কালের দর্পণে ত্রয়ী উপন্যাস : জীবনবোধ ও শিল্পরূপ
মুনশি আলিম
কাল নিরবধি প্রবহমান। নদীর স্রোতের মতোই তা বহমান। জলের জলত্বই যেমন তার ধর্ম, আগুনের অগ্নিত্বই যেমন তার ধর্ম ঠিক তেমনই গতিশীলতাই কালের ধর্ম। অখÐ সময় বা কালের সমষ্টিকেই আমরা বলি মহাকাল। এই মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে অনেক সৃষ্টিই ¤øান হয়ে যায়। আবার অনেক সৃষ্টিই টিকে থাকে। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে হারিয়ে যায় ব্যক্তিসত্ত¡া কেবল টিকে থাকে ব্যক্তির সৃষ্টিশীল কর্ম। এই জন্ম এবং হারিয়ে যাওয়ার খেলা প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরে চলে আসছে। ক্ষণ জীবনের অধিকারী হয়ে অনেকেই ঠাঁয় করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনার পাতায়। নিজের সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে মহাকালের বিমূর্ত পাতায় ব্যক্তিমানসও বেঁচে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই আমরা বেঁচে থাকি, বেঁচে থাকতে চাই। তবে সুস্থ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আমরা যেমন সুস্থভাবে বেঁচে থাকি তেমনই অপসংস্কৃতির মধ্য দিয়েও চলে আমাদের আত্মার তথা অস্তিত্বের নিরন্তর পীড়ন। ভাইরাস যেমন খালি চোখে দেখা যায় না তেমনই অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশও সহসাই আমরা অনুভব করতে পারি না। এই সংস্কৃতিরই এক বিরাট শাখা, সৃষ্টিশীল শাখা সাহিত্য। যেখানে মানুষ সুস্থ হওয়ার, ভালভাবে বেঁচে থাকার মন্ত্রনা পায়।
বিশ্বজোড়া সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার ঘটনা ঘটে চলছে নিত্য। সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমেও সংস্কৃতির পরিবর্তন আসতে পারে, পরিবর্তন আসতে পারে সামাজিক অবকাঠামোর, নীতি-নৈতিকতার। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া বহমান নদীর বাক্ পরিবর্তনের মতই। নদী যেমন কখনো সোজা পথে চলতে পারে না তেমনই সাহিত্যের ধারাও কখনো সোজা পথে চলেনি। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের পরশে কখনো কখনো সে গতিপথের পরিবর্তন হয়েছে। যাদের মাধ্যমে সাহিত্যে তথা কাব্যে নতুন ধারার সৃষ্টি হয় বা নতুন গতিপথের সঞ্চার হয় তাদের আমরা বলি প্রধান সাহিত্যিক। মোজাম্মেল হক নিয়োগীও বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক।
শিশুতোষ গল্প বা কিশোর গল্প লেখার ক্ষেত্রেও তিনি মোটেও পিছিয়ে নন। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে জগৎবিখ্যাত ভাস্কর রোদ্যার সৃষ্টিশীলতা স¤পর্কে বলেছিলেন-“যিনি গড়তে জানেন, তিনি শিবও গড়তে পারেন, বাঁদরও গড়তে পারেন।” আমার কেন যেন মনে হয় আজ এই কথাটি সুপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেলক হক নিয়োগীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা গল্প রচনায় তিনি যেমন সিদ্ধহসস্থ তেমনই সিদ্ধহস্ত উপন্যাস বা প্রবন্ধ রচনাতেও।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ। নিজের মেধা, প্রজ্ঞা আর নিটোল সৃষ্টিশীলতা দিয়েই তিনি বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম প্রধান স্থান দখল করে নিয়েছেন। তাঁর বর্ণনাভঙ্গিতে রয়েছে নিজস্ব স্টাইল। ভাষার ক্ষেত্রেও রয়েছে অবিশ্বাস্য সরলীকরণ। প্রতিটি বাক্যবিন্যাসে তাঁর মুনশিয়ানাা চোখে পড়ার মতো।
কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশুতোষ, অনুবাদ, গবেষণা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই রয়েছে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ। একটি দুটি করে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর অবাধবিচরণ থাকলেও কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি অগ্রগণ্য। কথার বুননে তিনি সিদ্ধ কারিগর। আর এসব বিবেচনায় নিঃসন্দেহে বলা যায় মোজাম্মেল হক নিয়োগী বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। নিচে ক্রমানুসারে তাঁর ত্রয়ী উপন্যাসে’র জীবন ও শিল্পবোধসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হলো:
ফাঁদ : অন্ধকারজগতের নিখুঁত ক্যানভাস
শুধু কাহিনি তুলে আনলেই যেমন সার্থক গল্প হয় না তেমনই গল্পগুলোকে চুইনগামের মতো টেনে বড়ো করলেই সার্থক উপন্যাস হয় না। সার্থক উপন্যাসের জন্য প্রয়োজন শিল্পবোধ। সার্থক উপন্যাসের ঔপন্যাসিককে হতে হয় ত্রিকালদর্শীর মতো বিচক্ষণ! পঠনপাঠনসহ বিচারবিশ্লেষণে তাঁকে হতে হয় সিদ্ধহস্ত। আর এরূপ হলেই তখন কল্পনা ও বাস্তবতার শৈল্পিক সমন্বয়ে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে সার্বজনীন। ফাঁদ এমনই একটি উপন্যাসÑযার সবগুলো চরিত্রকেই মনে হবে আমাদের চিরচেনা। ২০১৩ সালে পার্ল পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো উপন্যাস ফাঁদ। সাড়ে সাত ফর্মার এই বইটির মূল উপজীব্য বিষয় সমকালীন বাস্তবতা। পতিতাশ্রয়ী নারী ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্নজগতের নিটোল ক্যানভাসই এ উপন্যাসে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাবরিনা। কথার গাঁথুনি, গল্পের বিস্তার সর্বোপরি গুরুত্বের দিক থেকে বিবেচনা করলে সাবরিনা থেকেও পুষ্প উজ্জ্বল। পুষ্পই উপন্যাসটিকে দিয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। আপাতদৃষ্টিতে নওয়াব আলী অন্যতম প্রধান চরিত্র হলেও তাকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কাদের চরিত্রটি। উপন্যাস শেষে কাদেরের জন্য পাঠকহৃদয়ে একধরনের হাহাকার সৃষ্টি হয়। সত্য ও সুন্দরের জন্য কাদেরের অপেক্ষার মধ্যে দিয়ে মূলত লেখকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ছায়াপাত ঘটেছে।
উপন্যাসের শুরু তেঁতুলিয়া নদী ও পাশ্ববর্তী গ্রাম। পুষ্প ও কুসুমের বাবা জুবেদ আলীর চরিত্র সত্যিকার অর্থেই জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার ছেলে খাদেম আলীর মৃত্যু গোটা পরিবারকেই শোকে মুহ্যমান করেছে। পুষ্প সেভেন পাস। তার বোনজামাই নওয়াব আলী পতিতাপল্লির দালাল। তার প্ররোচনাতে পড়েই পুষ্প অন্ধকারজগতে পাড়ি জমায়। সে জগতের স¤্রাজ্ঞী সাবরিনা। দেশের সবশ্রেণির মানুষের সঙ্গেই তার লিয়াজোঁ রয়েছে।
একবার পুষ্পকে কয়েকজন সন্ত্রাসি জোর করে তুলে নিয়ে যায়। বর্বরভাবে ধর্ষণ করে। যখন জ্ঞান ফিরে তখন গোটা পুরুষজাতির প্রতিই তার ঘৃণা শুরু হয়। বেশি ঘৃণা জন্ম নেয় তার দুলাভাই নওয়াব আলীর প্রতি। কেননা, তার প্ররোচনার কারণে আজ সে অন্ধকারজগতের বাসিন্দা। তার কারণেই আজ সে সভ্যসমাজে ফিরতে পারছে না। তার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই নওয়াবের ছোটোবোন টুনিকে একদিন সে কৌশল করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে।
সাবরিনার ঘরে টুনিকে রাখে। নওয়াবকে বোঝানো হয় পুরুষের স্পর্শহীন নতুন মেয়ে আছে; টাকা-পয়সা কিছু লাগবে না। পুষ্পই সব দিয়ে দেবে। নওয়াব খুশি হয়। ঝড়ের গতিতে আসে। কাপড় খুলে ঘরে প্রবেশ করেই দেখে তার আপনবোন টুনি! রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে সে পুষ্পকে মারতে যায়। সাবরিনা সমঝোতা করার চেষ্টা করে। হঠাৎ সে ঠান্ডা হয়ে ছাদের ওপর ওঠে। তারপর আকস্মিক লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। বিচারে সাবরিনার আট বছর ও পুষ্পকে দশ বছরের বিনাশ্রম কারাদÐ দেওয়া হয়। পুষ্পকে ভালোবাসে কাদের। সে সাবরিনার বাসাতেই দারোয়ানের চাকরি করে। তার জেল হওয়ার পরেও সে পুষ্পকে নিয়ে ঘরবাঁধার স্বপ্ন দেখে। পুষ্পের পতিতাবৃত্তিকে তার কাছে অপরাধ মনে হয় না। কেননা, পুষ্প ইচ্ছাকৃতভাবে এ জগতে আসেনি। সে প্রতারণা ও প্রহসনের শিকার।
পুষ্পের ভেতর যে রোমান্টিক সত্ত¡া আছে ঔপন্যাসিক তা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। পতিতা মানেই পেশাদার এটা যেমন সত্য তেমনই পতিতা মানেই সামাজিক প্রতারণার শিকার এটাও চরম সত্য। তাদের ভেতরেও সভ্যসমাজে বাঁচার আকুলতা রয়েছে। রোমান্টিক ভাবনা তাদের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয়।
বহুল আলোচিত ও সমালোচিত কাসেম বিন আবুবাকার তার কথাসাহিত্যে পাত্রপাত্রীদের মাধ্যমে মূলত ধর্মপ্রচার করেন। অর্থাৎ তার কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো হয়ে উঠে ধর্মের বার্তাবাহক। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার পাপভ্রষ্টা নারীদের বা নীতিবিচ্যুত নারীদেরকে কোনো না কোনোভাবে শাস্তি দিতেন, কখনো বা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ দিতেন। শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসেও দেখি নীতিচ্যুত হওয়ার কারণে অচলা ও সুরেশ উভয়কেই শাস্তি পেতে। তাদের শাস্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত ঔপন্যাসিকের আদর্শই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। সাহিত্যও প্রভাবপুষ্ট হতে পারে, হতে পারেন সাহিত্যিক নিজেও। মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ফাঁদ উপন্যাসে নওয়াব আলীর মৃত্যুকে অপ্রত্যাশিত এবং আশ্চর্যই মনে হয়েছে। সূ²দৃষ্টিতে এটা আত্মহত্যা নয়, নির্দেশিত মৃত্যু! লেখকের আদর্শিক দ্ব›েদ্বর কারণেই নওয়াব আলীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি হয়েছে।
ভাষার কাজ হচ্ছে মিথস্ক্রিয়া। সাহিত্যের কাজও। ফাঁদ উপন্যাসের ভাষার সরলীকরণ অত্যন্ত চমৎকার। প্লট ও ঘটনাপ্রবাহের পরম্পরা পাঠকহৃদয়কে ভরা নদীর ¯্রােতের মতোই প্লাবিত করবে। যৌনঘেঁষা বিষয়গুলোকে ঔপন্যাসিক কোনো ধরনের জড়তা ছাড়াই সরলভাবে বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসের পটভূমি বরিশাল ও ঢাকাকেন্দ্রিক। চরিত্রের সংলাপেও অঞ্চলিক আবহ জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বরিশালের আঞ্চলিক সংলাপে কোথাও কোথাও ময়মনসিংহের ভাষার প্রভাব রয়েছে। উপন্যাসের কোনো কোনো স্থানে লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই কুসুমের বাবা শব্দটির বহুলপ্রয়োগ করে বিশেষ্যের অতিশায়ন করেছেন। যা উপন্যাসের গতিময়তা ও শ্রæতিময়তা কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করেছে।
ঔপন্যাসিকের সবচেয়ে বড়ো দক্ষতা হলো চরিত্র অনুযায়ী সংলাপের সুনিপুণ ব্যবহার। অবস্থাভেদে সে সংলাপও বেশ গুরুত্ব বহন করে। একটি উপন্যাসের পটভূমি ক্ষুদ্র কোনো স্থানকে কেন্দ্র করে হলেও ঔপন্যাসিকের শিল্পছোঁয়ায় তা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক। প্রয়োজনমাফিক চরিত্রচিত্রণ তাঁর একটি বড়ো গুণ। ভাব ও ঘটনার পরম্পরা রক্ষা করা সবচেয়ে বড়ো দুঃসাধ্য কাজ। অনেক কথাসাহিত্যিকই এ থেকে ছিটকে পড়েন। পতিতা ও পতিতালয় সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। সহসা লেখকরা এমন বিষয়কে উপজীব্য করে মূল কাহিনি নির্মাণ করতে চান না। কিছুটা ভয়, কিছুটা জড়তা লেখককে এসব বিষয় থেকে দূরে রাখে। মোজাম্মেল হক নিয়োগী এদিক বিবেচনায় বেশ সাহসী এবং দক্ষ কারিগর।
ফাঁদ উপন্যাসে সাবরিনা, পুষ্প, নওয়াব আলী, কাদের, মদিনা, টুনি প্রমুখ চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে অন্ধকারজগতের জটিল থেকে জটিলতর দিকগুলোকেই তিনি অবলীলায় উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর লেখার প্লট, ভাব, ভাষা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সন্নিবেশ, পরম্পরা, কাহিনির গভীরতা, সময়ের ঐক্য, ব্যাপ্তি, সমাপ্তি সবকিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অনন্য। ভাষার সরলতা ও কাহিনির গতিশীলতা পাঠকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
শেষ কথাটি যাও বলে : সঙ্গ-প্রসঙ্গ
শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে শেকসপিয়ারের রোমান্টিক কবিতা দিয়ে। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নির্ঝর বেশ উজ্জ্বল। সুহানা ও অধরার মনস্তাত্তি¡ক দ্বৈরথ, নিখুঁত বিশ্লেষণ উপন্যাসটিকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী মাত্রা। একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জীবনালেখ্য আর রোমান্টিক ক্যানভাস সব মিলিয়ে পুরো উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে বেশ উপভোগ্য। উপন্যাসটি পঠনপাঠনে পাঠকের চোখের সামনে একে একে উন্মোচিত হবে ভূগোল, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নানা প্রচ্ছদপট। কথার গাঁথুনি, বর্ণনার সরলীকরণ, ভাবের শৈল্পিক সমীকরণ, দার্শনিক পদবাচ্যসুলভ বুলেট বাক্য সবকিছু মিলিয়ে ঔপন্যাসিকের আবেগধর্মী উপস্থাপন পাঠকহৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে বলেই আমাদের বিশ^াস।
উপন্যাসটিতে মোট অনুচ্ছেদ বা পর্ব রয়েছে ১৮টি। এতে কোনো উপপর্ব নেই। প্রতিটি পর্বের শুরু হয়েছে কবিতা দিয়ে। এতে বাংলা কবিতা সংযোজন করা হয়েছে মোট ১৫টি, ইংরেজি কবিতা সংযোজন করা হয়েছে ১১টি। প্রতিটি পর্ব এবং গল্পের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই কবিতাগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে। প্রতিটি কবিতাই কাহিনির আচ্ছাদনে বেশ প্রাণসঞ্চার করেছে। এই উপন্যাসে একজন পাঠক রোমান্টিক বলয়ের ভেতর দিয়ে মুহূতেই ঘুরে আসবে ইতিহাস ও ভূগোলের গভীর থেকে গভীরে। উপন্যাসে ইতিহাস সংযোজন মোটেও সহজ বিষয় নয়। গল্পের প্লট, চরিত্র, সংলাপ ঠিক রেখে ইতিহাসের সংযোজন ও ভৌগোলিক চিত্র কাহিনির সঙ্গে নিখুঁতভাবে লেপটে দেওয়া কালজয়ী উপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে মোজাম্মেল হক নিয়োগী নিঃসন্দেহে একজন মৌলিক কথাসাহিত্যিক।
বারোটি চরিত্রের সমন্বয়ে এই উপন্যাসের মূল কাহিনি সুসম্পন্ন হয়েছে। প্রধান চরিত্র তিনটি। নির্ঝর, অধরা ও সুহানা। এই চরিত্রত্রয়কে ফুটিয়ে তুলতে ঔপন্যাসিক আশ্রয় নিয়েছেন অন্যান্য চরিত্রগুলোর। বিশেষ করে মাহবুবুল আলম ওরফে মাহবুব, মোশারফ, নাজনিন, রামপদ, সুখেন হাওলাদার, ইমিও, ড. রঘুনাথ বসাক, ড. সুনীল প্রমুখ চরিত্র। হাস্যরসের জন্য বিশেষ কোনো চরিত্র নেই। অবশ্য এটি হাস্যরসপ্রধান উপন্যাসও নয়। নিটোল রোমান্টিক উপন্যাস। জগদ্বিখ্যাত বক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতায় যেমন সম্মোহনী শক্তির জারকরস উপচে পড়ে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদের লেখার মধ্যে যেমন পাঠক বুঁদ হয়ে থাকে তেমনই মোজাম্মেল হক নিয়োগীর এ উপন্যাসে পাঠক বুঁদ হয়ে থাকবে বলেই আমার বিশ^াস। লেখনীর ভেতর সম্মোহনী শক্তি থাকলেই কেবল পাঠককে ধরে রাখা যায়।
উপন্যাসটির পুরো ঘটনটিই প্রায় ভারতে। শুরু হয়েছে যশোরের বেনাপোল দিয়ে। ছয় সদস্যের একটি টিম কোম্পানির তরফ থেকে প্রণোদনা হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ ভ্রমণ অর্থাৎ ভারতে যাচ্ছে। তারা হলেন নির্ঝর, সুহানা, মাহবুব, মোশারফ, নাজনিন, রামপদ। তাদের আনন্দভ্রমণের মধ্য দিয়ে দুই দেশের কাস্টমস কর্মকতাদের ঘুসের চিত্রসহ বাস্তব দিকটিই ফুটে উঠেছে। সুহানা টিম মেমবারদের মধ্যে খুবই বুদ্ধিমতী আর সুন্দরী। অবিবাহিত নির্ঝর আর মোশারফ উভয়েই সুহানার প্রতি দুর্বল। সুহানা নির্ঝরের পাশের সিটে বসে দীর্ঘ ভ্রমণকালে বেশ আনন্দঘন রোমান্টিক সময় কাটায়। আর এসব চিত্র নাজনিনসহ অন্যান্য টিম মেমবারদের নজরও এড়ায় না। সত্য যেমন গোপন থাকে না ঠিক তেমনই আরকি!
নির্ঝর সুহানার অনুমতিক্রমে তাকে সুহা বলেই ডাকে। সুহানার বাবা একটি সরকারি ব্যাংকের এজিএম। ঢাকায় ওদের বাড়ি। আর এসব তথ্য জেনেই ভেতর থেকে সুহানার দিকে এগাতে সাহস পায় না নির্ঝর। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব মাহবুবের কুটিল চোখ কেবলই সুহানাকে খুুঁজে বেড়ায়।
ওয়াইডবিøউসিএ এর গেস্টরুমে অবস্থান থেকে শুরু করে গাইড সুখেন হাওলাদারের মাধ্যমে ভারতের বিভিন জায়গা সম্পর্কে বিস্তর ব্যাখ্যা ও নিটোল বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঘটনা ক্রমশ এগোতে থাকে। সুখেনের আগমনের পর শুরু হয় নতুন টানপোড়েন। অন্তর্দহনে পুড়তে থাকে নির্ঝর আর মোশারফ। সুহানার সঙ্গে সুখেনের নতুন বন্ধুত্বে রীতিমতো দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ^াস ফেলে মাহবুব।
কফিহাউজ, ধর্মতলা, হাওড়া, কলকাতার সংস্কৃতি আর সে সংস্কৃতির সঙ্গে মাহবুব, নির্ঝর, মোশারফ আর রামপদের অভিযোজন উপন্যাসে নতুন ব্যঞ্জনের সৃষ্টি করেছে। ইন্ডিয়ার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার নগ্নচিত্র পাঠকের চোখের সামনে চিত্রের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নাজনিন হয়ে উঠেছে এন্টি চরিত্র। কথাসাহিত্য বা নাটকে এমন চরিত্র না থাকলে প্রধান চরিত্রের গুণগুলোকে ফুটানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাছাড়া এসব এন্টি চরিত্রগুলোই পাঠকহৃদয়কে নানাভাবে দহনে পুড়াতে থাকে। টিপু সুলতানের দুর্ঘ, সামার প্যালেসের তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনা, পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে চেন্নাইয়ের বিবরণ পাঠকের ভালোলাগা আর কৌতূহলের মাত্রাকে নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে তুলবে।
মূলত নির্ঝর আর অধরার রোমান্টিক প্রেমকাহিনিই এখানে প্রধান আলোচ্যবিষয়। দুজনের ধর্ম ভিন্ন হলেও হৃদয় ও শরীর রসায়নে মানবমনই প্রধান হয়ে উঠেছে। যেথা ধর্ম কোনোরকমেরই অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি। এই দুই প্রধান চরিত্রের সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিশিরের মতোই নিটোল, শরতের বিকেলের মতোই সুন্দর অধরার হৃদয়। দৈহিক গড়নের দিক থেকে যেমন স্মার্ট তেমনই কথাবার্তায়। বহু গুণেই সে গুণান্বিতা। হিন্দিসহ ইংরেজি আর তামিল ভাষায় তার বেশ দখল রয়েছে।
পার্কে বেড়াতে গিয়েই মূলত শুরু হয় তাদের মনের রসায়ন। দুজনে পাশাপাশি হাঁটা, বৃষ্টিরোধক হিসেবে উভয়ে একই টাওয়ালের ব্যবহার, বাহু জড়িয়ে সম্মুখপানে হাঁটা সবমিলিয়ে এ যেনো নতুন সম্পর্কেরই শুভসূচনার আভাস। নির্ঝর একই রুমে অধরার সঙ্গে রাত কাটালেও বিশ^াসঘাতকতা করেনি। ফলে অধরার বিশ^াস ও ভালোবাসা ক্রমশই নির্ঝরের প্রতি গভীর হতে থাকে। অধরার সঙ্গে নির্ঝরের ভ্রমণ একই সঙ্গে যেমন উপন্যাসের পট পরিবর্তনে নতুন ভূমিকা রেখেছে তেমনই পাঠকহৃদয়ও অজ্ঞাতসারে এ অভিসার বা ভ্রমণকে মেনে নিয়ে নিজেই উজ্জীবিত হতে থাকে।
ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে মানুষের স্বাভাবিক ঈর্ষাকে খুব সরলভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। নির্ঝর ও অধরার নতুন সম্পর্ককে তার টিম মেমবাররা কিছুটা ঈর্ষার চোখেই দেখতে থাকে। বিশেষ করে সুহানা তো অধরাকে নির্ঝরের সঙ্গে দেখলে তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠত। সে জ¦লা বা দহনে কেবল সে নিজেই পুড়ে ছাড়খার হতে থাকে। তবে প্রথম দিকে তাদের পর্যটন গাইড সুখেন হাওলাদারের সঙে সুহানার অন্তরঙ্গতা, আড্ডার ধরন দেখেও নির্ঝরের হৃদয়ে ক্ষরণ হতো। সময়ে অনেককিছুই বদলে যায়। বদলে যায় মানুষের মন, বদলে যায় সম্পর্ক। মাহবুব তাদের টিম লিডার হলেও নির্ঝরের অভিসারে সে কিছুটা হলেও ঈর্ষান্বিত। আর এটা বোঝা যায় তার সংলাপেওÑ“বাহ্! বড়ো জমিয়েছ। আমি তো খরচের খাতায়। সবাই আব্বা ডাকে। আঙ্কেল ডাকে।” মাহবুবের দীর্ঘ দশ বছর ধরে তার স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক টানাপোড়েনের গল্পে মাহবুবের প্রতি কিছুটা হলেও পাঠকহৃদয়ের সহানুভূতির জন্ম হয়।
উপন্যাসের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে পাঠকহৃদয়েও ক্ষরণ হতে থাকেÑযখন মাহবুব কর্তৃক অধরাকে বিশ^াসভঙের মন্ত্র দেওয়া হয়। আর সে ফাঁদে পড়ে অধরা নির্ঝরকে ভুল বুঝতে থাকে। শুরু হয় নতুন ক্লাইমেক্স। শব্দশিল্প আর কাহিনির ব্যঞ্জনায় পাঠহৃদয়ও তখন দলিতমথিত হতে থাকে। ট্রেনিং শেষে তারা বিদায় নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও অধরা অধরাই থেকে যায়। না কথা বলে, না সামনে আসে।
উপন্যাসের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পাঠকহৃদয় আনন্দে বিহŸল হয়ে ওঠেÑযখন দেখে নির্ঝর ও অধরা কথা বলছে। অধরা তার ভুল বুঝতে পেরে এপোলজি স্বীকার করে। শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। ঔপন্যাসিকের ভাষায়Ñ“অধরা আরও কাছাকাছি হলো। এতটা কাছাকাছি এর আগে কখনো হয়নি।”
সংলাপও উপন্যাসের বিশেষ শিল্প হিসেবে বিবেচিত। পাত্রপাত্রীর মুখ দিয়ে সংলাপ বের হলেও পাঠককূল সে সংলাপের মাত্রা ধরে হাঁটে। আবার কোনো কোনো সংলাপ তো জাতীয় সংলাপ হিসেবেও বিবেচিত হয়; আবার কোনোটিও বা হয়ে ওঠে চিরন্তন বাণী।
উপন্যাসের চুম্বক অংশই হলো নির্ঝর আর অধরার হোটেলে রাত্রি যাপন। যে রাত্রির বুনো শরীরে লেগে রয়েছে ভালোবাসা আর বিশ^াসের প্রলেপ। নির্ঝরের নাম পরিবর্তন করে যখন সতীশ আচারিয়া নামে এন্ট্রি করা হলো তখন পুরো বিষয়টাকেই বেশ বাস্তবধর্মী আর উপভোগ্য মনে হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রদ্বয়ের মতো পাঠকের ভেতরও তখন অপার বিস্ময় আর কৌতূহলের ঢেউ অবলীলায় খেলা করে যায়। খেলা করে যায় এক অন্যরকম শিহরন! যেথা পুরুষ পাঠক নিজেই নির্ঝর হয়ে ওঠে আর নারী পাঠক অধরা!
পুরো উপন্যাসটিই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। কাহিনির গাথুঁনি, লেখনীর সম্মোহনী শক্তি এতই জোড়ালো যে পাঠক অবলীলায় কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ছোটোবেলায় আমরা যেমন পড়েছিলামÑ“খুকু যায় যেদিকে চাঁদ যায় সেদিকে”Ñএটাকেও অনেকটা তেমন মনে হবেÑকাহিনি যায় যেদিকে পাঠক যায় সেদিকে! পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রাখা সব ঔপন্যাসিকের পক্ষেই সম্ভব হয় না; তবে কেউ কেউ পারে। ওই যে, জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেনÑসকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবিÑতেমনই সকল ঔপন্যাসিকেরই পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে না, কারো কারো থাকে। আর মোজাম্মেল হক নিয়োগী তেমনই একজন কথাসাহিত্যিক যিনি পাঠককে শুধু ধরেই রাখেন না, কাহিনির চরিত্রগুলোর দুঃখ বা আনন্দে পাঠককূলকেও বিগলিতও করে তোলেন।
সিরাজউদ্দৌলা, আলীবর্দী খান থেকে শুরু করে পুরু মোগল ইতিহাসই প্রায় উঠে এসেছে সংলাপচ্ছলে। উঠে এসেছে তাদের ভেতরের গভীর গোপনীয় দিকটিও। যেমনÑ“আওরঙ্গজেব মারা যাবার পর মোগলদের রক্ষিতা দেড় হাজার নারীকে মুক্তি দেওয়া হয়।” জাপানের কোনো এলাকাভিত্তিক অনুষ্ঠানে সে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককেই প্রধান অতিথি করা হয়ে থাকে। জাপানি তরুণী ইমিওর উপস্থিতি উপন্যাসে তেমন পরিবর্তন না ঘটাতে পারলেও নতুন কমেডি তৈরিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
উপন্যাসের অলিতেগলিতে কবিতাকে কোথাও কোথাও লেখক সচেতনভাবে জুড়ে দিয়েছেন আবার কোথাও কোথাও চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে কবিতাই যুতসই হয়ে লেপটে গিয়েছে। পুরো উপন্যাসে কবিতার আধিক্য বেশি হলেও পাঠক কোথাও বোর হবে না; কেননা ভাব ও ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কবিতাগুলো অক্সিজেনের মতোই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।
শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটি পঠনপাঠনে পাঠকের কাছে কখনো মনে হবে সাহিত্যস¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর প্যাটার্ন; আবার কখনো পাঠকের কাছে মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার নিষিক্ত রস! পুরো উপন্যাসটিই কাব্যিকরসে সিক্ত।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে কাব্যময়তা মোটেই দোষের নয়, বরং গুণ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বাংলা সাহিত্যের তিন সেরা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের লেখনিতে কাব্যময়তা মোটেও অস্বীকার করা যায় না। কাব্যময়তার বিশেষ প্রভাব পড়েছে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসে। কেউ কেউ তো আবার এই উপন্যাসকে মহাকাব্য বলেও স্বীকার করে নেন। বাংলাসাহিত্যের কিছু কালজয়ী উপন্যাসের মধ্যে নিঃসন্দেহে পথের পাঁচালী অন্যতম। কাব্যময়তা নিয়ে যদি এটি কালজয়ী হতে পারে তবে এটা বলা য়ায় কাব্যময়তা উপন্যাসের জন্য মোটেও অবাঞ্ছিত বা অপ্রয়োজনীয় কোনো বিষয় নয়। এটাও একধরনের অলংকরণ।
শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাস পঠনপাঠনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবি-সাহিত্যিক-লেখক এবং তাঁদের বইয়ের নামও উঠে এসেছে। যেমন : আলবেয়ার কাম্যু’র আউসাইডার, তামিল কবি ইউভি সামিনাথ আইয়ার এর পাথনামিত্তা, বালী’র আম্মা, আন্নামালয়ী রেড্ডিয়ার কাবাদিসিন্ধ, বেইরামুথুর ভারতী, আইনস্টাইনের থিউরি অব রিলিটিভিটি প্রভৃতি।
কোনো কোনো উপন্যাসই হয়ে ওঠে চরিত্রপ্রধান, কোনোটিবা ইতিহাসপ্রধান, আবার কোনটি হয় প্লট বা কাহিনি প্রধান, আবার কখনো কখনো সংলাপপ্রধানও হতে পারে। তবে যেকোনো উপন্যাসেই প্রধান চরিত্রগুলোর উপস্থিতিরি গড় সময় অন্যান্যের তুলনায় একটু বেশি থাকই বাঞ্ছনীয়। শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটিতে কুয়াশার চাদরে মোড়া একটুকরো সূর্যের আলোর মতোই একবারমাত্র সুহানার উপস্থিতি লক্ষ করা গেল। উপন্যাসটিতে অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে সুহানার প্রতি পাঠকহৃদয়ের সহানুভূতি জন্ম নেওয়ার আগেই চরিত্রটি হঠাৎ করেই যেনো উধাও হয়ে গেল। এই চরিত্রটির উপস্থিতির পরিমাণ বাড়ালে দ্বৈরথের টানাপোড়েনের নির্যাসে উপন্যাসও যেমন হতে পারত আরও ব্যঞ্জনাধর্মী তেমনই পাঠকহৃদয়ও বিগলিত হতো। আশা-আকাক্সক্ষার চাদর মুড়িয়ে, হৃদয়কে আবেগের ভেলায় ভাসিয়ে পাঠকহৃদয় তখন অবলীলায় পাড়ি দিত কাহিনির শেষপ্রান্তে। এমনকী তখন উপন্যাসটিও পেত ভিন্নধর্মী মাত্রা।
মানিক, তারাশঙ্কর এবং বিভূতিভূষণÑএই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁদের সৃষ্টিশীল লেখনীর নৈপুণ্য দিয়ে। এঁদের লেখনীর বেইজও প্রায় এক। কাহিনিগুলোকে জীবন্ত করে তুলার জন্য অঞ্চলবিশেষের মানুষের সত্যিকার ভাষাটাই চরিত্রের মুখে সেঁটে দিতেন। ফলে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে তখন মনে হয় হাজার বছরের পরিচিত! ভাষাচয়নকেও মনে হয় আমাদের কিংবা আমাদের প্রতিবেশির। কাহিনির বুনন এবং ভাষার যথাযথ প্রয়োগে মোজাম্মেল হক নিয়োগী এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কোনো অংশেই কম নয়। বরং তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছেÑতাঁর উপন্যাসগুলো যেনো আরও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ, আরও বেশি জীবন্ত।
প্রত্যেক পাঠকই যখন পত্রিকা কেনে তখন সে পুরো পত্রিকা কখনোই পড়ে না। পড়ে তার ভালোলাগার অংশটি। সাহিত্যমোদী হলে সাহিত্য অংশ, ক্রীড়ামোদী হলে ক্রীড়া অংশ, সংস্কৃতি ঘেঁষা হলে চিত্রবিনোদন, রাজনীতিবিদ হলে রাজনৈতিক সংবাদের পাতা প্রভৃতি। অর্থাৎ পাঠকের রুচিভেদে পত্রিকার পাতাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। ঠিক তেমনই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও কেউবা কাহিনির ঘনঘটায় মুগ্ধ হয়, আবার কেউবা খুঁজে ফেরে দার্শনিক পদবাচ্য তথা বুলেট বাক্য, আবার কেউবা খুঁজে ফেরে সমন্বিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের রসদ, আবার কেউবা খুঁজে ফেরে যৌনঘেঁষা বিনোদন। কাজেই এ ক্ষেত্রেও বলা যায় পাঠকভেদেও উপন্যাসের নির্যাস আস্বাদনেরও ভিন্নতা রয়েছে। তবে বুলেটবাক্য যেকোনো উপন্যাসেই পাঠককে কিছুটা হলেও ছুঁয়ে যায়। কিছু বুলেট বাক্য শেষ কথাটি যাও বলে উপন্যাসটিতে সত্যিকার অর্থেই সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা।
প্রকরণ যদি উপন্যাস বিচারের মাপকাঠি হয় তবে নিঃসন্দেহে ত্রয়ী উপন্যাসটি প্রশংসার দাবি রাখে। মোজাম্মেল হক নিয়োগী তাঁর উপন্যাসে গদ্য এবং পদ্যের মিশেলে নতুন রসায়নের সৃষ্টি করেছেন। এবং বিষয়বস্তুর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনায় উপন্যাসের প্যাটার্নকে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ করেছেন। শৈল্পিক ছোঁয়ার কথা না-হয় নাই বা বললাম! ভাষার সরলীকরণের কারণেও তিনি পাঠক হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছুবেন বলে আমার বিশ্বাস।
জলের লিখন: রোমান্টিকতা ও দেশেপ্রেমের পূর্ণ ক্যানভাস
মোজাম্মেল হক নিয়োগী বাংলা কথাসাহিত্যের এক আলোচিত নাম। নিয়োগীর জলের লিখন উপন্যাসটি তাঁর তেরোতম রচনা। সমাজের প্রান্তজনদের নিয়েই তার রচনার মূল আকর্ষণ। উপন্যাসে দর্পণের মতো ফুটে উঠেছে এনজিও’র ভেতর ও বাহিরের নিটোল ক্যানভাস। প্রকৃত অর্থে লেখকের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতারই ছায়াপাত ঘটেছে এ উপন্যাসে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের মতোই ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাস শুরু করেছেন বর্ষা ঋতু দিয়ে। উপন্যাসটি উত্তম পক্ষে বর্ণিত। পাহাড়ি রাস্তার মতো এ উপন্যাসে রয়েছে ঘটনার বাক্প্রবাহ। সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই রয়েছে সুসামঞ্জস্যতা। কেন্দ্রীয়চরিত্র মারিয়াকে কেন্দ্র করে মূলত এ উপন্যাসের ক্রম সাজানো হয়েছে। ফুলের মতোই শ্বেতশুভ্র মারিয়া। কিন্তু সামাজিক পরিচয়ের দলিলদস্তাবেজে সে একজন যুদ্ধকন্যা। একাত্তরে যার মা অপশক্তি দ্বারা ধর্ষিত হয়। পরবর্তীকালে বিদেশের স্বেচ্ছাসেবী আশ্রয়ে মানুষ হয় এবং নামকরণ হয় মারিয়া।
পূর্ণ সাবালিকা হওয়ার পর তার মনের ভিতর গুমরে ওঠে আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশে এসে সে গ্রামীণ সমাজজীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে সারা বাংলা চষে বেড়ায়। বাংলা একবারেই বলতে পারে না। ফলে বাংলাদেশে তার গাইড হিসেবে নিয়োগ পায় উপন্যাসের নায়ক আতিক। মারিয়ার আরেক সহচরী পারভিন মারিয়ার মতোই ট্র্যাজেডির শিকার। পিতৃপরিচয়হীন গর্ভের সন্তানটি তার এক আত্মীয়ের কাছে বড়ো হয়। মূলত এই দুই নারীর চাপা কান্নাই নায়কের মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সমস্ত উপন্যাস জুড়ে এই তিন চরিত্রের হৃদয়রহস্য ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠেছে।
চরিত্রচিত্রণে ঔপন্যাসিক যেনো এক দক্ষ কারিগর। ঔপন্যাসিকের লেখনির সূ² আঁচরে পার্শ¦চরিত্র নাফিজা, তুহিন, আসমা, রুস্তম, হাসু খালা, রূমালি, কবির, জিম, অ্যাঙ্গেলা, বিগগ্রেট, ব্রিজিড, মাইক, এরিক প্রমুখ প্রাণ পেয়েছে। পাশাপাশি প্রধান চরিত্রের সঙ্গেও এসব চরিত্রের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজেস ও সুসামঞ্জস্যতা। মূলত এসব চরিত্রের কারণেই প্রধান চরিত্রত্রয় ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
ভাষার সরলীকরণ অত্যন্ত চমৎকার। চরিত্র অনুযায়ী সংলাপের বুনন সত্যিই যথার্থ। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পঠনপাঠনে পাঠক ঘটনার পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত¡ এবং তথ্যও খুঁজে বেড়ায়; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় কাব্যময়তা, অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সুঘ্রাণ আর মোজাম্মেল হক নিয়োগীর উপন্যাসে পাওয়া যায় কঠিন বাস্তবতার সুঘ্রাণ! অবশ্য একই সঙ্গে কাব্যময়তা এবং দার্শনিক তত্ত¡ও কম নয়।
পৃথিবীর সব দেশেই শাসন ও শোষণের চিত্র রয়েছে। এটা প্রাচীনকালেও যেমন ছিল বর্তমানকালেও রয়েছে; কেবল ধরন একটু বদলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরে এদেশে বেসরকারি সংস্থাগুলো জনকল্যাণের নাম করে খুব কৌশলীভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সাধারণের কাছ থেকে শোষণ করে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। রাতারাতি কেউ কেউ আঙুল ফুলেও কলাগাছ বনে যাচ্ছে। নি¤œবিত্তদের ব্যবহার করে বিদেশি দাতব্যসংগুলোর কাছ থেকে এনজিও মালিকরা লুফে নিচ্ছে বড়ো অংকের টাকা। নিঃসন্দেহে ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়েছে এ উপন্যাসটিতে। কেননা, ব্যক্তিজীবনে এ সংস্থার সঙ্গে বিস্তর পরিচয় থাকার কারণেই তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। এককথায় এনজিও তথা বেসরকারি সংস্থাগুলোর চরিত্র একেবারে উলঙ্গ করে ছেড়েছেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রের চেতনা। প্রকারান্তরে এটি স্বদেশচেতনা, মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনা। সবগুলো চরিত্রকেই খুব আপন মনে হয়। মনে হয় যেনো হাজার বছরের পরিচিত। জলের লিখন মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আশ্রিত দেশেপ্রেমের নিটোল মাহাত্ম্যগাথা।
উপন্যাসের নায়ক আতিক; যে প্রতিমুহূর্তেই নিজেকে নিজের সততা, আত্মবিশ্বাস ও প্রচেষ্টার সৎগুণে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। উপন্যাসটিতে কখনো আতিককে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, সাহিত্যপ্রেমী আর রোমান্টিক মনে হয়। আবার কখনো মনে হয় দার্শনিকের মতোই উদাসীন। প্রকৃত অর্থে এ উপন্যাসে নায়কের উদাসীনতার পরিবর্তে নিষ্কাম ও গাঢ় প্রেমের চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে। ব্যক্তিত্বের আলোকধারায় সমুজ্জ্বল নায়ক আতিক; যে প্রেমের জন্য নায়িকা মারিয়ার সাড়ার অপেক্ষায় থাকে দিনের পর দিন। নিজের ভেতর ক্ষরণ ঘটেছে তবুও স্থিরসিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল।
অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আতিকের যেনো নিত্যসঙ্গী। তবু আতিক হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। আত্মবিশ্বাসের জোরেই তিনি অভাবকে জয় করেছেন, জয় করেছেন দারিদ্র্যকে এমনকি সফলও হয়েছেন প্রেমে। আত্মবিশাসই তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। জীবন জয়ের প্রেরণা জোগায়। দীর্ঘ সময় কাছে পেয়েও নায়িকার সঙ্গে তার নৈতিক স্খলন ঘটেনি।
ঔপন্যাসিকের লেখনীগুণে কোনো কোনো চরিত্র স্থান-কাল-পাত্র ছাপিয়ে কখনো হয়ে উঠে সার্বজনীন। কখনো হয়ে ওঠে আইডল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস উপন্যাসের কেন্দ্রীয়চরিত্র দেবদাস আজ বাঙালিপাঠকের মুখে মুখে। শুধু তাই নয়, দেবদাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য। মোদ্দাকথা কেন্দ্রীয়চরিত্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠলে খুব দ্রæত তা সর্বমহলে প্রচার ও প্রসার লাভ করে। জলের লিখন উপন্যাসের নায়ক আতিক দেবদাসের মতো না হলেও ব্যক্তিত্বগুণে কোনো অংশেই তাকে পেছনে ফেলা যাবে না। একটু প্রচার-প্রসার পেলে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয়চরিত্রও সার্বজনীন আইডল হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
সাহিত্যিকের সুললিত কাহিনি বর্ণনা পাঠককে চিত্রকল্পের মতোই টেনে নিয়ে যাবে। পাঠক আবেগমথিত হবে। রোমান্সে শিহরিত হবে। কথাসাহিত্যিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয়চরিত্রদ্বয়কে এমন আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলেছেন যে, পাঠক আতিক ও মারিয়ার রোমান্টিকতার পথ ধরে হেঁটে চলবে অবলীলায়। কথা ও ভাবের সরসতায় বিমোহিত হবে। তবে জলের লিখন উপন্যাস কখনো সখনো পাঠকমনকে ক্ষতবিক্ষত করে। কখনো বা রোমান্টিকতার ভেলায় চরিয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তরে। দেশপ্রেমের নিটোল চিত্র মেলে নায়কের বর্ণনায় :
যুদ্ধের সময় তো অনেক শিশুরই জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। মারিয়া হয়তো তাদেরই একজন। চাঁদের আলোয় আমি তাকে আপাদমস্তক দেখলাম। মনে হলো আমার সামনে শুয়ে আছে শ্যামলসুন্দর এক বাংলাদেশ। আমি মারিয়ার মধ্যে দেখতে পাই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে সুরমা-বিস্তৃত এক সমতল ভূমিতে উৎর্কীর্ণ হয়ে আছে হাজারো নদী অরণ্যের ¯িœগ্ধ শ্যামল ছায়াময় বাংলার শ্বাশত রূপ মাধুর্য।
যুদ্ধকন্যা বা যুদ্ধশিশুর সামাজিক প্রেক্ষাপট, চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সুনিপুন উপস্থাপনে উপন্যাসটিতে সংযোজিত হয়েছে ভিন্নমাত্রা। কাহিনির পরম্পরা রক্ষায় ঔপন্যাসিক খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ঘটনার সন্নিবেশে সময়ের ঐক্য ও পরম্পরা রক্ষায় ঔপন্যাসিকের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। দীনেশচন্দ্র সেন জীবনানন্দের কবিতা পড়ে বলেছিলেন—কবি, আমি তোমার কবিতা পড়ে কেঁদেছি। জলের লিখন উপন্যাস পঠনপাঠনেও পাঠকের হৃদয় কখনো ভারাক্রান্ত হবে, কখনো চোখ হবে অশ্রæসিক্ত! একজন সার্থক ঔপন্যাসিক ঠিক ওই জায়গাতেই সফল। সমালোচক আবুবকর সিদ্দিক যথার্থই বলেছেন। তাঁর ভাষায়:
জলের লিখন উপন্যাসটি লেখকের আগের বারোটি উপন্যাস থেকে শিল্পগুণে অনেক সমৃদ্ধ। তিনি কোথাও পাঠককে জোলো তৃপ্তি দেবার লোভে সস্তা ও কাঁচা বর্ণনার ফাঁদে পা দেননি। তাঁর সংযমবোধ ও নিরাসক্ত বর্ণনার কুশলী নির্যাসে বইটি অসাধারণ রচনা হয়ে উঠতে পেরেছে। এ বইয়ের নাম ‘জলের লিখন’ না হয়ে ‘কালের লিখন’ও হতে পারত। আমি অন্তত নিঃসন্দেহ, এটি একটি কালোত্তীর্ণ উপন্যাস।
কথার বুনন, ঘটনার পরম্পরা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সময়ের ঐক্য, ইতিহাসের যথোপযুক্ত সন্নিবেশ, বাস্তবতার নির্যাস, কাব্যময়তা, দার্শনিক পদবাচ্যের যথার্থ প্রয়োগ, ঘটনার বাস্তবতা, স্থানের ঐক্য, পটভূমির সুনিপুণ উপস্থাপনসহ যে দিক থেকেই তাঁর উপন্যাসকে বিশ্লেষণ করা হোক না কেন—সব দিক থেকেই তাঁর উপন্যাস নন্দিত; কাজেই তাঁর এই অর্জনকে বাংলা কথাসাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে মাইলফলকস্বরূপ বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।
বিশ্ববিখ্যাত গল্পকার অ্যাডগার এলান পো তাঁর গল্পগুলোতে নতুননত্ব হিসেবে নিয়ে আসেন অতিভৌতিক বা অতিরহস্যজনক থিম। অবশ্য তাঁর গল্পের প্যাটার্নই তাঁর নিজের মতো করে সাজানো। বাংলা কথাসাহিত্যের নির্লিপ্ত স¤্রাট মোজাম্মেল হক নিয়োগী’র উপন্যাসের গাঁথুনিতেও দেখা যায়Ñসমাজের অতিবাস্তব চিত্রের সন্নিবেশ। তাঁর উপন্যাসগুলোর পটভূমি বা কাহিনির ঘনঘটার দিকে চোখ বুলালে দর্পণের মতো পাঠকের চোখে ভেসে ওঠে সমাজের ঘটমান প্রতিচ্ছবি। যে ছবিগুলোর ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উপহাস। কথাসাহিত্যিক মূলত সমাজের ছবিই নিখুঁতভাবে আঁকতে চেয়েছেন তাঁর উপন্যাসে। নিজের মতো করেই সাজিয়েছেন তাঁর গল্পের বীজতলা। উপন্যাসের প্লট, ভাব-ভাষা, কথার গাঁথুনি, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সময়ের ঐক্য, ঘটনার পরম্পরা থেকে শুরু করে ঘটনার ঘনঘটায় রস সৃষ্টি তথা আবেগ সৃষ্টি ও কাহিনি গভীর থেকে গভীরতর করে তুলতে কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর জুড়ি মেলা ভার।
একজন কথাসাহিত্যিক যত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন ততই নির্ভুল হতে থাকে তাঁর শিল্পকর্র্ম। মোজাম্মেল হক নিয়োগীর শৈল্পিক কাজগুলো দেখলেই উপলব্ধি করা যায় তিনি কী পরিমাণ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। সাহিত্যসাধনায় এমন দরদমাখা কাজ খুব একটা চোখে পড়ে না বললেই চলে। আর এ কারণে এটা বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না যে, তাঁর নিষ্ঠাবান সাহিত্যকর্ম ত্রয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
