
চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য: একটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ
“প্রতীক রূপকের সাহায্যে চিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানব চরিত্রের মধ্যে সুখ-দুঃখের বিরহ মিলনের দৈনন্দিন জীবনচিত্র চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীব করিয়াছে”—এই মন্তব্য বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ইতিহাসকার ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর। চর্যাপদকে শুধু বৌদ্ধ সাধন সংগীত হিসেবে না দেখে সাহিত্যের নিরিখে মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, এতে নিহিত রয়েছে প্রকৃতির রূপ, রূপকের ব্যবহার, আখ্যানধর্মিতা, বাস্তবজীবনচিত্র, অলংকার ও ছন্দের সচেতন প্রয়োগ—যা একে বাংলা সাহিত্যের আদিগ্রন্থরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে।
🔶 চর্যাপদের ভাষা ও সাহিত্যিক ব্যাকরণ
চর্যাপদের ভাষা প্রাক-বাংলা, সংস্কৃত ও প্রাকৃতিক কথ্য ভাষার মিশ্রণ। এতে বাংলার শব্দতত্ত্ব, ধ্বনিগত পরিবর্তন ও অর্থের বিবর্তনের নিদর্শন পাওয়া যায়। ভাষার এই বিকাশ চর্যাপদকে কেবল প্রাচীনতম সাহিত্য নয়, ভাষা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবেও চিহ্নিত করে।
🔶 প্রকৃতি বর্ণনা: বাংলার নান্দনিক পরিপার্শ্ব
চর্যাপদের পদগুলিতে দর্শনের গূঢ়তা থাকলেও তার বহিঃরূপে প্রকৃতির রঙিন ছোঁয়া স্পষ্ট। ২৮ নম্বর পদে এক শবরী বালিকার প্রেক্ষিতে যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা বাংলা প্রকৃতির এক অনন্য নান্দনিক প্রকাশ—
“উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী
মোরঙ্গ পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী”
এই পদে পাহাড়ি শবরী তরুণীর বর্ণনার মাধ্যমে প্রকৃতির সৌন্দর্য, পরিপার্শ্বের গীতিময়তা ও দেহসজ্জার মধ্য দিয়ে যে কাব্যিক চিত্র নির্মিত হয়েছে, তা আধুনিক প্রকৃতি কবিতার সৌন্দর্যকেও টেক্কা দেয়। বাংলার পাহাড়ি প্রান্তর, বৃক্ষরাজি, পাখির পালক ও ফুলেল বর্ণনা চর্যাপদে কবির নান্দনিক চেতনার নিদর্শন।
🔶 রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের কাব্যিক আবেদন
চর্যাকারগণ কেবল ধর্মীয় তত্ত্ব নয়, বরং তাদের চিন্তাভাবনাকে গূঢ় অর্থে প্রকাশ করেছেন প্রতীকমূলক ভাষায়। যেমন—
“আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”
এখানে হরিণ তার নিজের শরীরই নিজের শত্রু—মনের আকাঙ্ক্ষা, বাসনা ও দেহসুধার মধ্যে দ্বন্দ্ব।
“টালত ঘর মোর নাহি পড়শেষী”
এটি আত্মপরিচয়হীন, নিঃস্ব মানুষের করুণ চিত্র তুলে ধরে।
এইসব প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্প চর্যাকে একটি দার্শনিক ও সাহিত্যিক উচ্চতায় উন্নীত করেছে। এখানে জীবন, দেহ, সাধনা, নারী, প্রেম, নদী, নৌকা, বন্যা—সবই রূপক।
🔶 আখ্যানধর্মিতা: ছন্দের গলিতে গল্প
চর্যাপদের বহু পদে আখ্যানধর্মী বুনন লক্ষ্য করা যায়। ৫০ নম্বর পদে একটি মেয়ের জীবনযাত্রার কথকতা উঠে এসেছে গল্পের আঙ্গিকে। শবর বালিকার “চাঁচের বেড়া দেওয়া ঘর” আসলে তার সংকীর্ণ সামাজিক অবস্থানের প্রতীক।
এই আখ্যানধর্মীতা চর্যাকে নিছক গীতিকবিতার সীমা ছাড়িয়ে আখ্যানকাব্যের আদিরূপে চিহ্নিত করে।
🔶 বাস্তব জীবনচিত্র ও মানবিক অভিজ্ঞতা
চর্যাপদ যে বাস্তবধর্মী সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে, তার প্রমাণ চর্যার ১৯ নম্বর পদ—
“কাহ্ণ ডোম্বী বিবাহে চলিআ”
এখানে এক নিম্নবর্ণের নারীর সঙ্গে কাহ্ণপাদের বিবাহের চিত্র একটি সামাজিক বাস্তবতা প্রকাশ করে। আবার “টালত ঘর মোর”—পদে আর্থিক দৈন্য, আশ্রয়হীনতা ও উপেক্ষিত মানুষের দুঃখ-ভোগের চিত্র ফুটে উঠেছে। এই সব বাস্তব চিত্র বাংলা সাহিত্যকে মানবিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
🔶 অলংকারের সচেতন ব্যবহার
চর্যাপদে অলংকার ব্যবহারও সাহিত্যিক উৎকর্ষের এক নিদর্শন। অনুপ্রাস, শ্লেষ, উপমা, রূপক—ইত্যাদি অলংকারের ছোঁয়ায় কবিতাগুলো রসসিক্ত হয়েছে।
যেমন:
“সবরী বালী গীবত গুঞ্জরী মালী”—এখানে গ-ধ্বনির পুনরাবৃত্তিতে অনুপ্রাসের গীতিময়তা লক্ষণীয়।
এছাড়া প্রতীক হিসেবে “চন্দ্র”, “নৌকা”, “হরিণ”, “শবরী” ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে কাব্যিক সংবেদনা জাগাতে।
🔶 ছন্দের ছন্দোবদ্ধ সৌন্দর্য
চর্যাপদের পদগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রধানত ত্রিপদী ও পয়ার ছন্দ। কিছু ছন্দে মাত্রা বিচ্যুতি থাকলেও ছান্দসিক ছন্দোবিন্যাস ও ধ্বনি অনুরণন চর্যাগীতিগুলোকে গীতিধর্মী করেছে। চর্যার ছন্দে সাধনা ও সংগীতের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়, যা একে আধা-গান, আধা-কবিতা হিসেবে বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
🔶 সাহিত্য ঐতিহ্যে প্রভাব
চর্যাপদের সাহিত্যগুণ শুধু তার নিজস্ব মূল্যেই সীমিত নয়, এটি পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ড. ভূদেব চৌধুরী মন্তব্য করেন—
“অষ্টাদশ শতকের শাক্ত সংগীত ও শ্যামা গীতি যে কারণে এবং যে অর্থে উৎকৃষ্ট গীতিসাহিত্য, সেই কারণেই এবং সেই অর্থেই চর্যাপদাবলীও সার্থক সাহিত্যসৃষ্টি।”
শাক্ত পদাবলী, বৈষ্ণব গীতি ও তান্ত্রিক সাহিত্য চর্যাগীতির ভাষা ও রূপকল্প থেকে কমবেশি প্রভাব গ্রহণ করেছে। চর্যাপদের ধর্মতত্ত্ব, প্রতীকী ভাষা ও সাধনাবিষয়ক রূপকল্প পরবর্তী কালে লোকসাহিত্য ও সাধনসাহিত্যের পরম্পরা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
✅ উপসংহার
চর্যাপদ নিছক একটি ধর্মীয় গান নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বাঙালির সাহিত্য পরিক্রমা শুরু হয়। এখানকার রূপক, প্রতীক, প্রকৃতি চিত্র, বাস্তবজীবন, আখ্যানধর্মিতা, অলংকার ও ছন্দ—সব মিলিয়ে চর্যাপদ এক সাহিত্যিক মহাকাব্যিক উচ্চতা লাভ করেছে।
বৌদ্ধ সহজযান দর্শনের উপস্থাপন চর্যায় যতই সংকেতময় হোক না কেন, সাহিত্যরস ও মানবিকতার সংমিশ্রণে তা হয়ে উঠেছে বাঙালির আত্মার প্রথম স্বাক্ষর।
📚 রেফারেন্স:
- ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, Buddhist Mystic Songs (Charyapada)
- ড. নীহাররঞ্জন রায়, Bangalir Itihas: Adi Parva
- ভূদেব চৌধুরী, চর্যাপদের সাহিত্য বিশ্লেষণ
- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, The Origin and Development of the Bengali Language
📎 @munshi.academy | 🌐 www.munshiacademy.com | 🎙️ গবেষণা ও বর্ণনা: মুনশি আলিম
https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-সাহিত্যমূল্য/