⭐ চর্যাপদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ও বাংলা ভাষার উৎপত্তিতে এর ভূমিকা
ভূমিকা
বাংলা ভাষার ইতিহাসে চর্যাপদের আবির্ভাব এক যুগান্তকারী ঘটনা। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত এই সাধনমূলক গীতিকবিতাগুলো বাংলার প্রাচীনতম রচিত সাহিত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলা ভাষার ধ্বনিগত, রূপগত, বাক্যবিন্যাসগত ও শব্দভাণ্ডারগত বিবর্তনের প্রাথমিক দলিল হিসেবে চর্যাপদ বাংলা ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। এ ভাষা সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ ও আঞ্চলিক বাংলা ভাষার সম্মিলিত আদি রূপ। ফলে চর্যাপদ শুধু সাহিত্য নয়—এটি বাংলা ভাষার জন্ম, বিকাশ, রূপান্তর ও স্বকীয়তা পর্যালোচনার একটি মূল ভিত্তি।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি, ঐতিহাসিক পরিবর্তন, সামাজিক-ভাষাগত পরিবেশ এবং ভাষার আদি স্বরূপ নির্ণয়ে চর্যাপদের ভূমিকা অসামান্য। একসময় অনেকেই বিশ্বাস করতেন বাংলা ভাষা অপেক্ষাকৃত নবীন; কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর চর্যাপদ আবিষ্কার সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বাংলা ভাষার প্রাচীনতা প্রতিষ্ঠা করেছে। এই প্রবন্ধে চর্যাপদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, ধ্বনিবিন্যাস, রূপ ও বিকৃতি, শব্দভাণ্ডার, বাক্যরূপ, সন্ধ্যাভাষার প্রভাব এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব-নির্ণয়ে এ পদের অবদান বিশ্লেষণ করা হবে।
প্রথম অধ্যায় : চর্যাপদের ভাষার উৎস ও পরিচয়
চর্যাপদের ভাষাকে অনেকেই ‘প্রাচীন বা অতি প্রাচীন বাংলা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটি সরাসরি আজকের বাংলা নয়, বরং বাংলা ভাষার জন্মপর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এই ভাষার মূল উৎস—
১. সংস্কৃত
২. প্রাকৃত
৩. অপভ্রংশ
৪. প্রাচীন পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক ভাষা (বিশেষত গৌড়ীয়, কামরূপী, রাঢ়ীয়, বঙ্গীয় ভাষার উপাদান)
সংস্কৃত ভাষার কঠিন শব্দভাণ্ডার চর্যাপদে কম; বরং পালি-প্রাকৃতের সরলতা এবং অপভ্রংশের বিকৃত রূপই এখানে বেশি। ভাষাগবেষক সুনীতিকুমার চ্যাটার্জি চর্যাপদের ভাষাকে বাংলা ভাষার আদিম রূপ বা “early Apabhramśa leading to Gaudiya Apabhramśa” বলে উল্লেখ করেছেন।
১.১ ভাষা-বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ
চর্যাপদের ভাষা—
- সংস্কৃতের কঠোর নিয়ম থেকে মুক্ত
- পালি-প্রাকৃতের সহজ উচ্চারণ অনুসরণ করে
- অপভ্রংশের ভাঙা রূপ ধারণ করে
- স্থানীয় বাংলা উপভাষার কাঠামো বহন করে
এই ভাষা শুধু আদি বাংলা সাহিত্য নয় বরং বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের প্রথম লিখিত দলিল।
দ্বিতীয় অধ্যায় : ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য
চর্যাপদের ভাষার ধ্বনিব্যবস্থা বাংলা ভাষার পরবর্তী গঠনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
২.১ স্বরধ্বনির ব্যবহার
বাংলা ভাষার স্বরপ্রাধান্য চর্যাপদ থেকেই লক্ষণীয়।
যেমন—
- ‘অ’, ‘ই’, ‘উ’–এর ঘন ব্যবহার
- দীর্ঘ-হ্রস্ব পার্থক্য কমে এসেছে
- ‘ঋ’ ধ্বনির ব্যবহার কম
২.২ ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহার
বাংলায় দন্ত্য ও মূর্ধন্য ধ্বনির দ্বৈততা চর্যায়ই দেখা যায়।
উদাহরণ—
- দ/ড → দ/ড
- চ → স/শ
- কল্প → কল্ল, কাল্ল
২.৩ অনুস্বার ও নাসাল ধ্বনি
অনুস্বারের বহুল ব্যবহার বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
যেমন—
- বান্দা
- কাঁদি
- লিংগ
২.৪ ধ্বনিবিকৃতি
বাংলার মৌখিক ভাষার স্বরূপ বোঝায়—
- “তর্ণই” → “তারাই”
- “পাছে” → “পাছে” (আজও প্রচলিত)
- “চরিয়া” → “চরিয়া”
এগুলো বাংলা উচ্চারণগত ধারার ভিত্তি।
তৃতীয় অধ্যায় : রূপগত বৈশিষ্ট্য
চর্যাপদের রূপতত্ত্ব বাংলা ভাষার বিকাশের মূলধারা।
৩.১ ক্রিয়ার রূপ
বাংলায় ক্রিয়ার শেষে “ই”, “ইল”, “ইয়া” ইত্যাদি প্রত্যয় চর্যাপদে প্রচুর দেখা যায়।
যেমন—
- করিল → “করিল”
- যাই → “যাই”
- গইল → “গেল/গেলো”-এর প্রাচীন রূপ
- হইল → “হল”-এর রূপানুগ
এগুলো আজকের বাংলা ক্রিয়ারূপ গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
৩.২ সর্বনাম
বাংলার সর্বনামরূপও চর্যায় উপস্থিত।
যেমন—
- আমি
- তুমি
- সে
- মোর → আমার
- তোর → তোমার
এগুলো বাংলা সর্বনামের প্রাচীনতাকে প্রমাণ করে।
৩.৩ বিশেষ্য-রূপ
চর্যাপদের বিশেষ্যরূপ বাংলা শব্দতত্ত্বের মূল ভিত্তি।
যেমন—
- ঘর
- মন
- নদী
- নর
- মৎস্য/মীন → মাছ
৩.৪ অব্যয়
বাংলার অব্যয়—
- পাছে
- অই
- বা
- তাই
—চর্যায় ব্যবহৃত হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায় : শব্দভাণ্ডারগত বৈশিষ্ট্য
৪.১ দেশজ শব্দ
বাংলার দেশজ শব্দভাণ্ডার চর্যায় সপ্রতিভ।
যেমন—
- ঘর
- নাউ (নৌকা)
- মাজ্ঝি (মাঝি)
- বান (বর্ষা)
- ধান
- চাল
- মাছ
৪.২ তদ্ভব শব্দ
সংস্কৃত উৎস থেকে এসেছে কিন্তু বাংলা-স্বরে উচ্চারিত হয়েছে এমন শব্দ—
- গরু
- নর
- দেব
- শরীর → সরিরা
৪.৩ তৎসম শব্দ
চর্যায় খুব কম ব্যবহৃত; এটাই বাংলা ভাষার সরল স্বভাবের ইঙ্গিত।
পঞ্চম অধ্যায় : বাক্যবিন্যাস
চর্যাপদের বাক্যগঠন আজকের বাংলার মতোই অনেক স্থানে SOV (Subject + Object + Verb) রীতি অনুসরণ করেছে।
যেমন—
“নাও বাহো মা মাঝি”—
বাহো (তুমি চালাও), মা মাঝি (হে মাঝি, ও গুরু)
বাক্যের সরলতা ও অর্থপ্রবাহ বাংলা বাক্যবিন্যাসের মূলধারা নির্দেশ করে।
ষষ্ঠ অধ্যায় : সন্ধ্যাভাষা ও প্রতীকী রূপ
চর্যাপদের ভাষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সন্ধ্যাভাষা—যা গুপ্ত ভাষা বা প্রতীকী ভাষা।
এ ভাষায়—
- নৌকা = দেহ
- নদী = সংসার
- মাঝি = গুরু
- মাছ = মন
- পদ্ম = চক্র/যোগ
এই শব্দগুলো একই সঙ্গে লৌকিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে।
সন্ধ্যাভাষা বাংলা প্রতীকী ভাষার পূর্বসূত্র।
সপ্তম অধ্যায় : বাংলা ভাষার উৎপত্তিতে চর্যাপদের গুরুত্ব
চর্যাপদ বাংলা ভাষার জন্মপর্বের অমূল্য দলিল। এর মাধ্যমে—
৭.১ বাংলা ভাষা যে প্রাচীন—তা প্রমাণিত
৮ম–১২শ শতকের কবিতা হওয়ায় বাংলা কমপক্ষে ১০০০ বছরের পুরনো ভাষা।
৭.২ বাংলার আঞ্চলিক উপভাষার অস্তিত্ব স্পষ্ট
গৌড়ীয়, কামরূপী, বঙ্গীয় ভাষার মিল চর্যায় পাওয়া যায়।
৭.৩ বাংলা ভাষার বিবর্তনরেখা নির্ণয় সহজ হয়েছে
সংস্কৃত → প্রাকৃত → অপভ্রংশ → আদি বাংলা → মধ্য বাংলা → আধুনিক বাংলা
এই ধারার সাবলীল রূপ চর্যায় দেখা যায়।
৭.৪ বাংলা ক্রিয়া, সর্বনাম, শব্দগঠন—সবই চর্যায় আদি রূপে উপস্থিত
তাই চর্যাপদ ভাষার জন্মসনদ।
৭.৫ চর্যাপদ বাংলা কাব্যভাষার সূচনা
গীতিকবিতার ছন্দ, প্রতীক, লৌকিক শব্দরীতি—সবই পরে বাংলা কবিতার ভিত্তি গড়ে তোলে।
অষ্টম অধ্যায় : হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কার—ভাষাবিজ্ঞানের বিপ্লব
১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে চর্যাগীতি আবিষ্কার করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা ভাষার ইতিহাসকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেন। তাঁর গবেষণা প্রমাণ করে—
- বাংলা ভাষা নবীন নয়
- বাংলা সাহিত্য দীর্ঘকাল অবহেলিত ছিল
- বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য প্রচণ্ড সমৃদ্ধ
পরবর্তীতে ভাষাবিজ্ঞানীরা চর্যায় ভাষার ধ্বনি, রূপ ও ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করে বাংলা ভাষার উৎসতত্ত্ব পরিষ্কার করেন।
নবম অধ্যায় : চর্যাপদের ভাষার সাহিত্যিক শক্তি
চর্যা কেবল ভাষাগত দলিল নয়, এটি শক্তিশালী সাহিত্যিক রীতির জন্ম দিয়েছে—
- সহজ-সরল লোকভাষা
- লৌকিক ও আধ্যাত্মিক প্রতীক
- সংগীতধর্মী আবহ
- গীতিকবিতার ধারা
- ব্যঞ্জনাময় রূপক
বাংলা সাহিত্য ভাষার অন্যতম প্রথম স্তম্ভ চর্যাপদ।
চর্যাপদ বাংলা ভাষার উদ্ভব, বিকাশ ও রূপান্তরের অমূল্য নথি। এর ভাষা সংস্কৃত থেকে অপভ্রংশ হয়ে বাংলা ভাষায় পরিণত হওয়ার সেতু। ধ্বনি, রূপ, বাক্য, শব্দভাণ্ডার, প্রতীক—সব ক্ষেত্রে চর্যায় বাংলা ভাষার জন্মলক্ষণ দৃশ্যমান। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিকবিতা হিসেবে চর্যাপদ কেবল আধ্যাত্মিক সাধনার দলিল নয়, এটি আমাদের ভাষার প্রাচীনতার প্রমাণ, ভাষাবিজ্ঞানের ভিত্তি, সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সূচনা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রাচীনতম প্রতিরূপ।
এই কারণে চর্যাপদ বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক অমর স্মারক—যার মাধ্যমে আমরা আজও দেখতে পাই বাংলা ভাষার আদি শিকড়, জন্মযাত্রা ও বিবর্তনের দ্যুতি।
