কালীপ্রসন্ন সিংহ : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ একটি উজ্জ্বল ও বৈচিত্র্যময় নাম। মাত্র ৩০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যেভাবে সাহিত্য, নাট্যচর্চা, সমাজসেবা ও সংস্কৃতিচর্চায় অবদান রেখেছেন, তা বাংলা রেনেসাঁর এক অনন্য নজির। তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বাংলা গদ্যে মহাভারতের অনুবাদ এবং তৎকালীন কলকাতার সামাজিক চিত্র তুলে ধরা হুতোম প্যাঁচার নকশা।
🔸 জন্ম ও পরিবার:
কালীপ্রসন্ন সিংহ জন্মগ্রহণ করেন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে, কলকাতার জোড়াসাঁকোর একটি সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন নন্দলাল সিংহ এবং মাতা ত্রৈলোক্যমোহিনী দেবী। তিনি ছিলেন সিংহ পরিবারের কৃতি সন্তান, যাদের পূর্বপুরুষ শান্তিরাম সিংহ ছিলেন বিখ্যাত ধনী ও সমাজসেবী।
🔸 শিক্ষাজীবন:
তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি কলেজ) অধ্যয়ন করেন। যদিও কলেজ ত্যাগ করেন ১৮৫৭ সালে, ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত চর্চা বাড়িতে অব্যাহত রাখেন। মিস্টার ক্রিকপ্যাট্রিকের কাছে ইংরেজি ভাষার দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও সাহিত্যে আগ্রহ শৈশবেই লক্ষণীয় ছিল।
🔸 সাহিত্যকর্ম:
কালীপ্রসন্ন সিংহের সাহিত্যকর্ম মূলত দুটি স্তম্ভে প্রতিষ্ঠিত:
1️⃣ হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬২): এটি ছিল একটি ব্যঙ্গাত্মক গ্রন্থ যেখানে তিনি সমকালীন কলকাতার বাবু সমাজ ও সামাজিক চালচলন কৌতুকরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। এটি বাংলার প্রথম কথ্য ভাষায় রচিত রসগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
2️⃣ মহাভারতের অনুবাদ (১৮৫৮–৬৬): বাংলা গদ্যে মহাভারতের পূর্ণ অনুবাদ তাঁরই সম্পাদনায় সম্পন্ন হয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি নিজের সম্পত্তি ব্যয় করে ১০ হাজারের বেশি অনুলিপি বিতরণ করেন।
🔸 নাট্য ও সংস্কৃতিচর্চা:
তিনি ১৮৫৫ সালে বিদ্যোৎসাহিনী সভা গঠন করেন এবং বাংলা থিয়েটারে অভিনয় ও নাট্য রচনা করেন। নাটক যেমন:
- “বিক্রমোর্বশী” (১৮৫৭),
- “সাবিত্রী-সত্যবান” (১৮৫৮),
- “মালতী-মাধব” (১৮৫৯)।
তিনি নিজেই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলা কবিতায় ফাঁকা ছন্দ প্রবর্তনের জন্য পুরস্কৃত করেন।
🔸 সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে অবদান:
তিনি সম্পাদক ছিলেন:
- বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা
- পরিদর্শক
- সারবত্ত্বা
- বিভিধার্থ সংগ্রহ
তৎকালীন প্রভাবশালী পত্রিকা হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এর দায়িত্বভার নেন এবং বিপুল অর্থ ব্যয় করে সেটিকে টিকিয়ে রাখেন।
🔸 সামাজিক দান ও সংস্কার:
- বিধবা বিবাহের প্রবক্তা ও সহায়ক হিসেবে অসংখ্য দান করেন।
- বিধবা পুনর্বিবাহে উৎসাহিত করতে নগদ অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেন।
- রেভারেন্ড জেমস লংকে নীলদর্পণ অনুবাদে জরিমানা দেওয়ায় আর্থিক সহায়তা দেন।
🔸 জীবনের অন্তিম পর্ব ও মৃত্যু:
চরম দানশীলতার কারণে জীবনের শেষদিকে আর্থিক সংকটে পড়েন। অব্যবস্থাপনার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ২৪ জুলাই ১৮৭০ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।
🔸 উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি:
- হুতোম প্যাঁচার নকশা
- মহাভারত (অনুবাদ)
- বিক্রমোর্বশী
- বাবুনাটক
- সাবিত্রী-সত্যবান
- মালতী-মাধব
- বঙ্গেশ বিজয়
- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (প্রকাশিত: ১৯০২)
🔸 উপসংহার:
কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন বাংলা নবজাগরণের অন্যতম স্তম্ভ। সাহিত্যে তাঁর ব্যতিক্রমী অবদান, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অশেষ দানশীলতা তাঁকে বাংলার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। মাত্র তিন দশকের জীবনেও তাঁর কাজ বাঙালি সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
https://www.munshiacademy.com/কালীপ্রসন্ন-সিংহ-জীবন-ও-স/