভাষ্যকে নিছক কামনা হিসেবে না দেখে তা আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতীক হিসেবে বিশ্লেষণ করতে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, কাহ্নপাদের ১৮ নম্বর পদে ডোম্বী নারীর ছিনালী (সাজসজ্জা ও যৌন প্রকাশ) বিষয়ক চিত্র দেখা যায়, যা নারীজীবনের কল্পনাজনিত নয়, বরং বাস্তব জৈবিকতা ও দেহতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত।

🔷 নারী ও সাধনপথ: গুরুপদের অধিকার

চর্যাপদে নারীর সাধিকা ও গুরু রূপে অবস্থানও লক্ষণীয়। মধ্যযুগের অন্য ধর্মমতের তুলনায় বৌদ্ধ সহজযান ছিল অধিক নারীবাদী ও উদার। তাই নারীরা তন্ত্রসাধনার গুরু বা মন্ত্র-উপদেশদাত্রী হিসেবেও সমাজে স্বীকৃতি পেতেন।

চর্যাপদের একাধিক স্থানে গুরুর রূপে নারীর কথা বলা হয়েছে। সিদ্ধপুরুষদের সাধনপথে তাঁরা নারীসঙ্গকে শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখেননি, বরং আত্মবিকাশ ও জ্ঞানালোক প্রাপ্তির সহকারী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

🔷 গৃহস্থ নারীর চিত্র ও সামাজিক কাঠামো

চর্যাগীতিতে গৃহস্থালি জীবনের নারী-রূপেরও উল্লেখ আছে। তাঁরা সংসার পরিচালনা, রন্ধন, দুধ দোহন, স্বামী সেবা, সন্তান পালন প্রভৃতিতে নিযুক্ত থাকতেন। তবে এই দায়িত্ব ছিল নিয়মতান্ত্রিক নয়, বরং স্বাধীনতাপূর্ণ।

যেমন: কাহ্নপাদের পদের “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী” পঙ্ক্তিতে নারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব, আত্মসমালোচনা ও জীবনচেতনার অভিব্যক্তি রয়েছে।

🔷 নারী-প্রতীক ও রূপকের ব্যবহারে সাহিত্যরুচি

চর্যাপদে নারী শুধুমাত্র বাস্তব চরিত্র নয়, বরং বহুক্ষেত্রে তারা রূপক, প্রতীক ও আধ্যাত্মিক ভাবনার বাহক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছেন।

  • ডোম্বী’ প্রতীক হতে পারে অশুচিতা বা তথাকথিত সমাজবর্জিত নারীর, আবার সেই নারীকেই চর্যাকাররা গুরুপদে অধিষ্ঠিত করেছেন।
  • শবরী, চরকিনী, রজকিনী’ নামের নারীচরিত্রগুলো সামাজিক স্তরে প্রান্তিক হলেও সাধনপথে তাঁদের স্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এভাবেই নারী হয়ে ওঠে সমাজের সীমা ছাড়িয়ে তত্ত্ব, দর্শন ও মুক্তির পথের অনুষঙ্গ

🔷 চর্যাপদের নারীরা কী প্রকৃত স্বাধীন ছিলেন?

চর্যাপদে নারীর স্বতন্ত্রতা, প্রেম, পেশার অধিকার, গুরুপদ অধিকার এসব বিবরণ পাঠ করে অনেকে মনে করেন, সেই যুগে নারী স্বাধীনতা বর্তমান যুগের তুলনায়ও উন্নত ছিল। তবে কিছু পণ্ডিত যেমন: ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, প্রফেসর অনিমেষ দত্ত প্রভৃতি মত দেন যে এই ‘নারী স্বাধীনতা’ বাস্তব সমাজের নয়, বরং সাধনপদ্ধতির প্রয়োজনে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত। অর্থাৎ নারীর জীবন বাস্তবতায় তেমন পরিবর্তন নাও থাকতে পারে

তবে অন্য মতের গবেষকেরা যেমন ড. নীহাররঞ্জন রায়, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন—চর্যাপদের নারীচিত্র বাস্তব জীবনের উপরই ভিত্তি করে গঠিত, যদিও কাব্যিক প্রয়োজনে তা রূপান্তরিত হয়েছে।

✅ উপসংহার

চর্যাপদে নারীর অবস্থান কোনো একরৈখিক বিশ্লেষণ দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। নারী এখানে প্রেমিকা, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী, ধর্মগুরু, রূপক ও তত্ত্বের বাহক—সবকিছুরই সম্মিলন। বৌদ্ধ সহজযান দর্শনের উদারতার ফলে এই সাহসী চিত্র সম্ভব হয়েছে, যা মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যান্য সাহিত্যধারার তুলনায় এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ।

তাই চর্যাপদ শুধু একটি আধ্যাত্মিক সাধন সংগীত নয়, বরং তা নারীর আত্মপ্রকাশের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্যিক দলিল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই চর্যাগীতিগুলো নারীর আত্মনির্ভরতা ও সামাজিক ভুমিকার এক অনুপম প্রতিফলন।

📚 রেফারেন্স

  1. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, Buddhist Mystic Songs
  2. ড. নীহাররঞ্জন রায়, Bangalir Itihas: Adi Parva
  3. ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, The Origin and Development of the Bengali Language
  4. ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত
  5. প্রফেসর অনিমেষ দত্ত, চর্যাপদ: রূপক ও নারীচেতনা বিশ্লেষণ
  6. ভূদেব চৌধুরী, চর্যাগীতির ভাষা ও ভাববিশ্ব

📎 @munshi.academy | 🌐 www.munshiacademy.com | 🎙️ গবেষণা ও বর্ণনা: মুনশি আলিম

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদে-নারীদের-অবস্থান/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *