ইছামতি নামকরণের ইতিকথা

Spread the love

 ইছামতি নামকরণের ইতিকথা

 

সিলেট শহর থেকে অনেক দূরে পল্লি­প্রকৃতির নিস্তরঙ্গ আদর মাখানো একটি গ্রাম। ঠিক গ্রাম নয়, বলা যায় পরগণা। ভ্রমণপিপাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালে এলাকাটিকে মনে হবে যেনো সবুজের আড়ৎ! দূরের দিগবলয় যেখানে এই গাঢ় সবুজের সাথে নিত্য মাখামাখি করে। প্রকৃতির এই নিসর্গকে ভালোবেসে পক্ষিকুলও এখানে জড়ো হতে থাকে। ধীরে ধীরে সুনীল আকাশের সঙ্গে মিলিয়ে নেয় তার স্বপ্নমালতি। যেনো ছবির মতো এক দেশ!
ক্যানভাসে আঁকা প্রকৃতির ছবির মতোই লোভনীয় এই এলাকায় আনুমানিক ১৩২০ সালের দিকে জমিদারিত্ব লাভ করেন মতি নাম্নী নামের এক জমিদার। পিতা গুরুতর অসুস্থ থাকায় পরিবারের বড়ো কন্যা হিসেবে মতিই জমিদারির সকল কার্য সম্পাদন করতেন। বয়স পঁচিশ কী ছাব্বিশ হবে। বেশ ছিমছাম। চোখ দুটি টানাটানা। প্রজাদের সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গি ছিল খুবই মার্জিত আর আকর্ষণীয়। এককথায় তিনি দেখতে যেমন সুন্দরী ছিলেন তেমনই ছিলেন বিদূষী। তবুও নারী শাসক হিসেবে তার কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল।
তার সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেক চতুর প্রজা প্রতারণা শুরু করে দিলো; সেই সঙ্গে বিদ্রোহ! নিজের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে মতিও কঠোর হয়ে উঠল। অল্পদিনেই পেয়াদা-পুলিশের গরম লাঠি-সোঠার ভয়ে বিদ্রোহীরা বরফের মতোই ঠান্ডা হয়ে গেল। মতি ভাবলো রাজ্যে এবার শান্তি বিরাজ করছে; কিন্তু সে ভাবনার কোনো মূল খুজেঁ পাওয়া গেল না। বিদ্রোহীরা আড়ালে মতির নামে কুৎসা ছড়াতে লাগল। পাশ্ববর্তী জমিদারের কাছেও তার নামে নালিশ গেল। সমস্ত এলাকাতেই তখন অত্যাচারী জমিদার হিসেবে মতির দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ল। কেবল রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কারণেই মতির ক্ষমতার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে হুমকির মুখে পতিত হলো।
মতি দিন-রাত উপায় খুঁজতে লাগলো। কীভাবে জনসাধারণের মনে আবারও শান্তি ও সৌহার্দের রূপ ফিরিয়ে আনা যায়। পরিষদবর্গদের সঙ্গেও পরামর্শ করা হলো; কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। রাজ্যের এমন দুর্যোগময় মুহূর্তেই আগমন ঘটলো হযরত ইছে জালাল (র.) এর। ধারণা করা হয় তিনি হযরত শাহজালাল (র.) এর শিষ্য। হযরত শাহজালাল (র) যখন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সিলেট আগমন করেন তখন তাঁর সাথে ছিল ৩৬০ আউলিয়া। হযরত ইছে জালাল (র.) ৩৬০ আউলিয়াদেরই একজন। তিনি হযরত শাহজালাল (র.) এর আদেশক্রমেই এ এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন।
গোলাপের সুবাস যেমন অল্পতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তেমনই হযরত ইছে জালাল (র.) এর গুণকীর্তনও অল্পদিনের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশলেন। তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হলেন। প্রজারাও তাঁকে নিজেদের অতি আপনজন হিসেবে গ্রহণ করল। মানুষ নিত্য সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁর কাছে আসতে লাগল। তিনিও নিজের অর্থনৈতিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিচক্ষণতা দিয়ে প্রজাদের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতেন। দিনকে দিন তাঁর সুনাম বেড়েই যেতে লাগল।
প্রথম দিন থেকেই মতি নাম্নী ইছে জালাল (র.) এর কর্ম অনুসরণ করছিলেন। এরপর একদিন হযরত ইছে জালাল (র.) এর কর্মগুণ ও সততায় মুগ্ধ হয়ে তিনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। হযরত ইছে জালাল (র.) তাঁর সফর সঙ্গীদের সাথে পরামর্শক্রমে ও মতিকে ইসলামধর্ম গ্রহণ করার শর্তে বিয়েতে রাজি হন। মতি কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই রাজি হয়ে গেলেন। সনাতনধর্ম ত্যাগ করে ইসলামধর্ম গ্রহণ করার জন্য প্রজাদের অনেকেই পরবর্তীতে কানাঘুষা শুরু করেছিলেন। মতি এতে মোটেও বিচলিত হলেন না। বরং নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
ইসলামধর্ম গ্রহণপূর্বক তাঁদের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর হযরত ইছে জালাল (র.) এর ওপর জমিদারিত্ব চালানোর দায়িত্ব অর্পিত হলো। যদিও তিনি কোনো সময়ই জমিদারিত্ব গ্রহণের জন্য ইচ্ছুক ছিলেন না। এরপরই দেখা গেল সবচেয়ে স্মরণীয় একটি ঘটনা। এই এলাকার নামটি ইছে এবং মতি (ইছে+মতি) উভয়ের সমন্বয়ে ইছেমতি করা হলো। অর্থাৎ ইছে জালাল (র.) এর ‘ইছে’ আর জমিদার মতি নাম্নী’র মতি’ একত্র করে নতুন নামকরণ করা হলো ইছেমতি। বাংলাদেশের সর্ব উত্তর-পূর্ব স্থান জকিগঞ্জের মানচিত্রে নতুন করে যুক্ত হলো এ নামটি। কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে এ ‘ইছেমতি’-ই একটু বিকৃত হয়ে হয়ে গেল ‘ইছামতি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *