কথাকলি প্রেম এবং
তাহমিনা খান
(কাব্যালোচনা)
২০২৩ সালে এবং মানুষ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাহমিনা খান-এর কথাকলি প্রেম এবং নামক কাব্যটি। এতে মোট কবিতা রয়েছে ৫৩টি। সাত ফর্মার এই কাব্যটিতে রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। সত্যিকার অর্থেই তাহমিনা খান স্বভাবজাত কবি। আর স্বভাবজাত কবিদের কাব্যভাষা মূলত সাধারণ মানুষের হদৃয়েরই ভাষা।
কবিতাকে বলা হয়ে থাকে অনুভূতির দর্পণ। বোধ এবং উপলব্ধির নির্যাস কবিতার শব্দে শব্দে পোথিত হয়।
“নদীকে হাসতে দেখেছো কখনও
আমি দেখেছি
উৎসের কাছাকাছি পাথরের বুকে
চলতে চলতে সে কী উদ্দামতা তার…”
কবিকে বুঝতে হয় কবিতা দিয়ে।
তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য ঠিক তাঁর মতোই স্বতন্ত্র। কাব্য বিশ্লেষণে কয়েকটি দিক ফুটে ওঠেছে। যেমন—সুফিবাদ, সমকালীন বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যতা, স্বদেশপ্রেম, স্মৃতিকাতরতা, নিবেদিত অন্বয়, প্রকৃতিপাঠ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, মানবিকতা, ধর্মতত্ত¡, বোধ, বৈশ্বিক জটিলতাসহ দর্শনের নানা দিক।
কবি মোখলেসুর রহমানের কবিতাগুলোর আবেদন চিরায়ত; অনেকটা বৈষ্ণব কবিতার মতো। তাঁর কবিতা নদীর মতোই বহমান। অবশ্য প্রকৃত কবি কোনো দশকে সীমাবদ্ধ নন, তিনি চিরকালের। তাকে সময়ের ফ্রেমে ফেলে ভাগ করা যায় না। কবিতায় নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, স্বর দাঁড় করাতে না পারলে কোনো কবি তাঁর চেনা সময়কে অতিক্রম করতে পারেন না।
দেশমাতা সে তো এক আবেগেরই নাম; চেতনারই নাম। এককথায় কবিসত্তার অস্তিত্বেরই দ্যোতক। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে বলেই কবি অবলীলায় ইতিহাসের নতুন পৃষ্ঠায় লিখে যান কীর্তিমান, আলো ও আশাজাগানিয়া পূর্বপুরুষ আর তাদের স্বপ্ন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামী সময়ের কথা। লিখে যান সৃষ্টিতত্তে¡র গূঢ়ার্থ। বনসাই গাছের মতো শব্দের মোড়কে এঁকে চলেন সুফিজমের নানা ক্যানভাস। কবি নিজেও হাঁটেন সে পথ ধরে। নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের কালের একজন অগ্রসর মানুষ।
কবি মোখলেসুর রহমান একজন সফল শিক্ষক এবং লেখক। এ পরিচয়ের বাইরে রয়েছে তাঁর বাহারি সৃষ্টিশীল সত্তা। চিন্তার ক্যানভাসে সতত জাগ্রত থাকে তাঁর সৃষ্টিশীল হৃদয়। প্রতিটি কবিতায় তিনি এমনই একটা নিজস্ব বয়ান তৈরি করেছেন যা একই সঙ্গে পাঠকেরও বয়ান হয়ে ওঠেছে। কবিতার বোধ, চিন্তার পারঙ্গমতা আর এইসব বয়ান ধরেই নির্মাণ আর বিনির্মাণ চলে কবি মোখলেসুর রহমানের কবিতার প্রান্তর। এজন্য কাব্যতীর্থে তাঁর স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ। ভাবাবেগ আর চিত্রকল্পের ভুবনে তিনি সত্যিই অন্যরকম—
এ যুগের অনেক কবিই নিজের কবিতাকে স্বতন্ত্রধারায় নিয়ে এলেও শব্দের কাঠিন্য থেকে মুক্তি দিতে পারেননি। আমরা জানি যে, যিনি বা যাঁরা কবিতাকে জড় ধর্ম থেকে মুক্তি দিয়ে সজীব করে তোলেন তিনি বা তাঁরাই হলো সেরা। ভাষার সরলীকরণ দিয়ে, সৃষ্টিশীলতার নৈপুণ্য উন্মোচিত করে, শব্দের দুর্বোধ্যতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে শব্দ-ব্যঞ্জনায় কবি কবি মোখলেসুর রহমান যে পরিমিতি বোধ দেখালেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
শব্দই হলো অমোঘ অস্ত্র, শব্দকেই বলা হয় শব্দব্রহ্ম বা ব্রহ্মাস্ত্র! আর এই শব্দ দিয়ে কবি একের পর এক অঙ্কন করেছেন বোধের মহাবিশ^। সমকালীন বাস্তবতা, জীবনের জটিলতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গ্রন্থি মোচন, চিন্তাচেতনার ঋদ্ধতা এমনকি শুদ্ধতার স্বর অনুক্রমিকভাবেই তাঁর কাব্যশরীরের লেপটে রয়েছে।
তিনি আলোর কবি, মানবিকতার কবি। তাঁর পুরো কাব্যেই বিশ^জনীন আদর্শের ¯্রােত এবং সুফিদর্শনের আলো গভীরভাবে প্রবহমান। বলা হয়ে থাকে চিত্রকল্পই কবিতার প্রাণ। আর এদিক বিবেচনায় কবি মোখলেসুর রহমানের ‘অনিবার্য সৌন্দর্যের নোটিশ’ কাব্যটি সত্যিই কৃতিত্বের দাবিদার।
কবিতায় ভাষা চয়নের ক্ষেত্রেও তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে। বিশেষ করে ভাষার সরলীকরণ এই কাব্যের মাহাত্ম্যকে অনেকটাই বেগবান করেছে। যথাসম্ভব সরল বাক্যের পথ ধরেই তিনি হেঁটেছেন। এদিক বিবেচনায় নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসার দাবিদার। এই কাব্যের প্রকৃত রসদ পেতে হলে পাঠককে অবশ্যই মূলবই ধরেই এগোতে হবে। কবিতার চিত্রকল্পের বুনো বাগান ধরেই হাঁটতে হবে।
কবি মোখলেসুর রহমান-এর ‘অনিবার্য সৌন্দর্যের নোটিশ’ কাব্যটির সবগুলো কবিতাতেই পাঠক অমিয় রসে সিক্ত হবে, ভাবাবেগে আহ্লাদিত হবে। এককথায়, কবিতাগুলো পাঠকমনে নিঃসন্দেহে চিন্তার উদ্রেক ঘটাবে বলেই আমার বিশ^াস।
প্রমথ চৌধুরীর তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ গ্রন্থে ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে বলেন- “যিনি গড়তে জানেন তিনি শিবও গড়তে পারেন বাদরও গড়তে পারেন (প্রমথ চৌধুরী, ২০০৮ : ৭৮)।” কবি সরকার আমিনের ক্ষেত্রেও যেনো উক্তিটি প্রযোজ্য। তিনি অত্যন্ত দক্ষ শব্দশ্রমিক। শব্দে শব্দে সম্পর্ক পাতানোতে তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত। নির্মাণের নিপুণতায় তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে চিরায়ত, বর্ণিল, গন্ধবহ ।
কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে উপমার প্রয়োগ করেছেন। সমগ্র পঠনপাঠনে মনে হবে উপমাই হচ্ছে কবিতা। সত্যিই তাই। উপমাই হচ্ছে কবিতার প্রাণ। কবি সরকার আমিনের কাব্যেও দেখি উপমার নিখুঁত ব্যবহার।
ব্যক্তিগত অনুভূতি সামগ্রিক অনুভূতিতে পরিণত করার মধ্যেই কবি বা লেখকের স্বার্থকতা। কবিতার বিষয়বস্তু আঙিনার দোরগোড়ায় হলেও তাতে রূপ-রস-ছন্দ-অলংকারে শৈল্পিক করে বিশ্বমানের করা যায়। কবিতা যদি নিজের চৌকাঠ না পেরোয়, তার শরীরে যদি বৈশ্বিক বাতাস না লাগে তবে তা বহুল প্রচার-প্রসার হলেও মহাকালের মানের বিচারে তা টিকে না। কবি সরকার আমিন বিবাহিত প্রেমের কবিতা কাব্যটিকে বৈশ্বিক উষ্ণতাদানে কিংবা অনুভূতিসমগ্রকে সার্বজনীন রূপদানে নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। তাঁর শব্দচয়ন, উপমা, অলংকার পাঠককে আমোদিত, আহলাদিত করবে নিঃসন্দেহে।
তার সাহিত্য বর্ণময়, ভাব প্রসঙ্গে সমৃদ্ধ, অভিনব রেখায় লীলায়িত। মানব জীবনের জটিল, গভীর ও ব্যাপক স্বপ্ন-কল্পনা, ভয়-ভাবনা, জিজ্ঞাসা- আকুতি, আনন্দ-বেদনা, ইন্দ্রিয়ানুভূতি, তাঁর বিচিত্র মনের ক্যানভাসে রং ও রেখায় সীমাহীন কারু-কুশলতায় সে সাহিত্য স্বপ্রকাশ। মানব চেতনার বিচিত্র বর্ণের রেখার রসের বিচিত্র বাসনার যেমন সীমা নেই তেমনি বস্তু বিশ্ব ও জীবন দৃশ্যের প্রক্ষোপটে তাঁদের বিচিত্র রূপেরও কোন সীমা নেই। কাজেই মোহাম্মদ হোসাইনের কাব্যসাহিত্যও এক বিচিত্র সাহিত্য! কাব্যে উপমার প্রয়োগে কবি বেশ সিদ্ধহস্থ। হৃদয়ের রঙ-তুলির নিখুঁত আঁচরে উপমাগুলো তাঁর কাব্যে প্রস্ফুটিত ফুলের মতোই যেন সুবাস ছড়াচ্ছে।
তার বৈচিত্রময় প্রকাশ ক্রমাগত রূপ হতে রূপে, রস হতে রসে অগ্রসর হয়েছে। বাহিরের স্থির প্রকাশের সঙ্গে কেমন একটা অতৃপ্তি বোধের ক্ষীণ সুর যেন লেগে আছে। নতুনত্ব ও বৈচিত্রের আকাক্সক্ষা যেন তাকে ক্রমাগত পরিচালনা করেছে। পুরাতনের পুঞ্জিভূত জঞ্জাল দূর করে, রূপ রসের সীমা অতিক্রম করে, তিনি নবতর প্রকাশের মধ্যে অবতরণ করেছেন, আবার যাত্রা করেছেন সেখান থেকে ভিন্ন পথের অভিমুখে। ফলে তাঁর কবিতার বিকাশ বহুমূখী এবং সাহিত্য সৃষ্টিতে এসেছে বিপুল বৈচিত্র্য।
কবিতা মানেই শিল্পের সংশ্রব। কবিতা মানেই তো পৃথিবীর বাহ্য ও অন্তরালের সুপ্ত সংগীতময়তাকে ভাষা দান। শিল্পের বুননে নিজের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। মোহাম্মদ হোসাইন শিল্পের শহরে সেই কবিতার প্রাসাদ গঠনে নিঁপুণ কারিগর। নিচের পংক্তিদ্বয় নিঃসন্দেহে তার সাক্ষর বহন করে।
কবি শব্দ নিয়ে খেলতেই বেশি ভালোবাসেন। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে নতুন ভাব আনয়নে তাঁর জুড়ি মেলা ভার! শিল্পের হাট-বাজারেই যেন তাঁর নিত্য বসবাস! কল্পনা ও বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় তিনি বুনন করে চলেন নিপুণ কাব্য শিল্প।
গতিশীল সময়ে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তনই হচ্ছে প্রকৃতির ধর্ম। আর আমরাও সে পরিবর্তনের বাইরের কেউ নই। কালের হাওয়ায় সে পরিবর্তের ছাপ আমাদের জীবন এবং যৌবনকে অনায়াসেই ছুঁয়ে যায়।
বিষয়-বৈচিত্র্যেও তাঁর লেখায় রয়েছে নিজস্বতা। তিনি এক অদম্য স্বপ্নচারী। তাঁর স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন ছড়ার ভেতর-বাহিরে। ছড়ায় ছড়ায় তিনি যেমন ঘুমপাড়াতে জানেন, তেমনই জানেন ঘুম থেকে জাগাতে। ছড়ার ক্যানভাসে শিশুকিশোরদের স্বপ্ন জাগাতে তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত। নূরুজ্জামান মনি রাজনীতি, সমকাল ও সমাজসচেতন ছড়াকর্মী। তাঁর লেখায় সমাজ নিরীক্ষাও লক্ষণীয়। তিনি সমাজকে দেখেন পর্যবেক্ষকের মতো, আর উপলব্ধি করেন আবেগপ্রবণ ভাবুকের মতো। রাষ্ট্রদেহে জমে থাকা ত্রæটি-বিচ্যুতি বের করতে তাঁর প্রচেষ্টা চলমান। ছড়ার চাবুক মেরে অসঙ্গতিগুলো দূর করতে তিনি সদা ব্যস্ত।
তোষামোদ আর লেজুরবৃত্তি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষ নিত্য এসব গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। নূরুজ্জামান মনির ছড়া এসব ভÐদের, পথভ্রষ্টদের মুখোশ খুলে দিতে চায়। ছড়ার আলোয় সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। দানবীয় অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর ছড়াগুলো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক বিচ্যুতিগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সংশোধনের ইঙ্গিত করে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন সুদূর ফ্রান্সে গিয়ে স্বদেশকে ভুলতে পারেননি, ভুলতে পারেননি নিজের পরিচিত নদকে তেমনই কবি শিউল মনজুরও প্রবাসযাপন করে আত্মবিলাপে ফেটে পড়েছেন। তাঁর সত্তা জুড়ে যেনো স্বদেশের প্রকৃতির অমোঘ টান। স্বদেশের স্মৃতিজাগানিয়া ঘটনাগুলো কবিহৃদয়ে রোদনের ঢেউ তোলে। কবিহৃদয় অতৃপ্ততায় হাহাকার করে ওঠে। কবি মূলত ভেতরে ভেতরে লালন করছেন প্রিয় মাতৃভ‚মির প্রকৃতিকে। দূরপ্রবাসে বসেই তিনি আস্বাদ নিতে চান স্বদেশপ্রকৃতির।
বড় শিল্প হিসেবে বিবেচিত। কবি শব্দের সঙ্গে শব্দের যুতসই মেলবন্ধনে গড়ে তোলেন এই ভাষা। কবিতার সব লাইন হয়ত পাঠক হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় না, তবে কোনো কোনো লাইন নিঃসন্দেহে পাঠকহৃদয়কে আন্দোলিত করে, ভাবিয়ে তোলে। কবি শিউল মনজুরের এই কাব্যে এমন পঙক্তির সঙ্গে পাঠক প্রতিনিয়তই ¯œান করবে।
কাব্যের ভাষার সরলীকরণ খুবই চমৎকার। পাঠক কোনোপ্রকার অভিধান ছাড়াই কবিতার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। কাব্য বুননে তিনি তিনি তাঁর মতোই স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। উপাদান সংগ্রহে তিনি বিচরণ করেছেন সভ্যতার নগ্ন মেঠো পথে। একটি কাব্যের সব কবিতাই পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না; যাওয়ার কথাও নয়। কেননা, কবির মর্জি পাঠক নির্ভর নয়! আর সেকারণেই সব কবিদের সব কবিতাই পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না। যাঁদের কবিতা পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, দলিত-মথিত করে-নিঃসন্দেহে তাঁরা শক্তিশালী কবি। পাঠক হৃদয়কে সহজেই স্পর্শ করে উপমার বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। আর সেদিক থেকে কবি শিউল মনজুর নিঃসন্দেহে সিদ্ধহস্ত। তাঁর কবিতায় উপমাগুলো ¯িœগ্ধ আলোর মতোই জুড়ে থাকে কাব্য শরীর হয়ে। ‘মমতার পৃথিবী ও জোনাকিরা’ সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে একটি স্বার্থক কাব্য। বাকীটা বোদ্ধা পাঠক আর মহাকালের হাতেই বিচারের ভার রইল।
