
চর্যাপদের ধর্মভাবনা: একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ
চর্যাপদ, বাংলা সাহিত্যের আদিলিপি, শুধুমাত্র সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং ধর্ম, দর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধনার এক অনুপম দলিল হিসেবে গণ্য। চর্যাপদে ধর্মীয় ভাবনার যে সমাবেশ ঘটে, তা মূলত বৌদ্ধ সহজযানী দর্শনের নির্যাস। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দু ও জৈন দর্শনের ছায়াও, যা চর্যাগীতি ও চর্যাকারদের বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তাজগতকে তুলে ধরে।
🔸 চর্যাপদের ধর্মীয় পটভূমি
চর্যাপদের রচয়িতাগণ ছিলেন মূলত সিদ্ধাচার্যগণ, যাঁরা সহজযান বৌদ্ধধর্মের অনুশীলক। সহজযান ছিল মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা, যেখানে সরল ও অনুভবভিত্তিক সাধনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে চর্যাগীতিগুলো একমাত্র বৌদ্ধ ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। চর্যাপদের প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ পদে বেদ, ব্রাহ্মণ ও আর্য যোগীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তৃতীয় ও চতুর্থ পদে জৈন সাধুদের উপস্থিতি এবং পঞ্চম পদে বৌদ্ধদের কথা উঠে এসেছে, যা চর্যাপদের বহুমাত্রিক ধর্মীয় প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করে।
🔸 সহজযান ও বোধিচিত্তের দর্শন
সিদ্ধাচার্যগণ শুধুমাত্র কবি ছিলেন না, তারা ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধকও। তাদের সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল ‘বোধিচিত্ত’কে ‘মহাসুখকমলে’ স্থিত করা। এই ‘বোধিচিত্ত’ হলো একটি ভাববাদী অবস্থা, যেখানে সাধক মায়া ও দ্বৈতবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই সাধনপদ্ধতি আনন্দরূপ, অভিজ্ঞতামূলক ও প্রতীকধর্মী, যা হিন্দু দর্শনের সমাধিতত্ত্ব কিংবা আদ্বৈত বেদান্তের সঙ্গে তুলনীয়।
🔸 দ্ব্যর্থতার ভাষা ও গুহ্যার্থ
চর্যাগীতি সহজ ভাষায় লেখা হলেও, এর অন্তর্নিহিত অর্থ অত্যন্ত সংকেতপূর্ণ ও গুপ্ত। কুক্কুরীপাদ উল্লেখ করেছেন— “এক কোটি লোকের মধ্যে একজন মাত্র চর্যার গুহ্যার্থ অনুধাবন করতে সক্ষম।” এই গুপ্ত ভাষা সাধক-সাধিকার কথোপকথনের একটি রূপ, যা জনসাধারণের সরল বোধের অতীত।
কয়েকটি দ্ব্যর্থতার উদাহরণ:
- ‘চন্দ্র’ = নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস
- ‘হরিণ’ = চিত্ত
- ‘হরিণী’ = জ্ঞানমুদ্রা
- ‘নৌকা’ = মহাসুখকায়
- ‘শবরী’ = দেবী নৈরাত্মা
এসব প্রতীকের সাহায্যে সাধনার গভীর অন্তর্নিহিত তত্ত্বকে রূপ দেওয়া হয়েছে।
🔸 গুরুতত্ত্ব ও সাধনা
চর্যাকারগণ গুরুতত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে, গুরুবিহীন সাধনা অসম্ভব। গুরুই চর্যার গূঢ়ার্থ উপলব্ধির একমাত্র সহায়। এই গুরুতত্ত্ব বৌদ্ধ, হিন্দু উভয় ধর্মীয় ধারার মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।
🔸 ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়
চর্যাপদে একাধারে বৌদ্ধ সহজযান, হিন্দু তান্ত্রিক যোগ, জৈন সাধনা এবং আর্য দর্শনের ছায়া দেখা যায়। এটা প্রমাণ করে, চর্যাগান একটি ধর্মীয় সহাবস্থানের উদাহরণ, যেখানে নানা চিন্তাধারার সম্মিলন সাধকের অভিজ্ঞতাজগতে মিলিত হয়েছে। এই ধর্মীয় সমন্বয় চর্যাপদকে শুধু সাহিত্যের নয়, এক অনন্য ধর্মতাত্ত্বিক দলিল হিসেবে তুলে ধরে।
🔹 উপসংহার
চর্যাপদ শুধু বাংলা সাহিত্যের সূচনা নয়, বরং বৌদ্ধ সহজযানী সাধনা ও তত্ত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারক। এর ভাষা রহস্যময়, চিন্তা গভীর এবং প্রতীকের ব্যবহার অভূতপূর্ব। ধর্মীয় বৈচিত্র্য, গুরুতত্ত্ব, সহজ ভাববাদ এবং মায়া-অতিক্রমী দর্শনের সম্মিলনে চর্যাপদ বাঙালির আত্মিক চেতনার এক গৌরবময় সূত্র হয়ে রয়ে গেছে।
📚 রেফারেন্স
১) ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, The Origin and Development of the Bengali Language, Calcutta University Press
২) মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, Buddhist Mystic Songs (Charyapada)
৩) প্রফেসর বিনয় সরকার, Charyapadas: Mystical Songs of the Tantric Buddhists
৪) রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাহিত্য ও সাধনা: চর্যাগীতির আলোকে
৫) Encyclopaedia of Buddhism (Government of India Publication)
————————————————————————————————————–
📎 @munshi.academy | 🌐 www.munshiacademy.com | 🎙️ বর্ণনা ও গবেষণা: মুনশি আলিম
https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-ধর্মভাবনা-একট/