📝 গদ্যের উৎপত্তি ও বিকাশ
গদ্যের ধারণা ও প্রাচীন ইতিহাস
গদ্যের সংজ্ঞা:
“গদ্য” হলো এমন ভাষার রূপ, যা সাধারণভাবে আলাপচারিতা, বর্ণনা, বিশ্লেষণ ও বিবরণমূলক প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। কবিতার মতো ছন্দ বা মাত্রার বাঁধনে আবদ্ধ না হলেও, গদ্যে রয়েছে চিন্তার স্বাভাবিক প্রবাহ, ভাব প্রকাশের স্বচ্ছতা ও বক্তব্যের বিন্যাসগুণ। এটি সাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, চিঠিপত্র, অনুবাদ, সংবাদ ইত্যাদির জন্য অপরিহার্য।
গদ্যের প্রয়োজনীয়তা:
গদ্য ভাষা জ্ঞানের বাহন। চিন্তা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, আইন, ধর্ম ও রাজনীতি—সবক্ষেত্রেই গদ্য অপরিহার্য। কবিতা আবেগের বাহন হলে গদ্য হলো যুক্তির বাহন।
বাংলা গদ্যের উৎপত্তি:
বাংলা ভাষায় গদ্যরূপের উন্মেষের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে অনেক পরের। যদিও বাংলার মুখের ভাষায় গদ্যচর্চা বহু পুরনো, তার লিখিত রূপ পাওয়া যায় মূলত মধ্যযুগের শেষভাগে এসে। মূলত ধর্মীয়, পৌরাণিক ও অনুবাদমূলক গ্রন্থ থেকেই বাংলা গদ্যর রূপটি বিকশিত হতে থাকে।
গদ্যের আদিরূপ:
১. অনুবাদমূলক ধর্মগ্রন্থ:
- মঙ্গলকাব্যের ভাষা গদ্যঘেঁষা হলেও সম্পূর্ণ গদ্য নয়।
- চণ্ডীমঙ্গল, মানসামঙ্গল, শিবায়ন প্রভৃতি কাব্য হলেও অনেক অংশে গদ্যসুলভ বর্ণনা লক্ষণীয়।
২. খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান:
- পাদ্রী উইলিয়াম কেরি (১৭৬১–১৮৩৪) বাংলা গদ্যের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করেন।
- তিনি ১৮০১ সালে “গ্রামার অব দ্যা বাংলা ল্যাংগুয়েজ” গ্রন্থ রচনা করেন এবং বাংলা বাইবেল অনুবাদ করেন।
- এখান থেকেই বাংলা গদ্যের মান্য রূপ পরিগ্রহ করে।
৩. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০)
- বাংলা গদ্যের ইতিহাসে গদ্যশৈলীর উৎকর্ষের সূচনা ঘটে এই কলেজে।
- রামরাম বসু, লালবিহারী দেব, গোবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ শিক্ষকেরা প্রাকৃতিক বর্ণনা, ইতিহাস, অনুবাদে গদ্যের প্রয়োগ ঘটান।
গদ্যশৈলীর পরিণতি ও ঊনবিংশ শতকের গদ্যবিকাশ
আধুনিক বাংলা গদ্যের নির্মাণ:
১. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–১৮৯১):
- বাংলা গদ্যকে শুদ্ধতা ও সরলতার আদর্শে উন্নীত করেন।
- বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের একটি প্রাঞ্জল ও প্রাঞ্জল রূপ নির্মিত হয়।
২. আকাশবাণী ও সাময়িকপত্রিকায় গদ্য:
- গদ্য রচনার একটি বড় ক্ষেত্র হয় সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র।
- সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সমাচার দর্পণ গদ্য বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৩. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪):
- গদ্য সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কারিগর।
- তিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্পে গদ্যকে সাহিত্যিক রূপ দেন।
- আনন্দমঠ, কপালকুণ্ডলা, কৃষ্ণচরিত্র গদ্য সাহিত্যের মানোন্নয়ন ঘটায়।
গদ্য সাহিত্যের শাখা প্রশাখা গড়ে ওঠে:
১. উপন্যাস – বাংলা গদ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ধারা
২. প্রবন্ধ – চিন্তামূলক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
3. গল্প – ছোট পরিসরে জীবনের প্রতিচ্ছবি
4. ভ্রমণকাহিনি, আত্মজীবনী, জীবনী – আত্মবিশ্লেষণ ও ঐতিহাসিক রূপরেখা
রবীন্দ্রনাথ ও গদ্যচর্চা:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা গদ্যকে সাহিত্যরস ও নন্দনবোধে এক নবস্তরে পৌঁছে দেন।
- গদ্যরচনায় রীতি ও রূপের বৈচিত্র্য
- দর্শন ও কাব্যধর্মিতা গদ্যে সংমিশ্রণ
- চিঠিপত্র, ভানুসিংহের পত্র, রাশিচক্র, গল্পগুচ্ছ – গদ্যের এক নতুন শৈলী
বিশ শতক ও সমকালীন গদ্য সাহিত্য
বিশ শতকের গদ্যবিকাশ:
১. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:
- সরল ভাষা, মানবিক আবেগ ও সামাজিক বাস্তবতায় গদ্য সাহিত্যের সার্থক রূপায়ণ।
- দেবদাস, শ্রীকান্ত, পল্লীসমাজ – সাধারণ মানুষের ভাষায় অসাধারণ সাহিত্য।
২. প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলন:
- কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, জসীমউদ্দীন—সমাজ ও বাস্তবতাভিত্তিক গদ্যচর্চা করেন।
- সাহিত্য হয়ে ওঠে সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী গদ্য সাহিত্য:
- সেলিনা হোসেন, আবু ইসহাক, শহীদুল্লাহ কায়সার, আহমদ ছফা, সেলিম আল দীন – বাঙালি জাতিসত্তা, মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা গদ্যের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
সমকালীন গদ্যধারা:
- আধুনিক উপন্যাস ও ছোটগল্প – নির্মলেন্দু গুণ, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা – হুমায়ূন আহমেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- নন-ফিকশন গদ্য – প্রবন্ধ, কলাম, ইতিহাস, বিজ্ঞানচর্চা
- ডিজিটাল সাহিত্য গদ্য – ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়া, ই-পাবলিশড গদ্য
গদ্যের ভবিষ্যৎ:
- আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়া গদ্যকে এনেছে দ্রুতগতি ও সরলীকরণের দিকে
- ভাষার সহজতর রূপ জনপ্রিয় হলেও গদ্যশৈলীর গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে
- একাডেমিক গদ্য ও সৃজনশীল গদ্যের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে
বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ছিল অনাড়ম্বর, প্রয়োজনে নিবেদিত। ধীরে ধীরে তা সাহিত্যের পরিণত রূপ হয়ে উঠেছে। বাংলা গদ্য শুধু ভাষার নয়, সমাজ, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তারও বাহক। সময়ের প্রয়োজনে গদ্য পরিবর্তনশীল, তবুও তার মূল সত্তা থাকে স্থির—আলোকিত, যুক্তিনির্ভর ও ভাবপ্রবণ।
https://www.munshiacademy.com/গদ্যের-উৎপত্তি-ও-বিকাশ/