কম্পিউটার ও আজকের বিশ্ব

Spread the love

কম্পিউটার ও আজকের বিশ্ব

“The computer was born to solve problems that did not exist before.”
— Bill Gates

ভূমিকা

একবিংশ শতাব্দীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কম্পিউটার। এটি শুধু একটি যন্ত্র নয়, বরং একটি বিপ্লবের নাম, যা মানুষের চিন্তাধারা, কাজের ধারা, যোগাযোগ এবং জীবনযাত্রার প্রতিটি দিক পরিবর্তন করে দিয়েছে। “কম্পিউটার” শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময়কর এক জগৎ। আজকের বিশ্বে কম্পিউটার কেবল বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল-কলেজ, অফিস, চিকিৎসা, ব্যবসা, গণমাধ্যম এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও।


কম্পিউটারের সংজ্ঞা ও ধারণা

কম্পিউটার শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘computare’ থেকে, যার অর্থ গণনা করা। আধুনিক সংজ্ঞায়, কম্পিউটার হল একধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা ইনপুট গ্রহণ করে, প্রসেস করে, এবং আউটপুট প্রদান করে। এটি একটি প্রোগ্রাম অনুসরণ করে কাজ করে, এবং তাতে থাকা মেমোরি ও প্রসেসরের সাহায্যে তীব্র গতিতে জটিল হিসাবও করতে পারে।


কম্পিউটারের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

১. প্রাচীন গণনাযন্ত্র:

  • আবাকাস (Abacus): চীন ও মিশরে ব্যবহৃত হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে।
  • ন্যাপিয়ার্স বোনস (Napier’s Bones)স্লাইড রুল: গণনার জন্য ব্যবহৃত হয়।

২. আধুনিক কম্পিউটারের সূচনা:

  • চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage): তাঁকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়। ১৮৩৭ সালে তিনি “অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন” এর ধারণা দেন।
  • অ্যাডা লাভলেস: বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে পরিচিত।

৩. ইলেকট্রনিক যুগ:

  • ENIAC (1946): বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক জেনারেল-পারপাস কম্পিউটার।
  • এরপর আসলো Transistor, Integrated Circuit (IC), Microprocessor — যার মাধ্যমে শুরু হয় পার্সোনাল কম্পিউটারের যুগ।

কম্পিউটারের ব্যবহার ও প্রভাব

১. শিক্ষা ক্ষেত্রে:

  • ভার্চুয়াল ক্লাস, ডিজিটাল কনটেন্ট, অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
  • উদাহরণ: Coursera, Khan Academy, YouTube Edu, Zoom ক্লাস।

২. চিকিৎসাক্ষেত্রে:

  • রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, অপারেশন সিমুলেশন, টেলিমেডিসিন, AI-চালিত ডায়াগনসিস ব্যবস্থায় কম্পিউটার অপরিহার্য।
  • MRI, CT Scan, ECG, AI Diagnostics (ChatGPT in MedAI) – সবই কম্পিউটারনির্ভর।

৩. ব্যবসা ও বাণিজ্যে:

  • অনলাইন মার্কেটিং, আর্থিক হিসাব, গ্রাহক ডেটাবেস, ERP, ও স্টক ম্যানেজমেন্টে কম্পিউটার ব্যবহার হয়।
  • উদাহরণ: Amazon, SAP, Tally, Excel।

৪. যোগাযোগে বিপ্লব:

  • ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (Facebook, WhatsApp), ভিডিও কনফারেন্সিং (Zoom, Google Meet) – সবই কম্পিউটারের উপহার।
  • “One World, One Click” – ধারণার বাস্তব রূপ।

৫. বিনোদন জগতে:

  • সিনেমা এডিটিং, অ্যানিমেশন, গেম, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, AI-generated art — সব কিছুই কম্পিউটারের জাদু।
  • NetFlix, Spotify, Adobe Premiere Pro প্রভৃতি।

৬. গবেষণা ও আবিষ্কারে:

  • জেনোম সিকোয়েন্সিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কসমোলজি গবেষণায় কম্পিউটার ছাড়া চিন্তাই করা যায় না।
  • CERN, NASA, ISRO, BCSIR সব জায়গাতেই সুপারকম্পিউটার ব্যবহার হচ্ছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং

বর্তমানে কম্পিউটারের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। AI এমন এক প্রযুক্তি যা মানুষের মতো চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমন:

  • AI চ্যাটবট (ChatGPT)
  • Voice Assistant (Siri, Alexa)
  • Recommendation Engine (YouTube, Amazon)

মেশিন লার্নিং ও ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে কম্পিউটার এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিখতে ও উন্নত হতে পারে।


কম্পিউটার এবং চাকরি বাজার

কম্পিউটারের প্রভাবে যেমন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে (প্রোগ্রামার, ডেটা অ্যানালিস্ট, সাইবার এক্সপার্ট), তেমনি কিছু পেশা ঝুঁকিতে পড়েছে (যেমন টাইপিস্ট, ক্যাশিয়ার)।

তবে World Economic Forum এর মতে, “AI will displace 85 million jobs by 2025, but also create 97 million new roles.”


সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

কম্পিউটার সামাজিক যোগাযোগে গতির সঞ্চার করেছে, কিন্তু একইসাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে:

  • পরিবারে সময়ের অভাব
  • গোপনীয়তা হুমকির মুখে
  • আসক্তি সমস্যা

তবে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও বিশ্বায়নে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এখন আমরা গুগলেই পেতে পারি ভিন্ন ভাষার সাহিত্য, গান, ইতিহাস।


কম্পিউটার ও বাংলাদেশের অগ্রগতি

বাংলাদেশও কম্পিউটার প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে:

  • ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন ২০২১ সফল হয়েছে।
  • শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিচার — সবক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
  • বর্তমানে জাতীয় তথ্য বাতায়ন, এগভ সার্ভিস, BIWTA ই-পেমেন্ট, উদ্ভাবনী কর্মসূচি ইত্যাদিতে এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

কম্পিউটার এবং ভবিষ্যৎ

১. কোয়ান্টাম কম্পিউটিং:

বর্তমান কম্পিউটার যে কাজ এক বছরে করে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই কাজ এক ঘণ্টায় করবে। Google ইতিমধ্যে Sycamore নামক কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে।

২. স্বয়ংচালিত যানবাহন:

Tesla, Waymo সহ বহু প্রতিষ্ঠান AI চালিত গাড়ি বানাচ্ছে। এই সবই কম্পিউটার প্রযুক্তির ফসল।

৩. স্মার্ট হোম এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT):

ঘরের প্রতিটি যন্ত্র কম্পিউটারনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠছে – AC, রেফ্রিজারেটর, লাইটিং সিস্টেম সব।


চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা

১. সাইবার নিরাপত্তা:

হ্যাকার, ম্যালওয়্যার, ডেটা চুরি, ফিশিং – ইন্টারনেট নির্ভর এই যুগে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

২. নৈতিক সংকট:

Deepfake ভিডিও, গোপনীয়তা লঙ্ঘন, তথ্য বিকৃতি ইত্যাদি কম্পিউটার প্রযুক্তির অপব্যবহার।

৩. ডিজিটাল ডিভাইড:

গ্রাম ও শহরের মাঝে প্রযুক্তিগত বৈষম্য এখনো বিদ্যমান, যা সামাজিক অসাম্য বাড়ায়।


সমাধান ও দৃষ্টিভঙ্গি

  • Digital Literacy বাড়াতে হবে প্রতিটি স্তরে
  • নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, নৈতিক শিক্ষা এবং গোপনীয়তা সংরক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি
  • প্রযুক্তিকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়

উপসংহার

আজকের পৃথিবীকে “কম্পিউটারনির্ভর বিশ্ব” বলা যথার্থ। একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় কম্পিউটার শুধুমাত্র যন্ত্র নয়, এটি হয়ে উঠেছে মানবজাতির মস্তিষ্কের এক এক্সটেনশন। আমরা যদি সঠিকভাবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি, তবে কম্পিউটার প্রযুক্তি মানবজাতিকে আরো উন্নত, উদ্ভাবনী ও সমৃদ্ধ সমাজের দিকে নিয়ে যাবে।

“Computers are magnificent tools for the realization of our dreams, but no machine can replace the human spark of spirit.”
— Louis Gerstner


কম্পিউটার ও আজকের বিশ্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *