আখতারুজ্জান ইলিয়াস : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

✦ ভূমিকা
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বাঙালির সামাজিক বাস্তবতা, ইতিহাসচেতনা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব। তিনি ক্ষণজন্মা লেখক হলেও বাংলা ছোটগল্প ও উপন্যাসে অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
✦ জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, বগুড়া জেলার গাবতলী থানার গাবতলী গ্রামে। তার পিতার নাম ছিলেন সৈয়দ আলী আহমেদ, যিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। সাহিত্যিক পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা এবং লেখালেখির প্রাথমিক অনুপ্রেরণা লাভ ঘটে।
✦ শিক্ষাজীবন
তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেন। শেষজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
✦ সাহিত্যিক পরিচয়
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রধানত একজন ছোটগল্প ও উপন্যাস লেখক। যদিও তাঁর সাহিত্যকর্মের সংখ্যা সীমিত, তবুও বিষয়বস্তু, শৈলী ও ভাষার দিক থেকে তাঁর রচনাসমূহ বাংলা সাহিত্যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।
✦ উপন্যাস
তাঁর রচিত মাত্র দুটি উপন্যাসই বাংলা কথাসাহিত্যে কালজয়ী হিসেবে স্বীকৃত।
- চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭)
– এই উপন্যাসে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ঢাকার নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ চিত্রিত হয়েছে। এটি বাস্তবতা, স্বপ্ন এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপন। - খোঁয়ারি (১৯৯৬)
– এটি একটি প্রতীকময় উপন্যাস যেখানে ব্যক্তি ও সমাজের ভেতরকার বিভ্রান্তি, বিচ্ছিন্নতা এবং অস্তিত্ব সংকট তুলে ধরা হয়েছে।
✦ ছোটগল্প
তাঁর ছোটগল্পগুলোয় রয়েছে গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা, ইতিহাস ও রাজনীতির প্রভাব। উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ:
- দোজখের ওম (১৯৮৫)
- অন্যান্য গল্প
- “খোঁয়ারি”,
- “নিরুদ্দেশ যাত্রা”,
- “জার্মান সিলভার রৌজ”,
- “রেইনকোট”,
- “রাজা যায় রাজা আসে” ইত্যাদি।
ইলিয়াসের গল্পের ভাষা, বর্ণনা এবং চরিত্র নির্মাণ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং জীবন্ত।
✦ ভাষা ও শৈলী
ইলিয়াসের ভাষা বাস্তবমুখী, সংলাপপ্রধান এবং অঞ্চলের প্রতিসংবেদনশীল। তিনি উপমা, রূপক, লোকজ উপাদান এবং রাজনৈতিক ব্যঞ্জনার দক্ষ ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখায় চেতনার গভীরতা ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ।
✦ প্রবন্ধ ও রচনা
তিনি সাহিত্যের বিশ্লেষণ, সমালোচনা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
- সংস্কৃতি ও রাজনীতি
- সহজিয়া আচার ও বাংলা সাহিত্য
- নির্বাচিত প্রবন্ধ
✦ পুরস্কার ও সম্মাননা
তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২)
- একুশে পদক (১৯৯৯) – মরণোত্তর
- হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার
- আনন্দ পুরস্কার
✦ মৃত্যু
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫৩ বছর, কিন্তু এই স্বল্প সময়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট অবস্থান অর্জন করেছিলেন।
✦ উপসংহার
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এমন একজন লেখক যিনি সাহিত্যকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম না দেখে সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতির নির্ভুল দর্পণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর রচনাগুলি পাঠককে চিন্তায়, বিশ্লেষণে ও আত্মমূল্যায়নে বাধ্য করে। তাঁর সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে একটি বিশুদ্ধ ও গভীর বোধের দিকচিহ্ন।
https://www.munshiacademy.com/আখতারুজ্জামান-ইলিয়াস-জ-2/