গীতিকবি ও গীতিকাব্য

Spread the love

গীতিকবি ও গীতিকাব্য

 

বাংলা সাহিত্যে গীতিকাব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে বিবেচিত। কবিতার একটি উপশ্রেণী হিসেবে গীতিকবিতা এমন এক ধারা, যেখানে কবিতা পাঠের পাশাপাশি সুরে গাওয়া সম্ভব হয়। এই ধরনের কবিতায় হৃদয়গ্রাহী ভাব, গীতিময় ভাষা ও সংগীতসুলভ ছন্দ ব্যবহার করা হয়। বাংলা গীতিকাব্যের সূচনা উনিশ শতকের মাঝামাঝি হলেও তার শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত। এ ধারার কবিদেরকে সাধারণত গীতিকবি বলা হয়।

গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্য

গীতিকাব্যে সাধারণত প্রেম, প্রকৃতি, বিরহ, সমাজ, মানবতা ও আধ্যাত্মিকতার মতো বিষয় নিয়ে লেখা হয়। এই কবিতার মূল লক্ষ্য পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া দেওয়া এবং শ্রোতার কানে সুরের আবেশ ছড়িয়ে দেওয়া। ছন্দ, অলঙ্কার, তালের সামঞ্জস্য এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষা গীতিকাব্যের মৌলিক উপাদান।

উল্লেখযোগ্য গীতিকবি ও তাঁদের রচনাসমূহ

বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫–১৮৯৪): বাংলা গীতিকাব্যের প্রারম্ভিক পুরোধা। তাঁর রচনায় প্রকৃতি ও প্রেমের মিলন ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য রচনা: প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গ সন্দর্শন (১৮৭০), সারদা মঙ্গল (১৮৭৯)

সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার: সমাজ ও নারীচেতনা তাঁর কবিতার মূল বিষয়। উল্লেখযোগ্য রচনা: মহিলাকাব্য (১৮৮০), সবিতা সুদর্শন (১৮৭০), বর্ষবর্তন (১৮৭২)

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর: গীতিকবিতায় দর্শন ও কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। স্বপ্নপয়ন (১৮৭৩) তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য।

স্বর্ণকুমারী দেবী: বাংলার প্রথম নারী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম, গীতিকবিতাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। রচনা: গাথা (১৮৮০), কবিতা ও গান (১৮৯৫)

অক্ষয়কুমার বড়াল: রোমান্টিক চেতনায় আবিষ্ট কবি, রচনা: প্রদীপ (১৮৮৪), এষা (১৯১৯)

কামিনী রায়: বাংলার প্রথম মহিলা কবি হিসেবে সুপরিচিতা, মানবতা ও নারীবাদ তাঁর গীতিকবিতার মূল বিষয়। রচনা: আলো ও ছায়া (১৮৮৯), মাল্য ও নিমার্ল্য (১৯১৩), অশোক সঙ্গীত (১৯১৪), দীপ ও ধূপ (১৯২৯)

গোবিন্দ চন্দ্র দাস: প্রেম ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যে প্রধান। উল্লেখযোগ্য: প্রসূন, প্রেম ও ফুল, কুমকুম, ফুল রেণু

মোজাম্মেল হোসেন: মুসলিম কবি হিসেবে গীতিকাব্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। রচনা: কুসুমাঞ্জলী (১৮৮২), প্রেমহার (১৮৯৮)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: গীতিকাব্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। রচনা: ভানুসিংহের পদাবলী, গীতাঞ্জলি, ইত্যাদি।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: গানের মাধ্যমে ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলেন। রচনা: আর্যগাথা (১৮৮২), আষাঢ়ে (১৮৯৯), ত্রিবেনী (১৯১২)

রজনীকান্ত সেন: ভক্তিমূলক গীতিকবিতায় বিশেষ খ্যাত। রচনা: বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫), অমৃত (১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০)

সৈয়দ এমদাদ আলী: মুসলিম রোমান্টিক কবি। রচনা: ডালি (১৯১২), হাজেরা (১৯১২)

কায়কোবাদ: ধর্ম ও প্রেমের গীতিকবিতায় শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। রচনা: অশ্রুমালা (১৮৯৫)

কাজী নজরুল ইসলাম: প্রেম, বিদ্রোহ, মানবতা ও ইসলামি ভাবধারা নিয়ে রচিত তাঁর গীতিকবিতা বাংলা সাহিত্যে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। তাঁর গানসমূহ “নজরুলগীতি” নামে পরিচিত।

কুবীর সরকার: বাউল ও লালন-প্রভাবিত সাধক কবি। ভক্তি ও দেহতত্ত্বমূলক গীতিকবিতা রচনা করেছেন। প্রায় ১২০০+ গানের স্রষ্টা।

উপসংহার

বাংলা গীতিকাব্য তার আবেগ, সুর ও রচনার সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। উনিশ শতকে যার রূপরেখা তৈরি হয়েছিল, তা আজও বাংলা সাহিত্য ও সংগীতজগতে অপরিহার্য। গীতিকবিরা শুধু কবিতা লেখেননি, তাঁরা বাঙালির মনের অন্তর্গত অনুভূতিকে গানে, কাব্যে রূপ দিয়েছেন। এই ধারার সংরক্ষণ ও চর্চা বাংলা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

https://www.munshiacademy.com/গীতিকবি-ও-গীতিকাব্য/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *