গোলাম মোস্তফা: জীবনী ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love

গোলাম মোস্তফা: জীবনী ও সাহিত্যকর্ম 

পরিচিতি

গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭–১৯৬৪) ছিলেন একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, লেখক এবং শিক্ষক, যিনি বাংলা সাহিত্যে ইসলামী আদর্শ ও প্রেমের বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য রচনা করেন। তিনি মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্য সাধনা করেছিলেন। বাংলার মুসলিম জাতির জাগরণের পেছনে তাঁর অবদান অসাধারণ এবং তিনি বাংলা সাহিত্যে ইসলামী মূল্যবোধের অক্ষয় স্থাপন করেছেন।

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি

গোলাম মোস্তফা ১৮৯৭ সালে যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকুপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী গোলাম রব্বানী এবং পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার ছিলেন ফারসী ও আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত এবং সাহিত্যানুরাগী। পরিবারে শিক্ষাব্যবস্থা ও সাহিত্যচর্চার পরিবেশ ছিল বিশেষ সমৃদ্ধ।

গোলাম মোস্তফার পরিবারে তিন পুত্র ছিলেন, যার মধ্যে বড় ছেলে মোস্তফা আব্দুল আজীজ ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষক। পরিবারের আরেক সদস্য ছিলেন মুস্তফা মনোয়ার, একজন জনপ্রিয় পাপেট নির্মাতা ও চিত্রশিল্পী। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশী অস্কারজয়ী নাফিস বিন জাফর তার নাতি হিসেবে পরিচিত।

শিক্ষা জীবন

গোলাম মোস্তফার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় চার বছর বয়সে নিজগৃহে ও পাশের দামুকদিয়া গ্রামের পাঠশালায়। এরপর তিনি ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। দুই বছর পড়াশোনা শেষে তিনি শৈলকুপা উচ্চ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে ১৯১৪ সালে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯১৬ সালে দৌলতপুর বি. এল কলেজ থেকে আই. এ এবং ১৯১৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯২২ সালে বিএড (বি.টি) ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তাকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলে।

পেশাগত জীবন

গোলাম মোস্তফার শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয় ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে ব্যারাকপুর সরকারি হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুলে এবং মাদ্রাসা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি বালিগঞ্জ সরকারি ডিমনেস্ট্রেশন হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পান এবং পরে প্রধান শিক্ষকের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি ছিলেন উক্ত বিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক।

১৯৪০ সালে বাঁকুড়া জিলা স্কুলে বদলী হয়ে শিক্ষকতা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯৪৬ সালে ফরিদপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষে ১৯৫০ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

সাহিত্য যাত্রার সূচনা

গোলাম মোস্তফার সাহিত্য জীবন শুরু হয় স্কুল জীবনেই। ১৯১৩ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ‘আন্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশ করেন, যা তার সাহিত্য প্রতিভার প্রাথমিক পরিচয় দেয়। তার কবিতা তখন থেকেই মুসলিম জাতির জাগরণ এবং ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিল।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’ প্রকাশ পেলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিকে অভিনন্দিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির প্রশংসায় বলেছিলেন:

“তব নব প্রভাতের রক্তরাগখানি
মধ্যাহ্নে জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।”

প্রধান কাব্যগ্রন্থ ও সাহিত্যকর্ম

 

গোলাম মোস্তফার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-

  • রক্তরাগ: মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবিতাগুচ্ছ যা বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে।
  • হাস্নাহেনা: ইসলামি আদর্শ ও প্রেমের প্রতিফলন ঘটানো কবিতার সংকলন।
  • খোশরোজ: কাব্যগ্রন্থ যা তার ভাব ও ছন্দের বৈচিত্র্য প্রকাশ করে।
  • সাহারা: মুসলিম সমাজের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ছবি আঁকা হয়েছে এতে।
  • বুলবুলিস্তান: প্রিয় কবিতা সংকলন।
  • বনি আদম: মহাকাব্য যা কোরআনিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচিত, বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি।
  • বিশ্বনবী: নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও চরিত্রের অনবদ্য বর্ণনা, গদ্যে লেখা হলেও কবিতার মত ছন্দময় ও হৃদয়স্পর্শী।

তাছাড়া, তিনি ‘রূপের নেশা’, ‘ভাঙাবুক’, ‘এক মন এক প্রাণ’ নামে উপন্যাস রচনা করেছেন, যা সমকালীন সাহিত্যে আলাদা মাত্রা যোগ করে।

অনুবাদকর্ম

গোলাম মোস্তফা ছিলেন একজন দক্ষ অনুবাদক। তিনি আরবী ও উর্দু ভাষার বিভিন্ন মহান সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ইখওয়ানুস সাফা
  • মুসাদ্দাস-ই-হালী
  • কালাম-ই-ইকবাল
  • শিকওয়া ও জওয়াব এ শিকওয়া
  • আল-কুরআন

এই অনুবাদসমূহ বাংলা সাহিত্যে ইসলামি চিন্তাধারার প্রসারে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে।

প্রবন্ধ ও চিন্তাধারা

তিনি ‘ইসলাম ও কমিউনিজম’, ‘ইসলামে জেহাদ’, ‘আমার চিন্তাধারা’ প্রভৃতি প্রবন্ধ লিখেছেন, যা তার তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। তার চিন্তাধারা ছিল গভীর ও যুক্তিবাদী, যা মুসলিম সমাজের জাগরণের জন্য প্রেরণা যুগিয়েছে।

নিশ্চিত! নিচে গোলাম মোস্তফা সম্পর্কে ২য় ধাপের বিস্তারিত উপস্থাপন করা হলো — এতে থাকবে তার সঙ্গীত জীবন, সাহিত্য বৈশিষ্ট্য, পুরস্কার, মৃত্যু এবং সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রভাব।

 

সঙ্গীত জীবন ও কীর্তি

গোলাম মোস্তফা শুধু একজন কবি ও লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন গীতিকার ও গায়ক হিসেবেও সুপরিচিত। ইসলামী গান, গজল ও মিলাদ মাহফিলে তাঁর অবদান অসামান্য। বিশেষ করে তাঁর রচিত ‘কিয়ামবাণী’ (রসুল আহবান বাণী) গানটি ইসলামী সংগীতের ইতিহাসে অনবদ্য স্থান অধিকার করেছে।

তার গাওয়া গানগুলো আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠেও রেকর্ড হয়েছিল, যা বৃহৎ সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। তাঁর কিছু গান নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করে তিনি গানের জগতে তাঁর প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। কিছু জনপ্রিয় গানের প্রথম লাইন হলো:

  • “হে খোদা দয়াময় রাহমানুর রাহিম”
  • “বাদশা তুমি দীন ও দুনিয়ার নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি”
  • “আমার মুহম্মদ রাসুল”

এই গানগুলি আজও মুসলিম সমাজের মধ্যে প্রেরণা ও অনুপ্রেরণার উৎস।

সাহিত্য বৈশিষ্ট্য ও কাব্যশৈলী

গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের মূল ভিত্তি ছিল ইসলামি আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্য। তিনি লেখালেখিতে কখনোই নিছক সৌন্দর্যবোধ বা রসিকতার জন্য লিখেননি, বরং তার লক্ষ্য ছিল ইসলামের নৈতিকতা, চেতনা ও সামাজিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। তার কবিতায় ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন ছিল পরিলক্ষিত।

তিনি ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সব সময় সতর্ক ছিলেন যেন তার লেখায় ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না হয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জাতির স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অপরিসীম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাকে “নব প্রভাতের রক্তরাগখানি” হিসেবে অভিহিত করে তার প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার কবিতার ছন্দময়তা, ভাষার সরলতা ও ভাবগভীরতা আজও পাঠককে মুগ্ধ করে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

গোলাম মোস্তফার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান করা হয়, যার মধ্যে প্রধান হলো:

  • সিতারা ই ইমতিয়াজ
  • প্রেসিডেন্ট মেডেল

এই পুরস্কারগুলো তার জীবদ্দশায় বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম সমাজে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রদান করা হয়।

মৃত্যু ও শেষ জীবন

গোলাম মোস্তফা তার জীবনের শেষ কয়েক বছর ঢাকা শান্তিনগরস্থ নিজ গৃহে (মোস্তফা মঞ্জিল) অতিবাহিত করেন। দীর্ঘদিন অসুস্থতার পরে ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য এক বড় ক্ষতি ছিল।

সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রভাব

গোলাম মোস্তফার সাহিত্য আজও বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতীক। তিনি বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যে ইসলামি চিন্তাধারার এক শক্তিশালী সেতুবন্ধন স্থাপন করেছেন। তার রচনাগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে এবং সমাজের নৈতিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলে।

সমকালীন কবি, সাহিত্যিক এবং সমাজসংস্কারকরা তাকে সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সাহিত্যকর্ম ও জীবনচরিত নিয়ে আলোচনা করেন। আজকের সময়েও তার কবিতা ও গানের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম ইসলামী ও জাতীয় ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে।

সম্পূর্ণ জীবনী ও সাহিত্যকর্মের সারসংক্ষেপ

গোলাম মোস্তফা ছিলেন একাধারে শিক্ষক, কবি, গীতিকার, অনুবাদক ও চিন্তাবিদ। তার কাজের বিস্তার ছিল অনেকদূর, যা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন।

তাঁর সাহিত্য ও গীতিকর্মে ধর্মীয় ভক্তি, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জাতীয় চেতনার মেলবন্ধন লক্ষণীয়। বাংলা ভাষার সৌন্দর্য এবং ইসলামের গভীর চেতনা তার লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন মহৎ সাধক, যাঁর কাজ যুগ যুগ ধরে পাঠকদের হৃদয়ে অমলিন থেকে যাবে।

https://www.munshiacademy.com/গোলাম-মোস্তফা-জীবনী-ও-সাহ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *