চর্যাপদের ভাষা ও ভাষা-বিতর্ক
ভূমিকা
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত হলেও, এর ভাষা যে আদ্য বাংলা তা নিয়ে গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন বিতর্ক চলেছে। চর্যাগীতিগুলির ভাষা একাধারে গুপ্ত, প্রতীকময় এবং আঞ্চলিক রূপ-প্রভাবিত। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচিত এই পদাবলি শুধু ধর্মীয় বা দার্শনিক দিক থেকেই নয়, ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিতেও অমূল্য সম্পদ। এই প্রবন্ধে চর্যাপদের ভাষার প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, অন্য ভারতীয় ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক, ভাষা-বিতর্কের ইতিহাস এবং আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশে এর অবদানের প্রামাণ্য বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
চর্যাপদের ভাষার স্বরূপ
চর্যাপদ রচিত হয় প্রায় ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। লেখকগণ ছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য, যাঁরা সাধারণত সংস্কৃতপণ্ডিত হলেও তাঁদের ভাষা ছিল সাধারণ জনমানুষের নিকটে পৌঁছনোর প্রয়াস। তাই পদগুলি সংস্কৃত বা পালিতে নয়, বরং প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ধারা থেকে জন্ম নেওয়া এক সৃজ্যমান লোকভাষায় রচিত।
সন্ধ্যা ভাষা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাচার্য-বিনিশ্চয় গ্রন্থের ভূমিকায় মুনিদত্তের সংস্কৃত ধারাভাষ্যের উপর ভিত্তি করে চর্যাপদের শ্লোকের রহস্যময় ভাষাকে সান্ধ্যভাষা বা আলো-আঁধারি ভাষা (অর্ধ-প্রকাশিত এবং অর্ধ-লুকানো) হিসেবে উল্লেখ করেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী বেশ কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে প্রমাণের ভিত্তিতে পরে এই ভাষাকে ‘ইচ্ছাকৃত ভাষা’ (সংস্কৃত: সন্ধ্যা-ভাষা) হিসেবে উল্লেখ করেন।[৪১] চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা। তাঁর মতে,
“ সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ, এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই। ”
বজ্রযানী ও সহজযানী গ্রন্থকারগণ প্রায়শ ‘সন্ধ্যাভাষয়া বোদ্ধব্যম্’ বলে এক রহস্যের ইঙ্গিত দিতেন। বজ্রযানী গ্রন্থগুলিতে ‘সন্ধ্যাভাষা’ শব্দটি বহুল-ব্যবহৃত। তিব্বতি ভাষায় ‘সন্ধ্যাভাষা’র অর্থ ‘প্রহেলিকাচ্ছলে উক্ত দুরুহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা’। যদিও মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী ‘সন্ধ্যা’র বদলে সন্-ধা ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘সন্ধা’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাঁদের মতে, ‘সন্ধ্যা’ লিপিকরদের প্রমাদ। “সন্ধা” শব্দের অর্থ ‘অভিপ্রেত, উদ্দিষ্ট, আভিপ্রায়িক বচন’। ম্যাক্সমুলার ‘সন্ধা’র অর্থ করেছেন “প্রচ্ছন্ন উক্তি” (“hidden saying”)। চর্যার ধর্মীয় প্রসঙ্গের সঙ্গে ‘সন্ধা’ এ-দিক দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য হলেও, যেহেতু অধিকাংশ পুঁথিতেই ‘সন্ধ্যা’ শব্দটি রয়েছে সেই কারণে হরপ্রসাদের অর্থেই আধুনিক গবেষকগণ এই শব্দটি গ্রহণ করেছেন।
চর্যাপদের গুপ্ত ভাষার বৌদ্ধ – তান্ত্রিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে চর্যাপদ
চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার এক আদিম রূপ – একে অনেক গবেষক “Proto-Bengali” হিসেবে অভিহিত করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একে অবহট্ট থেকে বাংলার উত্তরণকালীন ভাষা বলে চিহ্নিত করেন। আবার ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেন একে মধ্যভারতীয় অপভ্রংশ ধারারই একটি রূপ বলে মনে করেন।
ধ্বনিতত্ত্ব
- চর্যায় অ-কার কিছু বেশি বিবৃত (open); কতকটা আধুনিক আ-এর কাছাকাছি। সম্ভবত আদিস্বরের শ্বাসাঘাতের জন্য অ/আ ধ্বনির বিপর্যয় দেখা যায়। যেমন: অইস/আইস, কবালী/কাবালী, সমাঅ/সামাঅ ইত্যাদি।
- ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: পদমধ্যে ‘হ’-ধ্বনির সংরক্ষণ (যেমন: খনহ, তঁহি, করহ ইত্যাদি); মহাপ্রাণ বর্ণের অস্তিত্ব (যেমন: আক্ষে, কাহ্ন, দিঢ় ইত্যাদি) এবং ওড়িযা-সুলভ ‘ল’ (l)-ধ্বনি বজায় থাকা।
- প্রাকৃতের সমযুগ্মব্যঞ্জন সরলীকৃত হয়ে চর্যায় একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছে। ফলে পূর্বস্বরের পূরকদীর্ঘত্ব ঘটেছে। যেমন: প্রাচীন ভারতীয় আর্য ‘মধ্য’> মধ্য ভারতীয় আর্য “মজ্ঝ” > প্রাকৃত বাংলা ‘মাঝ’ ইত্যাদি।
- নাসিক্যব্যঞ্জনের পূর্বস্বর দীর্ঘত্বলাভের সঙ্গে সঙ্গে অনুনাসিক হয়ে গেছে। যেমন: চন্দ্র>চন্দ>চাঁদ ইত্যাদি।
- পাশাপাশি অবস্থিত একাধিক স্বরধ্বনির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেমন: উদাস>উআস। পদান্তেও স্বরধ্বনির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: ভণতি>ভণই ইত্যাদি।
- পদান্তে স্থিত একাধিক স্বর যৌগিক স্বররূপে উচ্চারিত হতো এবং ক্রমে দুইয়ে মিলে একক স্বরে পরিণত হত। যেমন: প্রাচীন ভারতীয় আর্য ‘পুস্তিকা’> মধ্য ভারতীয় আর্য ‘পোত্থিআ’> প্রাকৃত বাংলা ‘পোথী’ ইত্যাদি।
- ‘য়’-শ্রুতি বিদ্যমান ছিল; ‘ব’-শ্রুতিও দেখা গেছে। যেমন: নিয়ড্ডী>নিয়ড়ি; নাই>নাবী ইত্যাদি।
- চর্যায় স্বরসংগতির দু-একটি উদাহরণ মেলে। যেমন: সসুরা (< শ্বশুর) ইত্যাদি।
- “শ”, “ষ”, “স” এবং “ন”, “ণ” – এর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: নিঅ/ণিঅ, নাবী/ণাবী, সহজে/ষহজে, আস(< আশা) ইত্যাদি।
- দীর্ঘস্বর ও হ্রস স্বরের উচ্চারণের পার্থক্য হ্রাস পেয়েছিল। যেমন: শবরি/সবরী, জোই/জোঈ ইত্যাদি।
- পদের আদিতে “য” – ধ্বনি “জ” – ধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। যেমন: জাই/যাই।
রূপতত্ত্ব
- চর্যার নামপদের লিঙ্গভেদ ছাড়াও সর্বনাম, বিশেষণ, সম্বন্ধবাচক শব্দেও লিঙ্গভেদ ছিল। যেমন: হরিণ/হরিণী, শবরা/শবরী, ‘রাতি পোহাইলি’, ‘গুঞ্জরী মালী’ ইত্যাদি।
- একবচন-বহুবচনের পার্থক্য ছিল; সংখ্যাবাচক শব্দযোগে, সমষ্টিবাচক পদযোগে এবং দ্বিরুক্তিপদ প্রয়োগের দ্বারা বহুবচন বোঝান হতো। যেমন: ‘বতিস জোইনী’, ‘পঞ্চবিডাল’, ‘উঁচা উঁচা পাবত’ ইত্যাদি।
- চর্যায় কারক মুখ্যত দুটি। যথা: মুখ্যকারক ও গৌণকারক। মুখ্যকারকে বিভক্তি শূণ্য বা – এ। যেমন: ‘সরহ ভণই’, ‘কুম্ভীরে খাঅ’ ইত্যাদি। গৌণকারকে – এঁ বা – এ বিভক্তি। যেমন: ‘সহজে থির করি’ (কর্ম কারক), “কুঠারে ছিজঅ” (করণ কারক), “হিএঁ মাঝে” (অধিকরণ কারক) ইত্যাদি। বিভক্তিহীনতার উদাহরণও পাওয়া যায়। যেমন: ‘কায়া তরুবর’।
- – এর ও -ক বিভক্তির মাধ্যমে সম্বন্ধপদ নিষ্পন্ন হতো। যেমন: ‘রুখের তেন্তুলি’, ‘করণক পাটের আস’ ইত্যাদি।
- – ক, – কে ও – রে বিভক্তি দ্বারা গৌণকর্মের ও সম্প্রদানের পদসিদ্ধ হতো। যেমন: ‘নাশক’, ‘বাহবকে পারই’, ‘রসানেরে কংখা’ ইত্যাদি।
- – ই, – এ, – হি, – তেঁ ও –ত অধিকরণের বিভক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। যেমন: ‘নিঅড়ি’, ‘ঘরে’, ‘হিঅহি’, ‘সুখদুখেতেঁ’, ‘হাঁড়িত’ ইত্যাদি।
- করণের বিশিষ্ট বিভক্তি –এঁ সপ্তমীর সঙ্গে প্রায় অভিন্ন হওয়ার কারণেও – তেঁ, – এতেঁ, – তে বিভক্তি দেখা যায়। যেমন: ‘সাঁদে’ (<শব্দেন), ‘বোধেঁ’ (<বোধেন), ‘মতিএঁ’, ‘সুখদুখেতেঁ’ (< সুখদুঃখ + এ + ত + এন)।
- অপাদানে অপভ্রষ্ট থেকে আগত – হুঁ বিভক্তি দু-একটি পাওয়া গেছে। যেমন: ‘খেপহুঁ’, ‘রঅনহুঁ’।
- চর্যাপদে গৌণকারকে ব্যবহৃত অনুসর্গেও (postposition) বৈচিত্র্য দেখা যায়। যেমন: ‘ডোম্বী-এর সঙ্গে’ (নামবাচক অনুসর্গ), ‘দিআঁ চঞ্চালী’ (অসমাপিকা অনুসর্গ)।
- সংস্কৃতের মতো কর্মভাববাচ্যের প্রচুর উদাহরণ চর্যাপদে আছে। যেমন: ‘নাব ন ভেলা দীসই’, ‘ধরন ন জাই’ ইত্যাদি।
- চর্যাপদে যৌগিক কালের উদাহরণ না থাকলেও যৌগিক ক্রিয়ার উদাহরণ প্রচুর আছে। যেমন: ‘গুণিআ লেহুঁ’, ‘নিদ গেল’ ইত্যাদি।
- নিষ্ঠাপ্রত্যয়ে – এ বিভক্তি দেখা যায়। যেমন: ‘সহজে থির করি’ ইত্যাদি।
- চর্যায় এমন সব বিশিষ্ট প্রয়োগ আছে যা বাংলা ভাষাভিন্ন অন্য ভাষায় পাওয়া যায় না। যেমন: ‘ভান্তি ন বাসসি’, ‘দুহিল দুধু’ ইত্যাদি।
- কর্মভাববাচ্যে অতীতকালে – ই, – ইল এবং ভবিষ্যতকালে – ইব বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন: ‘চলিল কাহ্ন’, ‘মই ভাইব’ ইত্যাদি।
- প্রাচীন বাংলার চর্যাপদে ব্যবহৃত প্রবচনগুলি বাংলা ভাষায় ঐতিহ্যবাহী। যেমন: ‘হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’, ‘আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী’ ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার সাথে সম্পর্ক
চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁর “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা” গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ, কৃষ্ণাচার্য প্রমুখের রচনাগুলিকে প্রাচীন বাংলা ভাষার সাক্ষ্যরূপে উপস্থাপন করেন।
চর্যাভাষার কিছু নির্দিষ্ট বাংলা বৈশিষ্ট্য:
- ক্রিয়ার অতীত রূপ: –ইল (যেমন: চলিল)।
- ভবিষ্যত রূপ: –ইব (যেমন: করিব)।
- অনুসর্গ: “মাঝে”, “সঙ্গে”, “অন্তরে”।
- নিত্য কথ্য রীতি: “হাড়ীত ভাত নাহি”, “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী” – এগুলো পরবর্তীকালে বাংলা প্রবচনে পরিণত।
ভাষা-বিতর্ক: অঞ্চলভিত্তিক দাবিসমূহ
চর্যাপদের ভাষা নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিক মহলে দীর্ঘদিন যাবত তীব্র বিতর্ক চলমান রয়েছে। একদিকে অনেক পণ্ডিত এই ভাষাকে প্রাচীন বাংলা ভাষার প্রাথমিক রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, অন্যদিকে একদল ভাষাবিদ মনে করেন এটি বাংলা, অওধি, মাগধি সহ পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন উপভাষার সংমিশ্রণ। বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্বজ্ঞ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ভাষাকে “অবহট্ঠ থেকে বাংলা ভাষার উত্তরণকালীন রূপ” হিসেবে চিহ্নিত করে “Proto-Bengali” বা “আদ্য বাংলা” নামকরণ করেছেন। অন্যদিকে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেন চর্যাপদের ভাষাকে মধ্যভারতীয় অপভ্রংশ ধারার একটি ভাষাগত নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। চর্যাপদের ভাষার বৈশিষ্ট্যে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের উপাদান স্পষ্টভাবে দেখা যায়; পাশাপাশি ধাম্মপদের পালি ভাষার ছায়াও এতে প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাগীতির রূপ, ধ্বনি ও শব্দচয়নের গভীর বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, এটি আঞ্চলিকতা ও কাব্যিক সংকেতের মিলনে গঠিত এক বহুধা-উৎপত্তির ভাষা, যার ওপর আধুনিক বাংলা ভাষার পরবর্তী বিকাশ অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
বাংলা ভাষার সাথে সম্পর্ক
বাংলা ভাষার সাথে চর্যাপদের সম্পর্ক নিয়ে ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকা অংশে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ, কৃষ্ণাচার্য এবং ডাকার্ণবের দোহাগুলোকে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও এই দাবিকে সমর্থন করে প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে ১৯২০ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদার এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে চর্যা ও অন্যান্য কবিতার সঙ্গে বাংলা ভাষার সরাসরি সম্পর্ক নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন।
তবে ১৯২৬ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দের বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধুমাত্র এই সাহিত্যকর্মগুলোকে প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। পরবর্তী বছর ১৯২৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত এই ভাষার প্রাচীন বাংলার স্বরূপ হিসেবে গ্রহণ করেন।
অন্যদিকে, কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের কিছু অংশে “অর্ধ-মাগধী পদাশ্রিত গীতি” পাওয়া যায় যা চর্যাগীতির প্রভাবে রচিত। জয়দেবের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে বলে জানা যায় এবং তার নামে সেখানে প্রতি বছর একটি উৎসব মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
চর্যাপদের রচয়িতা সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই বাংলার অধিবাসী ছিলেন। যেমন শবরপা, কুক্কুরিপা এবং ভুসুকুপা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চর্যার ভাষার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক প্রমাণ করে এমন ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- সম্বন্ধপদের “-অর” বিভক্তি যেমন “-era,” “-ara” ইত্যাদি, সম্প্রদানে “-কে” এবং সম্প্রদানবাচক অনুসর্গ “অন্তরে” (মধ্যযুগীয় ও আধুনিক বাংলায় “-তে” রূপে)।
- অধিকরণে “-অন্ত,” “-ত” এবং অধিকরণবাচক অনুসর্গ “মাঝে” (majha)।
- অতীত ক্রিয়ায় “-ইল” (-il-) এবং ভবিষ্যত ক্রিয়ায় “-ইব” (-ib-) ব্যবহার। মৈথিলী বা পূর্বীয় হিন্দি ভাষায় এই ক্রিয়াপদের প্রত্যয় যথাক্রমে “-অল” ও “-অব” হিসেবে ব্যবহৃত হত।
- “গুনিয়া,” “লেহঁ,” “দিল,” “ভণিআঁ,” “সড়ি,” “পড়িআঁ,” “উঠি গেল,” “আখি বুজিঅ,” “ধরন ন জাঅ,” “কহন না জাই,” “পার করেই,” “নিদ গেলা,” “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী,” “হাড়ীত ভাত নাহি” ইত্যাদি বাগধারা ও শব্দযোগবাংলায় পরবর্তী কালে বহুল প্রচলিত ছিল। যদিও এর মধ্যে কিছু শব্দ যেমন “তসু,” “জৈসন,” “জিস,” “কাঁহি,” “পুছমি” প্রভৃতি পশ্চিমা অপভ্রংশ, চর্যায় মূলত ঋণাত্মক (কৃতঋণ) হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
- সম্প্রদানে “-ক” ও “-সাথ,” “-লাগ,” “-লগ” এর পরিবর্তে “সঙ্গে,” “সম” অনুসর্গের ব্যবহার এবং নাসিক্যধ্বনির ব্যাপক উপস্থিতির কারণে চর্যার ভাষাকে রাঢ় অঞ্চলের ভাষা বলে মনে করা হয়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, “চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, সোমপুরী, বিক্রমপুর — যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন।”
এর বাইরে অধিকরণ কারক হিসেবে “-তে,” কর্তৃকারক “-তা,” বর্তমান কালের সাধারণ ক্রিয়া “-আই” (-Ai), কর্মপ্রবচনীয় অনুসর্গ যেমন “antara” (অন্তর), “sanga” (সঙ্গ), বর্তমান কৃদন্ত (present participle) “-অন্ত,” কনজাংকটিভ ইনডেক্লাইনেবল “-ia,” কনজাংকটিভ কন্ডিশনাল “-ite,” প্যাসিভ “-ia” এবং সাবস্টেনসিভ রুট “ach” (আছ) ও “thak” (থাক) চর্যাপদের ভাষার সাথে বাংলার মিলের নিদর্শন।
এই সব বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি না থাকলে অনেক বিশিষ্ট ভাষাবিদ যেমন রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রভৃতি চর্যাকে নিজেরা যেসব ভাষার প্রাচীন নিদর্শন দাবি করেছেন, তাদের দাবিকে যথাযথ প্রমাণের অভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি।
সার্বিকভাবে বলা যায়, চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার গভীর এবং সুসংহত সম্পর্ক রয়েছে যা আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ পদচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত।
অসমীয়া ভাষার সাথে সম্পর্ক
অসমীয়া ভাষার সঙ্গে চর্যাপদের গভীর সম্পর্ক পাওয়া যায়। লুইপা কামরূপের বাসিন্দা ছিলেন এবং তিনি দুটি চর্যা রচনা করেছিলেন। এছাড়াও সরহপা নামে একজন কবি ছিলেন, যিনি বর্তমান গুয়াহাটির কাছে রাণী নামে একটি স্থানের অধিবাসী ছিলেন বলে জানা যায়। চর্যাপদ ও অসমীয়া ভাষার মধ্যে যেসব মিল লক্ষণীয়, তা নিম্নরূপ:
- না-বোধক শব্দের ব্যবহার: অসমীয়াতে না-বোধক শব্দ ক্রিয়াপদের আগে আসে, যেমন “না যাই”, “না জীবামী”, “না ছদা”, “না জানি”, “না ডিসা” ইত্যাদি চর্যাপদেও একইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
- বর্তমান কৃদন্ত (Present Participle): বৈষ্ণব যুগে অসমীয়াতে -ante প্রত্যয় ব্যবহৃত হতো, যেমন “jvante” (বেঁচে থাকার সময়), “sunante” (শোনার সময়), যা চর্যাপদেও পাওয়া যায়।
- অসমাপিকা ক্রিয়া: -i এবং -iya প্রত্যয় আধুনিক ও পুরাতন অসমীয়াতে ব্যবহৃত হত, চর্যাপদেও “kari”, “cumbi”, “maria”, “laia” এর মতো রূপ পাওয়া যায়।
- সাধারণ বর্তমান ক্রিয়া রূপ: অসমীয়াতে -ai প্রত্যয় চর্যাপদেও দেখা যায়, যেমন “bhanai”, “tarai”, “pivai”।
- ভবিষ্যত কাল: অসমীয়ার মত চর্যাপদেও -iva প্রত্যয় ব্যবহার হয়েছে, যেমন “haiba”, “kariba”।
- নাম বিভক্তি: অসমীয়ার নাম বিভক্তি -e (এ) কেসের সাথে মিল রয়েছে, যেমন “কুম্ভিরে খা”, “কোর নীলা”।
- তৃতীয়া বিভক্তি: অসমীয়ার তৃতীয়া বিভক্তি -e এবং -era চর্যাপদেও পাওয়া যায়, যেমন “uju bate gela”, “kuthare chijaa”।
- শব্দভাণ্ডার: চর্যাপদে কিছু অ-তৎসম শব্দ পাওয়া যায়, যা এখন অসমীয়ার শব্দভাণ্ডারের অংশ, যেমন “dala”, “thira kari”, “tai”, “uju”, “caka” ইত্যাদি।
এই সমস্ত ভাষাতাত্ত্বিক মিল চর্যাপদের অসমীয়া ভাষার সাথে নিবিড় সংযোগ প্রমাণ করে।
ওড়িয়া ভাষার সাথে সম্পর্ক
ওড়িয়া কবিতার শুরু চর্যা সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই সাহিত্যচর্চার সূচনা হয় মূলত মহাযান বৌদ্ধ কবিদের দ্বারা, যারা “সন্ধ্যা ভাষা” নামে পরিচিত নির্দিষ্ট আকারে রচনা করতেন। কাহ্নপারসহ অনেক কবি উড়িষ্যার স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন। চর্যার ভাষাকে প্রাকৃত ভাষার একটি রূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। করুণাকর কর তাঁর গ্রন্থ Ascharya Charyachaya তে উল্লেখ করেছেন যে উড়িষ্যা ছিল চর্যাপদের উৎপত্তিস্থল, কারণ বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান সম্প্রদায় এখানে বিকশিত হয় এবং বৌদ্ধধর্মে নারী পূজার ধারাও এখানে শুরু হয়েছিল। মাতৃ ডাকিনির পূজা ও “কায়া সাধনা” এর মত অনুশীলন এই নতুন সংস্কৃতির অংশ ছিল। একটি তত্ত্ব অনুসারে, লক্ষ্মীঙ্করা ও পদ্মসম্ভবের মতো বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ উড়িষ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে ওড্ডিয়ান শব্দটি আসলে উড়িষ্যার প্রতিশব্দ।
চর্যাপদে আদি সিদ্ধগণের কায়া সাধনা এবং শাকি (নারী নীতি) উপাসনার ধারণা ও অভিজ্ঞতার কাব্যিক প্রকাশ পাওয়া যায়। এই সাহিত্য পূর্ব ভারতীয় ভাষার আদিম রূপ — প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রথম সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত। অনেকে দাবি করেন যে চর্যাপদের কবিরা প্রধানত উড়িষ্যা অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন এবং তাদের চিন্তা-চেতনা ও শৈলী প্রাচীন ওড়িয়া সাহিত্যের কবিতাকে প্রভাবিত করেছে, যা মূলত ষোড়শ শতাব্দীর পঞ্চশাখা যুগের ওড়িয়া কবিতায় স্পষ্ট।
চর্যাপদে ব্যবহৃত রাগ, বিশেষ করে মহাসিদ্ধদের লেখা গানের রাগগুলোর উৎপত্তিও ঐতিহ্যগতভাবে উড়িষ্যার বলে বিবেচিত। এগুলো উড়িষ্যার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত, যেমন ওডিসির রাগের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা দ্বাদশ শতকের গীতগোবিন্দ থেকে শুরু করে ১৪শ থেকে ১৯শ শতকের ধ্রুপদী ওড়িয়া সাহিত্য পর্যন্ত বিস্তৃত।
কাহ্নপার কবিতার ভাষার সঙ্গে ওড়িয়ার ভাষার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
Ekasa paduma chowshathi pakhudi Tahin chadhi nachaa dombi bapudi
(এখানে “পদ্ম” অর্থ পদ্মফুল, “চৌষট্টি” মানে ষষ্ঠষট্টি সংখ্যা, “পাখুড়ি” অর্থ পাপড়ি, “তাহিন” মানে সেখানে, “চড়ি” অর্থ চড়ে ওঠা, “নাচা” অর্থ নাচা, “ডমবি” একটি তফসিলি সম্প্রদায়ের নারী, যা বাংলা ও উড়িষ্যা উভয় ভাষায় ব্যবহৃত এবং “বাপুড়ি” ওড়িয়া ভাষায় দরিদ্র ব্যক্তিকে বোঝায়।)
আরেকটি মত অনুসারে, কবি জয়দেব ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের পুরীর নিকটবর্তী কেন্দ্রবিল্ব শাসনের ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তর্গত ছিলেন। তিনি নিজেও লিখেছেন, “কেন্দবিল্ব সমুদ্র সম্ভব”। উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতিতে জয়দেবের অবদান ও প্রভাব অনস্বীকার্য। জয়দেবের গীতগোবিন্দের কিছু অংশে “অর্ধ-মাগধী পদাশ্রিত গীতি” পাওয়া যায়, যা চর্যাগীতির প্রভাবে রচিত। যদি তাই হয়, তাহলে গীতগোবিন্দের এই “অর্ধ-মাগধী পদাশ্রিত গীতি” চর্যাগীতির ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ওড়িয়া ভাষার সম্পর্ককেই নির্দেশ করে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, চর্যা সাহিত্য ও ওড়িয়া কবিতার মধ্যে ঐতিহাসিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক গভীর সংযোগ বিদ্যমান, যা প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে গড়ে উঠেছিল।
মৈথিলী ও কুড়মালি ভাষা
কিছু আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক যেমন ঝাড়খণ্ডের গবেষকগণ চর্যাপদের ভাষার সাথে কুড়মালি ভাষার ঘনিষ্ঠতা দেখিয়েছেন। আবার মৈথিলী বা অওধির অনুরূপ রূপও কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়।
আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশে চর্যাপদের অবদান
চর্যাপদ বাংলা ভাষার ধ্বনি, রূপ ও শব্দভাণ্ডারের আদিরূপ ধারন করে আছে। এ কারণে ভাষাতাত্ত্বিকেরা একে “Proto-Bengali” বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। চর্যাপদের ছন্দ, শব্দচয়ন, ব্যাকরণ এবং প্রয়োগরীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে একটি পরিণত সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ইত্যাদিতে চর্যার প্রভাব স্পষ্ট।
উপসংহার
চর্যাপদের ভাষা বাংলা সাহিত্যের শেকড়। যদিও তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব রয়েছে, তথাপি চর্যাগীতি বাংলা ভাষার এক আদিম রূপ – সন্ধ্যা ভাষায় লিখিত এক অভাবনীয় সাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক নিদর্শন। আজ ভাষা-বিতর্ক অনেকটাই নিরসিত। বাংলা ভাষার ইতিহাসে চর্যাপদের স্থান একেবারেই মৌলিক, অতুলনীয় ও গর্বজনক। চর্যাপদ শুধু বাংলা সাহিত্যের উৎসস্থল নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাসও এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আলোচিত ও যুক্ত হয়।
গ্রন্থপঞ্জি (সংক্ষিপ্ত)
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী – চর্যাচর্যবিনিশ্চয়
- ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় – The Origin and Development of the Bengali Language
- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ – Les Chants Mystiques de Saraha et de Kanha
- করুণাকর কর – Ascharya Charyachaya
- বিধুশেখর শাস্ত্রী – Sanskrit Buddhist Literature of Nepal
- সুকুমার সেন – Bengali Language: Origin and Development
https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-ভাষা-ও-ভাষা-বিত/