গিরিশচন্দ্র সেন : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love

✦ গিরিশচন্দ্র সেন : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

গিরিশ চন্দ্র সেন, Girish_chandra_sen
গিরিশ চন্দ্র সেন, Girish_chandra_sen

(বাংলা ভাষায় কুরআনের প্রথম অনুবাদক ও সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রতীক)

🔹 প্রস্তাবনা

ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশের এক আলোকবর্তিকা ছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। বাংলা ভাষায় কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদকারী হিসেবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। অনুবাদ, ধর্মতত্ত্ব, নারীশিক্ষা, সাংবাদিকতা ও সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল উদার মানসিকতা তাঁকে করে তুলেছে একজন ব্যতিক্রমী রেনেসাঁস-পুরুষ।

🔸 জন্ম ও পরিবার

গিরিশচন্দ্র সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে। তিনি জন্মেছিলেন এক বিশিষ্ট বৈদ্য বংশে। পিতা মাধবরাম সেন ও পিতামহ রামমোহন সেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। মৃত্যুবরণ করেন ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট, কলকাতায়।

🔹 শিক্ষা ও ভাষা-জ্ঞান

⚫ ছোটবেলায় ঢাকার পোগোজ স্কুলে পড়াশোনা শুরু করলেও শিক্ষকতার ভয় ও অপছন্দের কারণে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
⚫ নিজ প্রচেষ্টায় শেখেন ফারসি, আরবি, সংস্কৃত, উর্দু ও ইংরেজি
⚫ লক্ষ্ণৌ ও কলকাতায় ইসলামি শিক্ষার জন্য পাঠ গ্রহণ করেন মৌলবী এহসান আলী ও আলিমউদ্দিন সাহেবের নিকট।

🔸 কর্মজীবনের সূচনা

প্রথমে ময়মনসিংহ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে নকলনবিশ হিসেবে যোগদান করেন।
⚫ পরে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
⚫ সম্পাদক ছিলেন ‘সুলভ সমাচার’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও নারী-সমাজের জন্য প্রকাশিত ‘মহিলা’ পত্রিকার।
⚫ ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন।

🔹 ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা

⚫ ১৮৭১ সালে কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রভাবে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন।
⚫ ‘ভাই’ উপাধি পান ব্রাহ্মসমাজ থেকে।
⚫ এরপর শুরু হয় তাঁর অনুবাদক ও ধর্ম-সংলগ্ন কর্মজীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়।

🔸 কুরআনের বাংলা অনুবাদ

বাংলা ভাষায় কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন গিরিশচন্দ্র সেন।
🔹 শুরু করেন ১৮৭৬ সালে, সমাপ্ত করেন ১৮৮৬ সালে।
🔹 প্রথমে অনুবাদকের নাম গোপন রাখা হয়। পরে নিজ নাম প্রকাশ করেন।
🔹 তাঁর অনুবাদ মুসলিম সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও প্রশংসা অর্জন করে।
🔹 কুরআনের অনুবাদের শেষে তিনি বলেছিলেন:

“হর্ষ এই যে, এত কালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, তাহার সমাপ্তি আমার গুরু কেশবচন্দ্র সেনের চক্ষে আর দেখাইতে পারিলাম না।”

🔹 ইসলামি সাহিত্য ও অনুবাদকর্ম

🔸 আরবি, ফারসি ও উর্দু থেকে অনুবাদ করেন শতাধিক ধর্মগ্রন্থ ও আত্মজীবনীমূলক রচনা:

  • তাপসমালা (৯৬ ওলি-আউলিয়ার জীবনচরিত)
  • মিশকাত শরীফ (হাদিস অনুবাদ, ৪ খণ্ডে)
  • তত্ত্বরত্নমালা, তত্ত্ব কুসুম, তত্ত্ব সন্দর্ভমালা
  • দরবেশদের সাধন প্রণালী, দরবেশী (তাসাউফ)
  • গুলিস্তাঁ, বুস্তা, দেওয়ান-ই-হাফিজ, মসনভী-ই-রুমী

 

🔸 জীবনীমূলক গ্রন্থাবলি

মহাপুরুষ চরিত, মহাপুরুষ মোহাম্মদ ও তৎপ্রবর্তিত ইসলাম ধর্ম
ইমাম হাসান ও হোসাইন, চারিজন ধর্মনেতা (প্রথম চার খলিফার জীবনী)
চারটি সাধ্বী মুসলমান নারী, সতীচরিত্র, পরমহংসের উক্তি ও জীবনী
আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সালে।

🔹 নারীশিক্ষা ও সমাজভাবনা

গিরিশচন্দ্র ছিলেন নারীশিক্ষার প্রবল সমর্থক
⚫ ‘বনিতাবিনোদন’ নামে একটি গ্রন্থ লিখে নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
⚫ নারী জাগরণে ‘মহিলা’ পত্রিকা প্রকাশ তাঁর অগ্রণী ভূমিকার প্রমাণ।

🔸 উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন

🔹 গিরিশচন্দ্র সেন ছিলেন বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম প্রতিনিধি।
🔹 তাঁর অনুবাদ ও ধর্মচর্চার মধ্যে এক বৈশ্বিক উদারতা ও সত্য সন্ধান প্রতিফলিত হয়।
🔹 হিন্দু ব্রাহ্ম হয়েও মুসলিম ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করে যিনি ধর্মীয় সহনশীলতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

✅ উপসংহার

গিরিশচন্দ্র সেন কেবল একজন অনুবাদক নন, বরং ছিলেন মানবতার দূত, সর্বধর্মের সেতুবন্ধনকারী এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম আজও আমাদের সাম্য, সহনশীলতা ও সত্যনিষ্ঠার পথ দেখায়।

https://www.munshiacademy.com/গিরিশচন্দ্র-সেন-জীবন-ও-সা/

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *