কানা বগীর ছা

কানা বগীর ছা – খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন

ছড়া

কানা বগীর ছা

খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন

ধরন: কবিতা

 

ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাগের গাঁ,
ঐ খানেতে বাস করে
কানা বগীর ছা।

ও বগী তুই খাস কী?
পানতা ভাত চাস কি?
পানতা আমি খাই না
পুঁটি পাছ পাই না
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।

 

 

 

📜 কানা বগীর ছাখান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের কবিতা

 

কবিতার পরিচিতি:

কানা বগীর ছা খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন রচিত একটি প্রতীকী কবিতা, যা বাংলা সাহিত্যের একটি প্রখ্যাত ব্যঙ্গাত্মক কবিতা। কবিতাটি সমাজের অক্ষমতা, অপরিণত মনোভাব এবং স্বার্থপরতা নিয়ে কবির গভীর চিন্তা প্রকাশ করে। এখানে কবি কানা বগীর এবং তার ছানার মাধ্যমে সমাজের ধ্বংসাত্মক শক্তি এবং অক্ষমতাকে তুলে ধরেছেন।

 

 

💡 কবিতার বিশ্লেষণ:

1️ প্রতীকী অর্থ:

কবিতায় বগীর এবং তার ছানা (যাকে কানা বলা হয়েছে) সমাজের কিছু অক্ষম ক্ষতিকারক মানুষকে প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বগী হলো এমন একটি প্রাণী, যা নিজের শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, তবে তা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। তার কানা ছানা হলো এমন একটি অস্তিত্ব, যা কিছুই করতে পারবে না এবং সমাজের শক্তিহীনতা এবং অপরিণত অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে।

2️ ব্যঙ্গাত্মক ধাঁচ:

কবিতাটি একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা, যেখানে কবি সমাজের এমন কিছু মানুষকে উপস্থাপন করেছেন যারা অক্ষম, অবিশ্বাসী এবং নিজের স্বার্থে কাজ করে। তাদের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই, তারা শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষতি করার জন্য সমাজে উপস্থিত থাকে। কবি তাদের চিত্র তুলে ধরেছেন কানা এবং বগীর ছানা হিসেবে, যারা সমাজের অন্ধকারে নিজেদের অবস্থান স্থাপন করে।

 

3️ সমাজের পরিসর:

কবিতাটি সমাজের অক্ষমতাধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতি একটি চমৎকার সমালোচনা। এখানে কবি তাদের তুলে ধরেছেন যারা সমাজের জন্য কিছু করে না, শুধুমাত্র নিজেকে স্বার্থপরভাবে দেখে এবং অন্যদের ক্ষতি করে। কবি এটি চিত্রিত করেছেন যে, অক্ষমতা সমাজের জন্য কতটা বিপদজনক হতে পারে।

 

4️ ভাষা ছন্দ:

কবির ভাষা সরল হলেও গভীর অর্থপূর্ণ। কবি তার ব্যঙ্গাত্মক শব্দচয়ন এবং ছন্দ এর মাধ্যমে সমাজের অক্ষমতা ক্ষতি তুলে ধরেছেন। কবিতার ভাষা সহজ হলেও প্রতিটি শব্দে সমাজের অন্ধত্ব এবং অক্ষমতার প্রতি ব্যঙ্গ রয়েছে।

🎓 শিক্ষামূল্য:

  • এই কবিতাটি সমাজের অক্ষমতা এবং ধ্বংসাত্মক শক্তির বিরুদ্ধে একটি নৈতিক শিক্ষা দেয়। কবি আমাদের সচেতন করে দেন যে, অক্ষমতা সমাজে বিপদ সৃষ্টি করতে পারে এবং আমাদের সঠিক পথে চলা প্রয়োজন।
  • কবিতাটি সমাজে স্বার্থপরতাঅবিচার সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে।

 

📘 কানা বগীর ছা – ছন্দ বিশ্লেষণ

✍️ রচয়িতা: খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন


🎼 ছন্দ বিশ্লেষণ:

🪶 ছন্দের ধরন:

এই কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দ হলো মূলত মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। তবে ছন্দের গঠন ও ধ্বনির পুনরাবৃত্তি অনুসারে এটিকে ছোট ছড়া ছন্দ বা চতুষ্পদী ছড়া ছন্দ হিসেবেও শ্রেণিবদ্ধ করা যায়।

🧮 মাত্রা বিন্যাস:

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি পঙ্‌ক্তির নির্দিষ্ট মাত্রা সংখ্যা (ধ্বনিগুচ্ছ) অনুসরণ করে কবিতাটি গঠিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:

▶️ ঐ দেখা যায় তাল গাছ — ৮ মাত্রা
▶️ ঐ আমাগের গাঁ — ৬ মাত্রা
▶️ ঐ খানেতে বাস করে — ৮ মাত্রা
▶️ কানা বগীর ছা — ৬ মাত্রা

ছন্দটি মোটামুটি ৬–৮ মাত্রার গড় রেখে গঠিত।

🔹 ব্যাখ্যা:
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সমাহারে গঠিত প্রতিটি ধ্বনিগুচ্ছকে মাত্রা বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ —
“ঐ-দে-খা-যায়-তা-ল-গা-ছ” → ৮ মাত্রা

🔁 ধ্বনির পুনরাবৃত্তি ও অলংকার:

  • কবিতার প্রতিটি চরণে ধ্বনির একরৈখিক পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়, যা আবৃত্তিযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।
  • উপমা ও ধ্বনিগত অলংকার (“গাপুস গুপুস”) ব্যবহারে কবিতা শিশুমনে আকর্ষণ তৈরি করে।
  • আলঙ্কারিক ছন্দমাধুর্যসজীবতা এই কবিতাকে শুধু ছড়া নয়, ছন্দশাস্ত্র অনুযায়ী একটি সফল কাব্যিক রচনাতে রূপ দেয়।

 

🧠 বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যায়ন:

🔍 ১. ছন্দ ও ধ্বনি মিলে শিশুমন অনুরণিত:

এই কবিতাটি শিশুদের উপযোগী করে এমনভাবে ছন্দবদ্ধ করা হয়েছে, যাতে তা সহজেই মুখস্থযোগ্য, আবৃত্তিযোগ্য এবং শ্রুতিমধুর হয়। এর প্রতিটি পঙ্‌ক্তি শিশুর ধ্বনিবোধশ্রবণরুচি অনুশীলনে সহায়ক।

🔍 ২. ছোট পঙ্‌ক্তি ও গদ্যনিষ্ঠ স্বাচ্ছন্দ্য:

প্রতিটি চরণ সংক্ষিপ্ত এবং স্বাভাবিক কথাবার্তার মতো করে সাজানো হয়েছে। এটি কবিতাটিকে গদ্যছন্দের ঘনিষ্ঠ করে তোলে, কিন্তু মাত্রা ও তাল বজায় রেখে ছন্দসাধনা সম্পন্ন হয়েছে।

🔍 ৩. রূপকধর্মী উপস্থাপনা:

কবিতায় ‘কানা বগীর ছা’ বাস্তবের কোনো চরিত্র নয়—বরং এটি প্রতীকী উপস্থাপনা, যা সমাজ-সমালোচনা, দারিদ্র‍্য, বা অক্ষমতার ব্যঙ্গ হিসেবে পাঠ করা যায়। তার সঙ্গে ছন্দের খেলা শিশুসাহিত্যের রূপে একে উপস্থাপন করে।

📚 রেফারেন্স ও সাহিত্যতাত্ত্বিক দৃষ্টি:

  • ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ছন্দতত্ত্ব বিশ্লেষণে বলেন, “মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি ধ্বনির সময়মান নির্ণীত হয়, এবং ছন্দের গতি মাত্রার সুষম বিন্যাসে নির্ভরশীল” (সূত্র: বাংলা ভাষার ইতিহাস)।
  • মুনীর চৌধুরী শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে বলেন, “ছড়া যদি শিশুদের আনন্দ দেয়, তার ভাষা ও ছন্দ হতে হবে তাদের জন্য উপযোগী”

 

উপসংহার:

“কানা বগীর ছা” কবিতাটি একটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ছড়া, যা ভাষা, ধ্বনি ও চিন্তার সুষম সমন্বয়ে গঠিত। এর ছন্দশৈলী, অলংকার, এবং প্রতীকধর্মিতা — একে শিশুতোষ সাহিত্য ছাড়িয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতীকী রচনায় উন্নীত করেছে।

📌 এটি ছন্দের দিক থেকে যেমন সুনির্মিত, তেমনি ব্যাখ্যাযোগ্য—যা শিশুপাঠ ও সমালোচনার জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

 

 

লিংক: https://www.munshiacademy.com/কানা-বগীর-ছা-খান-মুহম্মদ/

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *