আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন : বিজ্ঞানমনস্ক এক আলোকিত জীবন
বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতা জনপ্রিয় করার ইতিহাসে ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান লেখক, বিজ্ঞান কর্মী ও সরকারি প্রশাসক। সহজ-সরল ভাষায় বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য।
🌿 প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষাজীবন
আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মইন শরফুদ্দিন ও মাতা হালিমা শরফুদ্দিন। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকার মুসলিম হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা বোর্ডে ২য় স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৪৭ সালে আই.এ পরীক্ষায় ১১তম স্থান লাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তাঁর স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি পেলেও পরের বছর প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, যেখানে ১৯৬০ সালে শিক্ষায় এম.এ এবং ১৯৬২ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “Curriculum Changes in Pakistan with Special References to High School Science Education” — অর্থাৎ পাকিস্তানে মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষার পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের বিশ্লেষণ।
🎓 কর্মজীবন
আবদুল্লাহ আল মুতী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন রাজশাহী কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে যেমন তিনি রাষ্ট্রের শিক্ষা সংস্কার ও আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখেন, তেমনি একজন লেখক ও প্রচারক হিসেবে বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার জন্যও নিরলস কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখালেখির পরিসর ছিল বিস্তৃত— রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, বই এবং শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান— সর্বত্রই তিনি ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য নাম।
📚 সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চা
বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ও ধারণাকে সহজ ভাষায় প্রকাশ করার অসামান্য দক্ষতা ছিল তাঁর। তাঁর প্রকাশিত মৌলিক বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা ২৭টি, অনূদিত বই ১০টি এবং সম্পাদিত বই ১০টিরও বেশি।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে (১৯৫৫)
- অবাক পৃথিবী (১৯৫৫)
- আবিষ্কারের নেশায় (১৯৬৯)
- বিজ্ঞান ও মানুষ (১৯৭৫)
- সাগরের রহস্যপুরী (১৯৭৬)
- বিপন্ন পরিবেশ (১৯৮৫)
- বিজ্ঞানের বিস্ময় (১৯৮৬)
- মহাকাশে কী ঘটছে (১৯৯৭)
- আমাদের শিক্ষা কোন পথে (১৯৯৬)
এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন বাংলা একাডেমীর বিজ্ঞান বিশ্বকোষ ও শিশু একাডেমীর শিশু বিশ্বকোষ।
🧠 শিক্ষা ও সমাজে অবদান
জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা সংস্কার, পাঠ্যক্রম উন্নয়ন ও বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তিনি ছিলেন—
- বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’র সভাপতি (১৯৮৮–১৯৯০)
- বাংলা একাডেমির সভাপতি (১৯৮৬–১৯৯০)
- বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিক্ষা সমিতির সভাপতি
- জাতীয় শিশু-কিশোর সংস্থার উপদেষ্টা
তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে “বেক্সিমকো স্পেসফেস্ট” (১৯৯৬) এবং “স্পেসফেস্ট ১৯৯৯”–এর মতো মহাকাশবিষয়ক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা দেশে মহাকাশবিজ্ঞানের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ সৃষ্টি করে।
🕊️ রাজনৈতিক জীবন
যৌবনে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৪৮ ও ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতারও হন। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতি থেকে সরে এসে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞান প্রচারক হিসেবে জীবন উৎসর্গ করেন।
🏅 পুরস্কার ও স্বীকৃতি
ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন তাঁর অনন্য অবদানের জন্য বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন, যেমন—
- ইউনেস্কো কলিঙ্গ পুরস্কার (১৯৮৩) – বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫)
- একুশে পদক (১৯৮৫)
- স্বাধীনতা পদক (১৯৯৫)
- কুদরাত-ই-খুদা স্বর্ণপদক (১৯৭৯)
- জিয়াউর রহমান জাতীয় পুরস্কার (১৯৮১)
- শহীদুল্লাহ কায়সার স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২)
- অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (বহুবার)
তাঁর অবদান শুধু সাহিত্য বা শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, বরং একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে ছিল অপরিসীম।
🌺 মৃত্যু
এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, লেখক ও শিক্ষাবিদ ১৯৯৮ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন ছিলেন এমন এক মনীষী, যিনি বিজ্ঞানের ভাষাকে শিশুদের ভাষায় রূপান্তরিত করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর রচনায় যেমন বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও মানবিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন দেখা যায়, তেমনি তাঁর জীবন ছিল আদর্শ এক আলোকবর্তিকা— জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা ও মানবতার সেবায় নিবেদিত।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বিজ্ঞান শুধু ল্যাবরেটরিতেই নয়— মানুষের মনের ভেতরেও প্রস্ফুটিত হতে পারে।
