আনু মুহাম্মদ: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

আনু মুহাম্মদ: জীবন ও সাহিত্যকর্ম
আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশে মার্কসীয় অর্থনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় অবদানের জন্য এক অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তার পুরো নাম আনু মুহাম্মদ আনিসুর রহমান, তবে তিনি সাধারণত আনু মুহাম্মদ নামেই পরিচিত। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করা এই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী, বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তার চিন্তাধারা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা দিককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
📚 শিক্ষাজীবন ও পেশাগত ক্যারিয়ার:
আনু মুহাম্মদ ১৯৭৩ সাল থেকে লেখালেখির মাধ্যমে সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে তার যাত্রা শুরু করেন, যেখানে তিনি তার চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং ১৯৮২ সাল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘ ৪১ বছর পর, ২০২৩ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি শুধু শিক্ষকরাই নন, একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও পরিচিত। বিভিন্ন শ্রমিক, কৃষক এবং গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণ-বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট এবং বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
✊ সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন:
আনু মুহাম্মদ ১৯৯১ সালে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে ছিলেন একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি গণআদালত পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন। তার নেতৃত্বে ফুলবাড়ী সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনে বিজয় আনে। তিনি বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ রক্ষা নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
তিনি ২০১১ সালে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের আন্দোলনে অংশ নেন এবং বহুবার প্রাণনাশের হুমকির শিকার হন।
✍ সাহিত্যকর্ম:
আনু মুহাম্মদ তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র এবং রাজনীতির নানা দিক তুলে ধরেছেন। তার “বিশ্ব পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের অনুন্নয়ন”, “বাংলাদেশের দুুর্ভিক্ষ” এবং “বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি” বইগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
তার সাহিত্য শুধু কেবল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ, নির্যাতন এবং শোষণের বিরোধী চিন্তাধারাকে প্ররোচিত করেছে। সমাজতন্ত্র, অর্থনৈতিক নীতি, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক অধিকারের প্রশ্ন তার লেখায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। তার লিখিত গ্রন্থতালিকা অত্যন্ত বিস্তৃত এবং সেগুলোতে তিনি গভীর চিন্তাভাবনা, সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব ও সমকালীন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
📖 গ্রন্থসমূহ:
আনু মুহাম্মদের লেখালেখি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং তার অনেক গ্রন্থ আজও পাঠক সমাজে বিশেষভাবে আলোচিত হয়। তার কিছু প্রখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
- “বিশ্ব পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের অনুন্নয়ন”
- “বাংলাদেশের দুুর্ভিক্ষ”
- “বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি”
- “বাংলাদেশের উন্নয়ন সংকট এবং এনজিও মডেল”
তবে, তার অনেক কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো “ফুলবাড়ী, কানসাট, গার্মেন্টস ২০০৬”, যেখানে তিনি বাংলাদেশের কিছু প্রকল্প এবং আন্দোলনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
অনুবাদ গ্রন্থ
১. মনের আলোয় রঙের ভুবন, ১৯৭৮ (অগ্রন্থিত)।
২. ফানশেন, ১৯৭৯-৮০ (অগ্রন্থিত)।
৩. আদিবাসী বিদ্রোহ, ১৯৮১ (অগ্রন্থিত)।
৪. হাত বাড়িয়ে দাও (বিচিত্রা, ১৯৮২), ১৯৯২, ১৯৯৪, ১৯৯৬, ২০০০, ২০১০, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৮, ২০২০।
৫. বাংলাদেশে বর্গাচাষ ও বর্গাচাষী আন্দোলন, পল্লব পাবলিশার্স, ১৯৯১।
৬. এঙ্গেলসের এন্টি ড্যুরিং, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০৫। ২য় মুদ্রণ ২০২১।
পুস্তিকা
১. সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির রূপান্তর ও সমাজতন্ত্র, পাঁপড়ি প্রকাশনী, ১৯৮২।
২. আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সংকট: চীন প্রসঙ্গ, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ১৯৮৩।
৩. সাম্রাজ্যবাদী সাহায্য সংস্থা, টার্গেট গ্রুপ ও কৃষক মুক্তি, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, ১৯৮২, ১৯৮৬।
৪. ছাত্র সমাজ, ছাত্র আন্দোলন ও বিপ্লবী রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ১৯৮৫।
৫. ব্যাংক বিরাষ্ট্রীয়করণ ও লুটেরা অর্থনীতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, ১৯৮৬।
৬. সিপিবির রাজনীতি ও লেজুড়বাদ, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ১৯৮৭।
৭. আমাদের সমাজ, সমাজ পরিবর্তনের নিয়ম ও সমাজতন্ত্র, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ১৯৮৮।
৮. সমাজতন্ত্রের বিকাশ ধারা ও বিরুদ্ধ শক্তির বিকাশ, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ১৯৯১।
৯. মজুরী ও উৎপাদনশীলতা, দীপ্র প্রকাশনী, ১৯৯২।
গ্রন্থ সম্পাদনা
আসহাবউদ্দীন আহমদ রচনাবলী (১-৩ খন্ড), মীরা প্রকাশনী, ২০০৪। Bangladesh at 25, UPL, 1996 (with Abdul Bayes) পারমাণবিক বিদ্যুৎ: বাংলাদেশে রূপপুর প্রকল্প ও বিশ্ব অভিজ্ঞতা, ইউপিএল, ২০২৩ (সাথে কল্লোল মোস্তফা এবং মোশাহিদা সুলতানা)
পত্রিকা সম্পাদনা
অংকুর (১৯৭২-৭৩)
শিরোনাম, ইকনমিক স্টাডি বুলেটিন (১৯৭৬-৭৯)
সাংস্কৃতিক আন্দোলন (১৯৮১-১৯৯০)
নির্বাহী সম্পাদক, সংস্কৃতি (১৯৮১-১৯৯৯)
তৃণমূল (১৯৯৮-২০০০)
নতুন পাঠ (২০০২–২০০৩)
মেঘবার্তা (১৯৯৮-২০১২)। ইন্টারনেট পত্রিকা মেঘবার্তা [১৩] বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন ম্যাগাজিন ছিল।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদ সমীক্ষা, জাবি (২০১৩- ২০২২)
সর্বজনকথা (২০১৪-)
🌏 বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি:
আনু মুহাম্মদ আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত লেখালেখির জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি লিখেছেন “বিশ্বায়নের বৈপরীত্য”, যা বিশ্ব অর্থনীতি এবং তার প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা প্রবর্তন করেছে। “বাংলাদেশের তেল-গ্যাস: কার সম্পদ, কার বিপদ?” বইটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা ও শোষণের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
🌿 ব্যক্তিগত জীবন ও অবদান:
আনু মুহাম্মদ শিক্ষকতা, লেখালেখি এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজের জন্য ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি শুধু একজন চিন্তাবিদ হিসেবেই নয়, একজন বিবেকবান নাগরিক, সমাজের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এক বুদ্ধিজীবী। তার প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা বাংলাদেশের সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে, এবং তার চিন্তাধারা আগামী দিনগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করবে।
উপসংহার:
আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশে একজন অবিস্মরণীয় চিন্তাবিদ এবং আন্দোলনকারী হিসেবে পরিচিত। তার সাহসী লেখালেখি, আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির বিশ্লেষণ করে তিনি মানবতার পক্ষে এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন।