গন্তব্যহীন মানুষ (ছোটোগল্প)
সকালের স্নিগ্ধতা কেটে গেলেও মনে হলো ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি। আজ আর বাসের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মেইনরোডে যেতেই কাঙ্ক্ষিত বাস পেয়ে গেলাম। বাস চলছে ডিমেতালে। অনেকটা যেমন ইচ্ছে লেখা তার কবিতার খাতা!
আসন অনেকটাই ফাঁকা। বাসের একেবারে পেছনের সিটের এককোণে বসেছেন এক বয়স্ক লোক। মাঝেমধ্যেই ঘুমের ঘুরে সামনে পিছনে হেলে পড়ছেন। আবারও চোখ খুলছেন। ঘুম ভেঙে যেতেই সে সামনে, ডানে বায়ে তাকায়। তারপর আবারও অবলীলায় ঘুমিয়ে পড়ে। কনডাক্টার ভাড়া চাইতেই সে কী যেনো বললো। কিন্তু ভাড়া দিলো না। কাজেই কনডাক্টার উচ্চবাচ্য শুরু করে দিল। আর সে ধ্বনি ক্রমশই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে লাগলো। একসময় তা হাইড্রোলিক সাউন্ডকেও যেন হার মানালো!
আমি লোকটির দিকে তাকাই। চোখেমুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। পরনে লাল জামা। মাথায় বাবরি চুল। রক্তিম চোখ। কথাগুলো খুবই অস্পষ্ট! আফ্রিকান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা থেকেও যেনো আরও কঠিন!
আমি আবারও জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাই। শরতের আমেজ প্রকৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে আবারও অন্যমনস্ত হয়ে পড়ি। কনডাক্টারের হাইড্রোলিক সাউন্ডের গালিতে সে চিন্তার মাঝে ছেদ পড়ে। সে লোকটিকে বাস থেকে টেনে হিচড়ে নামাতে চায়।
আমি ভালো করে খেয়াল করলাম—গাড়িতে অনেকেই পেছন পানে ফিরে তাকাচ্ছে কিন্তু সহানুভূতিটি পর্যন্ত দেখাচ্ছে না। মানবিকতা সত্যিই কি হ্রাস পাচ্ছে? আমি বললাম—কনড্রাকটার সাব, বাদ দিলাউক্কা। ইতা ফারে না।
আমি কথা বলতেই তখন অপর পাশ থেকে আরেকজন আমার মতোই বলতে লাগলো। আর সুযোগবুঝে কনডাক্টারও রাগে উন্মত্ত হয়ে বললো—তাইলে আফনে বাড়া দেউক্কা। ভাড়ার কথা শুনে—পাশের লোকটি চুপসে যাওয়া বেলুনের মতোই একেবারে চুপসে গেল।
এবার আর কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলছে না। সুনসান নীরবতা। আর এ নীরবতা ভেঙে আমি বললাম—তানরে আর কিচ্ছু খইবায় না। তান ভাড়া আমি দিমু। বলেই ভাড়া পরিশোধ করে দিলাম। আমি আরেকবার লোকটির দিকে তাকালাম। কোথায় নামবেন তা সে জানে না। পৃথিবীতে গন্তব্য না জানা এমন কত মানুষই না রয়েছে। কে কার খবর রাখে!
জাফলং স্টেশনে নেমে আমি লোকটিকে বললাম—আমি আপনার ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। লোকটি আমার কাছে আসে। খর্বাকায় মানুষটা আমার দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে কী যেনো বলে। দীর্ঘদিন ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা মানুষ হয়েও সে ভাষার কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না। মনে হলো সান্ধ্যভাষার চেয়েও দুর্বোদ্ধ! আমি তার হাতে আরও ৫০ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিলাম। অদূরে দাঁড়িয়ে কনডাক্টার, ড্রাইভারসহ গুটিকয়েক যাত্রীরা তখনো এ দৃশ্য দেখে চলছে।
সহসাই বৃদ্ধ লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও তাকে পরম মমতায় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করি। পিঠ চাপড়ে বলি— বালা থাকবা। কথাটি বলেই আমি ফিরতি পথে পা বাড়াই। বুকের মাঝখানটায় একটু ভেজা অনুভব করি। পরক্ষণেই তার দিকে তাকাই । লোকটাও চোখ মুছতে মুছতে মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
২৪.০৮.২০২৫ খ্রি.
সিলেট